গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী, ব্লগার থেকে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট, ভিন্ন ধর্মের প্রতি সহানুভূতিশীল থেকে ইমাম, মুয়াজ্জিন, সাধু, ফাদার কিংবা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক থেকে সমকামী অধিকার আন্দোলনকর্মী, কেউ আর বাদ যাচ্ছেন না, চলছে একের পর এক এলোপাতাড়ি খুন। টার্গেট কিলিং!
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, সেই টার্গেট এবার বিস্তৃত হচ্ছে। চাপাতির সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আগ্নেয়াস্ত্র এবং রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টির জন্য এক ধরনের আতঙ্ক তৈরির চেষ্টার লক্ষণও দেখছেন তারা।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী রাজীব হায়দার খুনের পর থেকে গত দুই বছরে একের পর এক হত্যা করা হয়েছে ব্লগারদের। একেকটি হত্যাকাণ্ড ঘটলেই তিনি মুক্তমনা ব্লগার কিনা, কিংবা তিনি নাস্তিক কিনা, এ ধরনের বিষয়গুলো সামনে এসেছে। ধরে নেওয়া হয়েছে জঙ্গিদের টার্গেট আর কেউ না কেবল ব্লগার গোষ্ঠী, যারা দেশের যুদ্ধাপরাধের বিচার ইস্যুতেও সোচ্চার। একের পর এক হত্যা করা হয় মুক্তমনা লেখক অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান, অনন্ত বিজয় দাস ও ফয়সল আরেফিন দীপনকে।
আত্মস্বীকৃত হত্যাকারী ‘জঙ্গিগোষ্ঠী’ বরাবরই বলেছে, নাস্তিকতা এবং সেই ঘরানার লেখালেখি ও তা প্রকাশের জন্যই টার্গেট করা হয়েছিল তাদের।
অপরাধ বিশ্লেষকরা বলছেন, একের পর এক বিদেশি হত্যার পর এবার সমকামী আন্দোলন কর্মী হত্যা করাটা বুঝিয়ে দিচ্ছে কীভাবে জঙ্গিরা সব ধরনের গোষ্ঠী, যারাই তাদের (জঙ্গিদের) পছন্দের সমাজব্যবস্থার বিপরীতে কোনও কাজ করছেন তাদেরকেই হত্যা করা হচ্ছে এবং সেক্ষেত্রে আতঙ্ক সৃষ্টি করতে নৃশংতাকে হাতিয়ার করা হচ্ছে। এ ধরনের মুক্তবুদ্ধি যারা চর্চা করতে চান, তাদের প্রত্যেক জায়গা থেকেই আগামীতে টার্গেট খোঁজার পরিকল্পনা আছে কিনা সেটা এ মুহূর্তে তদন্তের দাবি রাখে।
আরও পড়ুন: ‘সিসিটিভির ফুটেজে ঘাতকরা’ (ভিডিও)
গণজাগরণমঞ্চের মুখপাত্র ইমরান এইচ সরকার বলেন, রাজিব হায়দারের হত্যাকাণ্ড আমাদর সবাইকে সাবধান করে দেওয়ার বার্তা নিয়ে এসেছিল। আমরা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবি থেকে ভয় পেয়ে সরে দাঁড়াতেই যেন সে চেষ্টা ছিল। এরপর আমরা দেখলাম, বর্তমান প্রজন্মের উজ্জ্বল ও সচেতন এই ব্লগার ছেলেমেয়েগুলোর ঐক্য ভাঙা দরকার, তারা হত্যা করে ভয় দেখাতে চাইলো। যখন তারা দেখল একের পর এক হত্যাকাণ্ডের কোনও বিচার হয় না বরং নানারকম বক্তৃতা দিয়ে বিষয়টি সরকারের নিয়ন্ত্রণে আছে বলে দাবি করা হয়। এখন জঙ্গিরা তাদের ভয় দেখানোর টার্গেটের পরিসর বাড়ালো।
তিনি আরও বলেন, যখন নাস্তিকের খুনের দায় সরকার নেবে না বলে জানিয়ে দেয়, তখন তারা বার্তা পায়- সমকামীদের খুনেও কিছু বলা হবে না। এই জাল থেকে বের না হলে আগামীতে ভয়াবহ পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে।
জাগৃতির প্রকাশক দীপন হত্যার পর থেকে যে হত্যাকাণ্ডগুলো ঘটছে সেখানে বিদেশি নাগরিক, ধর্মযাজক থেকে শুরু করে অনলাইন অ্যাক্টিভিস্ট যিনি ব্লগার নন এমন ব্যক্তিদের হত্যা করা হয়। কেন এই টার্গেট বাড়ানো হচ্ছে- প্রশ্নে অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, সমাজে ভয় ঠিকমতো ছড়িয়ে দিতে এবং তারা কোন সমাজ চান না সেসব নিয়ে সতর্ক করে দেওয়ার বার্তা দিতেই বেছে বেছে নাস্তিক, মুক্তমনা প্রকাশক, ব্লগার, ধর্মীয় গুরু, সাধু, শিক্ষক এবং এখন সমকামী অধিকার আন্দোলনের নেতা পর্যন্ত বাছাই করা হয়েছে। বোঝাই যাচ্ছে খুনিরা বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তারা এলোপাতাড়ি ব্যক্তি টার্গেট করছে বটে, কিন্তু গোষ্ঠী টার্গেটে তাদের সুনির্দিষ্ট বোঝাপড়া আছে বলেই মনে হচ্ছে।
এই নানা পেশাজীবী ও আন্দোলনকর্মীদের হত্যার ক্লু না পাওয়া এবং হত্যার ধরনে মিল থাকলেও কারণ উদঘাটন করতে না পারাটাকে হত্যাকারীদের কৌশল হিসেবে দেখতে চান অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের সভাপতি জিয়া রহমান। তিনি বলেন, কোনও সন্দেহ নেই শিক্ষক ব্লগার হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জঙ্গিরা জড়িত। খুনের মোটিভ হিসেবে সাধারণ বিচারে ভয়ের সংস্কৃতি তৈরির প্রচেষ্টা বলা হলেও রাজনৈতিক আরও নিবিড় কোনও উদ্দেশ্য কাজ করছে কিনা সেটা ভাবনায় আনতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক জিয়া রহমান বলেন, এখন যে পরিস্থিতি দাঁড়িয়েছে, সেখানে হত্যা টার্গেটে আর কোনও বাছবিচার নেই। শুরু থেকে এক ধরনের গোষ্ঠীকে টার্গেট মনে করা হলেও এখন সেটা অনেক বিস্তৃত হয়েছে এবং কেউই নিশানার বাইরে নয় বলে মনে হচ্ছে, যেটা কিনা জঙ্গিগোষ্ঠী আসলে চায়।
আরও পড়ুন: খুনিদের ব্যাগে ‘অপরিচিত’ আগ্নেয়াস্ত্র!
জিয়া রহমান পুরো বিষয়টাকে রাজনৈতিক ক্ষমতা প্রতিষ্ঠার লড়াই উল্লেখ করে বলেন, এর মূল জায়গা যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাধাগ্রস্ত করা। কনফ্লিক্ট অব ইন্টারেস্ট দেখা যায় যেখানে, সেখানে শত্রু-মিত্র চিহ্নিত থাকে কিন্তু এখানে কেবল সরকারকে অস্থিতিশীল করতে এলোমেলোভাবে টার্গেট করে হত্যা করা হচ্ছে, যাতে একইসঙ্গে মানুষ ভীত হয় এবং সরকার নড়বড়ে হয়।
ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইমস স্ট্র্যাটেজি ফোরামের সদস্য ওমর শেহাব বলেন, লেখক ও মানবাধিকার কর্মীদের হত্যাকে আর দশটি হত্যার সঙ্গে মিলিয়ে ফেললে হবে না। ঠিক যেমন আমরা ১৯৭১ সালের শহীদ বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডগুলোকে সাধারণ হত্যাকাণ্ড বলে মনে করি না। এগুলো হলো বিকৃত আদর্শ প্রসূত ঘৃণাসূচক হত্যাকাণ্ড।
এ মুহূর্তে করণীয় কী- প্রশ্নে তিনি বলেন, যারা এসব হত্যাকাণ্ড ঘটায় তারা এর মাধ্যমে গোটা জাতিকে এক ধরনের হুমকির বার্তা পৌঁছে দিতে চায়। তাহলে এই অপরাধকে আর দশটি অপরাধের মতো করে সামলালে তো হবে না। প্রথমত এর জন্য আলাদা প্রস্তুতি নিতে হবে। আমাদের কি যথেষ্ঠ পরিমাণ লোকবল আছে এ ধরনের ঝুঁকিপূর্ণ দলগুলোকে পর্যবেক্ষণে রাখার জন্য? যেসব হত্যাকাণ্ড ঘটেছে তাদের দ্রুত বিচার করার জন্য কি যথেষ্ঠসংখ্যক তদন্ত কর্মকর্তা আছে? যারা তদন্ত করছেন তাদের কাজের চাপ কি সহনীয় নাকি বেশি? কাজের চাপ বেশি হলে কাজের মান খারাপ হয়ে যাবে। যারা মামলাগুলো সাজাচ্ছেন তারা কি যত্ন করে কাজ করছেন? যে জামিনে বের হতে পারলে একই রকম হত্যাকাণ্ড আবার ঘটাবে, তাকে কারাগারে রাখার জন্য শুনানিতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে? আমার মনে হয় না এসব প্রশ্নের উত্তর আমরা সব জানি। যতটুকু জানি তাতে বোঝা যায়, এসব ক্ষেত্রে সরকারের প্রশাসনিক প্রস্তুতি ভালো নয়।
তিনি আরও বলেন, আপনি শুরুতে প্রশ্ন করেছেন, হঠাৎ করে কেন এ ধরনের হত্যাকাণ্ড বেড়ে গেল। দেশের প্রধানমন্ত্রী যদি দেশের ঘটে যাওয়া খুনের ব্যাপারে বলেন, উনি এর দায়িত্ব নিতে পারবেন না, তখন আসলে এরকম হত্যাকাণ্ড না বাড়ার কোনও কারণ নেই। জঙ্গিরাও জানে এখন আর প্রশাসনের ওপর এর সুরাহা করার কোনও চাপ নেই।
আরও পড়ুন: স্বজনদের মাথার ওপর পচে গেল বিমানবালার লাশ
/এপিএইচ/এজে/