বর্ষবরণ উৎসবে নতুন পোশাক কিনতে গেলে যেমন সাদা লাল রঙ-এ হাত চলে যায়, তেমনি ফ্যাশন হাউসগুলোও ক্রেতার চাহিদা মেটাতে সাদা-লাল মোটিভেই কাজ করে বেশি। আর এ দুয়ের সমন্বয়ে বর্ষবরণ মানেই, বৈশাখের রঙ সাদা-লাল হিসেবে বিবেচিত হয়ে গেছে। ফ্যাশন ট্রেণ্ড নিয়ে কাজ করেন যারা, তারা অভিজ্ঞতা থেকে বলছেন, বর্ষবরণের কোনও সুনির্দিষ্ট রঙ থাকতে পারে না। উজ্জ্বল যেকোনও কিছুই উৎসবের সঙ্গে যায়।
তাহলে সাদা-লাল বৈশাখের ঐতিহ্য এই চিন্তা আসলো কিভাবে। সম্রাট আকবর প্রথম বৈশাখ উদযাপনে কি সাদা উত্তরীয় পরেছিলেন? কিংবা সম্রাটের বেগমের পছন্দের রং কি ছিল লাল? নাকি স্বাধীন বাংলায় কেউ বলে দিয়েছিলেন, নতুন বছর বরণ হোক সাদা আর লালে। পোশাক ডিজাইনাররা এবং কথা সাহিত্যিকরা বলছেন, বৈশাখের কোনও রং নেই। প্রতিটা ঋতুতে সাধারণত আরাম বোধ হয় যেসব রঙের পোশাক পরে, সেটাকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়। তবে ২০০০সালের পর চেষ্টা করা হয়েছে রঙের এই দাপট ভাঙতে। পুরোপুরি সফল না হলেও এখন ভিন্ন রঙের উপস্থিতি দেখা যায় পোশাকে। কারও কারও মতে, ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে বৈশাখের প্রধান আয়োজন হালখাতা, যার মোড়কের অংশ লাল এবং ভেতরের পাতা সাদা, সেখান থেকে লাল-সাদা আসতে পারে।
ফলে বৈশাখের রঙ লাল-সাদা’র চল কেন বা কবে থেকে, এ বিষয়ে মতভেদ থাকলেও পোশাক নিয়ে কাজ করেন যারা, তাদের সঙ্গে কথা বলে এটা নিশ্চিত বলা যায়, এটা চিরায়ত নয়। আবার অনেকে মনে করেন, বেশ আগে হিন্দু নারীরা লাল পাড়ের সাদা শাড়ি পরে বিভিন্ন পূজা-পার্বণের মধ্য দিয়ে বছরটাকে বরণ করতেন। আর সেসময় নারীরা লালপেড়ে শাড়িই ব্যবহার করতেন। একেবারে সাদা শাড়ি যেহেতু সধবারা পড়তেন না, সেক্ষেত্রে লাল পেড়ে সাদা শাড়ির প্রচলন বেশি ছিল। সেই থেকেই এই রঙ এর প্রচলন হয়ে থাকতে পারে।
ফ্যাশন ট্রেণ্ড নিয়ে কাজ করেন যারা তারা বলছেন, এসময় ভীষণ গরম থাকে ফলে সাদা পরার প্রবণতা থাকে। আর সাদা সব রঙের সমাহার। এর মধ্যে লাল উৎসবের রঙ। আবার নববর্ষের প্রথম সূর্যকে শান্তির প্রকাশ হিসেবে নব আলোয় উদ্ভাসিত হতেও লালের ব্যবহার আছে।
কথাসাহিত্যিক শাকুর মজিদ বলেন, আমার ধারণা এটা আবহাওয়া থেকে এসেছে। সাদা কাপড়ে তাপ শোষণ কম হয়। রোদের জন্য গরমে সাদা কাপড় আরামদায়ক, আর তার সঙ্গে লাল এসেছে উৎসবের সং হিসেবে। এদিকে গল্পকার রুমা মোদক বলেন, ঠিক জানি না লাল সাদা কীভাবে নির্ধারিত হলো। আমরা ছোটবেলায় নববর্ষে নতুন জামা পেতাম। তবে লাল সাদা হতে হবে, এমন কোনও বাধ্য বাধকতা ছিলো না।
বিবিয়ানা পোশাক হাউসের প্রতিষ্ঠাতা লিপি খন্দকার পোশাকের রঙ সম্পর্কে ইতিহাস কী বলে তা জানেন না স্বীকার করে নিয়ে বলেন, সাদা লাল দিয়ে সম্ভ্রান্ত পরিবারের নারীরা পূজা করে বছরটাকে স্বাগত জানাতেন, সেইটা ফ্যাশনে চলে এসে থাকতে পারে। আসল ইতিহাস জানি না। তবে আমাদের ছোটবেলায় দেখেছি বাসায় ভাল শাড়ির তালিকায় সাদা লাল গরদ বা কটন কাপড় থাকতো। আমরা সেগুলো পরে এদিন অনুষ্ঠানে যোগ দিতাম। তবে এই প্রচলন ভাঙছে। তিনি বলেন, ২০০০ সালের পর থেকে সাদা লাল থেকে বেরিয়ে আসতে শুরু করেছে। এখন হালকা অনেক রঙ নিয়েই আমরা এসময়টাতে কাজ করার চেষ্টা করি। কিন্তু মানুষ সাদা লাল থেকে বের হতে সময় নেবে।
কীভাবে বদলের চেষ্টা হয়েছে জানাতে গিয়ে তিনি বলেন, ২০০৬- ০৭ এর দিকে বৈশাখের পোশাকের রঙে সংযোজন হয়েছে বাহারি রঙ। যেমন পেস্ট, হলুদ, গোল্ডেন, ম্যাজেন্টা ও সবুজের বিভিন্ন শেডের ব্যবহার শুরু হয়। দেখা গেছে, পাশাপাশি সাদা লাল পোশাক রাখা হলে সেদিকেই নজর যায় ক্রেতাদের। কিন্তু বিভিন্ন রঙ সংযোজনের চেষ্টা আমরা অব্যহত রেখেছি। এর পরের বছরগুলোতে ধীরে ধীরে হলুদ, অফ হোয়াইট, কমলা, নীল, সবুজ, টিয়া, লাইম গ্রিন, ফিরোজা, ইটলাল ইত্যাদি রঙের ব্যবহারও দেখা গেছে। আর গত দুইবছর ধরে লাল-সাদাতে থাকলেও লালের প্রাধান্য বেশি দেখতে পাওয়া যায়। আসলে যেকোনও উৎসবে লালের প্রতি আগ্রহ বেশি থাকে, লালটা মানিয়েও যায় চট করে। আর মানুষের মাথায় পান্তা ইলিশের মতোই লাল-সাদা পোশাক ঢুকে গেছে। নতুন ও উজ্জ্বল সব রঙে একদিন নতুন বছরকে বরণ করার চলও শুরু হবে। কেবল সময়ের অপেক্ষা।
/ইউআই/ এপিএইচ/
/ইউআই/ এপিএইচ/