ইউটিউবে শিশুদের জন্য তৈরি হচ্ছে প্রাপ্ত বয়স্ক (অ্যাডাল্ট) সব কনটেন্ট। আর এতে অভিনয় করানো হচ্ছে ১০-১৬ বছরের শিশু-কিশোরদের। বিষয়বস্তু বড়দের, পোশাক বড়দের, শিশুদের দিয়ে কেবল অভিনয় করানো হচ্ছে। প্রেমে পাগল, মনে জ্বালার মতো বিষয়গুলোর সঙ্গে ‘অংশগ্রহণকারী ও দর্শক শিশুরা’ পরিচিত হচ্ছে। এসব আপত্তিকর কনটেন্ট যেকোনও মূল্যে বন্ধ করা এবং শিশুর বেড়ে উঠতে সহায়ক কনটেন্ট ইউটিউবে দেওয়ার ব্যবস্থা করতে এখনই উদ্যোগ নেওয়ার কথা বলছেন জনপ্রিয় কনটেন্ট নির্মাতা ও ইউটিউবাররা। আর আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্বশীল কর্মকর্তা বলছেন, সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির মধ্যকার পার্থক্য নির্ধারণ করে সুনির্দিষ্টভাবে অভিযোগ করবে এরকম মনিটরিং দরকার।
ইউটিউবে ছোটদের নাটক দেখার জন্য সার্চ দিলে এমন কনটেন্ট হাজির হয়, যেখানে শিশুদের বড়দের চরিত্রে অভিনয় করতে দেখা যায়। বিষয়বস্তুও প্রাপ্ত বয়স্কদেরই। এসব কনটেন্টের টার্গেট গ্রুপ শিশুরাই। শিশুদের বিনোদনের ভিডিওতে বিভিন্ন রকমের অনাকাঙ্ক্ষিত বিজ্ঞাপন প্রদর্শন নিয়ে বিশ্বব্যাপী যখন আন্দোলন ও পর্যালোচনা চলছে, তখন শিশুদের ব্যবহার করে এসব দেশীয় কনটেন্ট দিয়ে ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম ভরে ফেলা অপরাধ পর্যায়ে পড়ে বলে মনে করছেন শিশু অধিকারকর্মীরা। তারা বলছেন, এসব আপত্তিকর অনাকাঙ্ক্ষিত কনটেন্টে শিশুরা একদিকে যেমন বিভ্রান্ত হচ্ছে, অন্যদিকে তাদের মধ্যে বিকৃত ভাবনাও তৈরি হচ্ছে।
ইউটিউবার ও কনটেন্ট নির্মাতা সাকিব বিন রশীদ বলেন, ‘শিশুদের কনটেন্ট হিসেবে যা দেখানো হয় তা ভয়াবহ। আমি বেশ কিছু তেমন ভিডিও দেখেছি। এই শিশুদের দিয়ে যা বলানো হয় এবং যেভাবে তা দেখানো হয়, তা দেখে যদি শিশুরা সত্যি তেমন আচরণ করতে চায় সেটির ফল হবে ভয়ঙ্কর। রোমান্টিক দৃশ্যে বড়দের মতো করে সাজিয়ে শিশুদের উপস্থাপন স্পষ্টতই শিশু অধিকারের লঙ্ঘন।’
তিনি আরও বলেন, ‘শিশুদের জন্য সুস্থ শিক্ষা দরকার। তা তো নেই-ই, বরং তার পরিবর্তে নেতিবাচক শিক্ষার মুখোমুখি হতে হচ্ছে তাকে। বড়দের কপি করা শিখছে সেটিও নেতিবাচক কনটেন্টের মাধ্যমে। বন্ধু কীভাবে তৈরি হবে, প্রকৃতি কখন কীভাবে সাড়া দেয়, বড়দের সঙ্গে আচরণ কেমন হবে, বিভিন্ন মূল্যবোধ শেখানো যেতে পারে। আমি শিশুদের কনটেন্ট বন্ধের পক্ষে বলছি না। শিশুদের উপযোগী আইডিয়া নিয়ে কাজ করা জরুরি। সৃজনশীলতা বাড়বে এমন কনটেন্ট নিয়ে কাজ করা জরুরি।’
সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার (এডিসি) নাজমুল ইসলাম বলেন, ‘এ ধরনের কনটেন্টের বিষয়ে উদ্যোগ নেওয়ার সুযোগ সাইবার ক্রাইমের অবশ্যই আছে। কিন্তু সবার আগে সংস্কৃতি ও অপসংস্কৃতির মধ্যকার পার্থক্য সুনির্দিষ্ট করতে হবে। নাটিকা বা ছোট ছোট যে ভিডিও ক্লিপগুলো সেগুলো নিয়মিত একটা মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা থাকা দরকার।’
এ ধরনের সমস্যাকে সামাজিক সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ডিজিটাল পরিসরে অনেক ধরনের কনটেন্ট আছে। চাইলেই একাধারে সব বন্ধ করে দেওয়া যাবে না। তেমন কিছু করলে বাকস্বাধীনতা নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। ভুক্তভোগী বা দায়িত্বশীল ব্যক্তিরা সুনির্দিষ্ট অভিযোগ আনতে পারেন। সেগুলো আমলে নিয়ে আমরা আমাদের করণীয় নির্ধারণ করতে পারি।
শিশু অধিকার পরামর্শক আব্দুল্লাহ আল মামুন বলেন, ‘স্পষ্ট কথা হচ্ছে এগুলো অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। যে কারণ এখানে শিশুদের তিনটি বড় ক্ষতির জায়গা তৈরি হচ্ছে—প্রথমত, কনটেন্টগুলো হচ্ছে অশ্লীল। দ্বিতীয়ত, এগুলো স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক, পরিবার সম্পর্কে একটি কুরুচিপূর্ণ, নারীর প্রতি মর্যাদাহীন শিক্ষা দিচ্ছে শিশুকে। সেটা অবিলম্বে বন্ধ করতে হবে। এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা খুব জরুরি। কারণ, ছোটবেলাই শিশুদের মনে যেটা গেঁথে যায় সেটাই কিন্তু সারা জীবন তার মনের ভেতরে থাকে। কাজেই এ ধরনের কনটেন্ট তৈরির ক্ষেত্রে এগুলো খুবই সেনসিটিভ একটা বিষয়, প্রশাসনের অবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। এর ভেতরে কিছু কিছু কন্টেন্ট আছে, যেগুলোর বিষয়ে আমাদের আইসিটি অ্যাক্ট এবং পর্নোগ্রাফি আইনে একটা ব্যবস্থা নেওয়ার সুযোগ রয়েছে। কাজেই শিশুদের ব্যবহার করা, এটা যেমন গুরুতর অপরাধ, শিশুদের টার্গেট করে এ ধরনের কনটেন্ট তৈরি করা, সেটিও অপরাধ। যারা এ কাজ করছে তাদের চিহ্নিত করে শাস্তির আওতায় আনতে হবে।’