X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১৩ বৈশাখ ১৪৩১

পুরান ঢাকায় নেই খেলার মাঠ

রফিকুল ইসলাম ও আবু হায়াৎ মাহমুদ
২৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৮:৫৩আপডেট : ২৩ ডিসেম্বর ২০১৭, ১৯:০১

ধূপখোলা মাঠ এখন রিকশা আর ভ্যানের গ্যারেজ, নির্মাণ বর্জ্যের স্তূপ (ছবি- মেহেদী হাসান/ঢাকা ট্রিবিউন)

শত বছর ধরে বাংলা অঞ্চলের সভ্যতা ও বাণিজ্যের কেন্দ্র ছিল আজকের দিনের পুরান ঢাকা। এখানে-ওখানে ছড়ানো-ছিটানো পার্ক ও খোলা জায়গার পাশাপাশি স্বাদু পানির লেক ও নদী এই ঢাকাকে করে তুলেছিল প্রকৃতির এক সমৃদ্ধ কন্যা। তবে উন্নয়নের নামে ধীরে ধীরে ঢাকা হারাতে থাকে জলাশয় ও খোলা জায়গা। এর মধ্যেও ১৫টি ১৫টি পার্ক ও খেলার মাঠসহ কিছু খোলা জায়গা এখনও নিজেদের টিকিয়ে রাখতে পেরেছে। তবে এগুলোর অবস্থাও তথৈবচ— ভূমিদস্যুদের হাতে দখল হয়ে কিংবা জরাজীর্ণ অবস্থায় এগুলোর অবস্থা এমন যে সাধারণ মানুষের যাওয়ার কোনও উপায় নেই।
স্থানীয় বাসিন্দারা বলছেন, রক্ষণাবেক্ষণের অভাব আর কর্তৃপক্ষের উদাসীনতার কারণেই এসব পার্ক হারিয়ে যেতে বসেছে। পুরান ঢাকার শিশুদের মধ্যে এখনও যারা বন্ধুদের সঙ্গে ক্রিকেট খেলতে বাইরে যেতে চায়, তারাও এসব পার্কের বাইরে বসে থাকে। প্রহরী না থাকলে তারা চুপ করে পার্কে ঢুকে মাত্র কয়েক ওভারের ম্যাচ খেলে আবার ফিরে যায়। তাই ঘরকুণো হয়ে ভিডিও গেমস খেলার প্রবণতা নিয়ে যতই সমালোচনা করা হোক, খেলার মতো জায়গা তাদের না দিতে পারলে বাইরে বেরিয়ে খেলার সুযোগ তারা পাবেই না। কেবল শিশুদের জন্য নয়, পার্কগুলো বয়স্কদের জন্যও হতে পারে একটু শ্বাস ফেলার জায়গা। বদ্ধ ঘরের বাইরে বেরিয়ে তারা একটু নির্মল বাতাসের সন্ধান পেতে পারেন পার্কগুলোতে। কারণ খেলাধুলা না করা কিংবা শারীরিকভাবে সচল না থাকায় নিষ্ক্রিয়তা চলে এলে তা তরুণদের তো বটেই, বয়স্কদের জন্যও ক্ষতিকর এবং তা সার্বিকভাবে জনস্বাস্থের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।
শিশু বিশেষজ্ঞ ড. বিজয় কর্মকার বলেন, ‘খেলাধুলা মস্তিষ্কের উন্নয়ন, নেতৃত্ব গঠন ও দায়িত্বশীলতা বাড়াতে সহায়ক। সুস্থভাবে শারীরিক বৃদ্ধির জন্য শারীরিক সক্রিয়তা অত্যন্ত জরুরি। ঢাকার ভবিষ্যত নিয়ে যেসব নগর পরিকল্পনাবিদরা কাজ করছেন, তাদের এখনও এই নগরীর জন্য খোলা জায়গা ও পার্কের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে হবে।’
পুরান ঢাকার বাংলাদেশ মাঠটির গ্যালারি বর্জ্য আর পলিথিন সংগ্রহকারীর দখলে (ছবি- রাজীব ধর/ঢাকা ট্রিবিউন) পুরান ঢাকার বংশাল এলাকার বাসিন্দা ফজলুর রহমান নগরীর ঐতিহাসিক এই প্রাণকেন্দ্রে সবুজ জায়গা না থাকায় খু্ব দুঃখপ্রকাশ করেন। তিনি বলেন, ‘আমরা এক সময় বংশাল ট্রায়াংগল পার্কে খেলতাম। পার্কটি এখন প্রায় মরেই গেছে। ঘরের মধ্যে বসে ভিডিও গেম খেলা ছাড়া বাইরে খেলার মতো জায়গা এখন শিশুদের জন্য আর নেই।’
ঢাকার ১৫টি পার্ক
নরিন্দা শিশু পার্ক, মালিটোলা পার্ক, বংশাল ট্রায়াংগল পার্ক, বাহাদুর শাহ পার্ক, নবাব সিরাজউদদৌলা পার্ক, নাজির বাজার পার্ক, বকশি বাজার পার্ক, বশিরউদ্দিন পার্ক, জগন্নাথ সাহা পার্ক, নওয়াবগঞ্জ শিশু পার্ক, হাজারিবাগ শিশু পার্ক, হাজারিবাগ কাশাইটুলি পার্ক, নিমতলি সড়কদ্বীপ পার্ক, বলধা গার্ডেন ও বাংলাদেশ মাঠ।
কোনও পার্কই নেই
পুরান ঢাকার অনেক পার্ক এখন গাড়ি ও রিকশার গ্যারেজে পরিণত হয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দাদের ভয় দেখিয়ে পেশিশক্তির মাধ্যমে দখলকৃত এসব পার্ক এখন অনেকের ব্যক্তিগত আয়ের উৎস হয়ে পড়েছে। কিছু কিছু পার্কে যৌন কর্মী ও মাদক বিক্রেতারা অবাধে নিজেদের কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। আর যাদের কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, সেই সব উদ্বাস্তুরাও ঠিক পার্কের কোণাগুলোতে ঘর তুলে একে বস্তিতে রূপ দিয়েছেন। সব মিলিয়ে পার্ক বলে আর কিছু অবশিষ্ট নেই।
আবার কিছু পার্কের অবস্থা একটু ভালো। এগুলো নিয়মিত পরিষ্কার করা হয়। কিন্তু এসব পার্ক আবার রাজনৈতিক সভার জন্য নির্ধারিত স্থানে পরিণত হয়েছে। বলতে গেলে প্রায় সারাবছরই এসব পার্ক জনসভার জন্য বুকিং দেওয়া থাকে। আর যে সময় এগুলোর বুকিং থাকে না, ওই সময়ে আগের সব জনসভার আবর্জনাতেই ভর্তি থাকে পার্কগুলো।
ভাঙা পাইপ ময়লা পানি আর আবর্জনায় খেলার পরিবেশও নেই বাংলাদেশ মাঠে (ছবি- রাজীব ধর/ঢাকা ট্রিবিউন) মাঠ নিয়ে বিতর্ক
প্রায় সাত একর আয়তনের ধুপখোলা মাঠটি ঢাকার অন্যতম বড় মাঠ। তবে এখন এর মূল আয়তনের বেশি অংশই খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইস্টার্ন ক্লাব, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও তিন প্রতিষ্ঠানের দখলেই চলে গেছে এই মাঠের বেশিরভাগ জায়গা। এখন ধুপখোলা মাঠ বলতে অবশিষ্ট সামান্য কিছু জায়গা।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়েল উপাচার্য মিজানুর রহমান বলেন, ‘আমরা আমাদের অংশে বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলাধুলার আয়োজন করে থাকি। তাছাড়া স্থানীয়দের জন্য আমরা দুই একর জায়গা ছেড়ে দিয়েছি।’
উদীয়মান ক্রিকেটারদের জন্য আবার পছন্দের জায়গা বাংলাদেশ মাঠ। কিন্তু মাঠটিতে কোনও ঘাস নেই। ফলে ধুলার মধ্যেই খেলতে হয় শিশু-কিশোরদের। এতে করে তাদের আঘাত পাওয়ার ঘটনাও নিয়মিত।
যাত্রাবাড়ীর ধোলাইপাড়ের শিশুদের আশেপাশেও কোনও খেলার মাঠ নেই। তাই খেলতে হলে তাদের যেতে হয় কেরাণীগঞ্জে, অথবা রাস্তা বা কোনও কনস্ট্রাকশন সাইটের মতো ঝুঁকিপূর্ণ স্থানেই খেলতে হয় তাদের।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের মহাসচিব ড. এম এ মতিন ঢাকায় খোলা জায়গার প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরে বলেন, ‘শহর এলাকায় জনসংখ্যার অনুপাতে খোলা জায়গা থাকার কথা। তবে দুঃখের বিষয় হলো— ঢাকার সেই জায়গা দেওয়ার সক্ষমতা নেই।’
লালবাগ মাঠে এখনও শিশুরা খেলতে নামে, কিন্তু এখানে ঘাস বলে কিছু নেই (ছবি- সৈয়দ জাকির হোসেন/ঢাকা ট্রিবিউন) যা করছে ডিএসসিসি
ঢাকা দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশন (ডিএসসিসি) এরই মধ্যে তাদের অধীন পার্ক ও খেলার মাঠ সম্পূর্ণভাবে নিজেদের দখলে নেওয়ার জন্য প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হলে এসব মাঠ উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে সাধারণ মানুষের জন্য। কোনও ধরনের রাজনৈতিক সমাবেশ কিংবা ধর্মীয় বা সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনের জন্য এসব মাঠ ব্যবহার করা যাবে না বলেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে ডিএসসিসি। সংস্থাটির মেয়র সাঈদ খোকনের নেওয়া এই উদ্যোগের আওতায় রয়েছে ১৯টি পার্ক ও ১২টি খেলার মাঠ।
ডিএসসিসি’র প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা খান মোহাম্মদ বেলাল আশ্বস্ত করে বলেন, ‘প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হলে এসব পার্ক ও খেলার মাঠে কোনও ধরনের জনসভা বা জনসমাবেশের অনুমতি দেওয়া হবে না।’
প্রকল্পের আওতায় থাকা পার্কগুলোর মধ্যে রয়েছে— গুলিস্তান পার্ক, মতিঝিল পার্ক, যাত্রাবাড়ী চৌরাস্তা পার্ক, সিরাজউদদৌলা পার্ক, শিক্কাটুলি পার্ক, মালিটোলা পার্ক, বংশাল ট্রায়াংগল পার্ক ও মেয়র মোহাম্মদ সাঈদ খোকন পার্ক বা শরাফাতগঞ্জ পার্ক। আর খেলার মাঠগুলোর মধ্যে রয়েছে— কলাবাগান খেলার মাঠ, বাসাবো খেলার মাঠ, সাদেক হোসেন খোকা খেলার মাঠ, দেলোয়ার হোসেন খেলার মাঠ, আমলিগোলা খেলার মাঠ, শহীদ নগর মিনি স্টেডিয়াম, বালুরঘাট খেলার মাঠ, শহীদ আব্দুল আলীম খেলার মাঠ, সামসাবাদ খেলার মাঠ ও বাংলাদেশ মাঠ।
(ঢাকা ট্রিবিউনে প্রকাশিত)
আগের পর্ব-

ঢাকার পার্ক বাঁচাবে কে?

/আরএ/টিআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
পুলিশের সব স্থাপনায় নিরাপত্তা জোরদারের নির্দেশ
শনিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
শনিবার গ্যাস থাকবে না যেসব এলাকায়
জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তা দ্বিগুণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আহ্বান পরিবেশমন্ত্রীর
জলবায়ু অভিযোজনে সহায়তা দ্বিগুণের সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের আহ্বান পরিবেশমন্ত্রীর
গাজার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে ১৪ বছর লাগতে পারে: জাতিসংঘ
গাজার ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কারে ১৪ বছর লাগতে পারে: জাতিসংঘ
সর্বাধিক পঠিত
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
চুক্তিতে মাউশির ডিজি হলেন নেহাল আহমেদ
এগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
ঈদের ছবিএগিয়েছে ‘ওমর’, চমকে দিলো ‘লিপস্টিক’!
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
মৈত্রী ট্রেনে তল্লাশি, মুদ্রা পাচারের অভিযোগে আটক দুই বাংলাদেশি
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
সরকারি না হলেও সলিমুল্লাহ কলেজে অধ্যাপক ১৪ জন
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী
আমরা সবাই ফেরেশতা, বাস করি বেহেশতে: রায়হান রাফী