মাত্র ৪৫০ টাকা খরচ করে দেশীয় পদ্ধতিতে মশাকে কৃত্রিমভাবে রক্ত পান করানো ‘আর্টিফিশিয়াল ফিডিং ডিভাইস’ তৈরি করেছেন কীটতত্ত্ববিদ ও ডেঙ্গু গবেষক ড. ইন্দ্রানী ধর। এই যন্ত্র দিয়ে মশাকে কৃত্রিমভাবে রক্তপান করিয়ে তার দেহে ভাইরাস আছে কিনা তা পরীক্ষা করা সম্ভব। পিএইচডি গবেষণার অংশ হিসেবে ২০১৭ সালে এই যন্ত্রটি তিনি তৈরি করার পর গবেষকরা দীর্ঘদিন ধরে যন্ত্রটি পরীক্ষা করে এর কার্যকারিতার প্রমাণ পেয়েছেন।
তার গবেষণা তত্ত্বাবধান করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল সায়েন্স বিভাগের ডিন ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল জাব্বার হাওলাদার,প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভায়োরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাইফ উল্লাহ মুন্সী।
ড. ইন্দ্রানী জানিয়েছেন,এই আর্টিফিশিয়াল ফিডিং ডিভাইসটির মাধ্যমে গবেষণার জন্য মশাকে কৃত্রিমভাবে রক্ত পান করানোর কাজে ব্যবহার তো করা যায়ই পাশাপাশি মশার মাধ্যমে সংক্রমিত ভাইরাস শনাক্ত করতে এটি ব্যবহার করা সম্ভব।তবে এটি নতুন কোনও যন্ত্র নয়। বিদেশে এমন যন্ত্র আগে থেকেই রয়েছে। তবে সেগুলো বেশ দামি। প্রতিটির দাম দুই থেকে তিন হাজার ডলার। কিন্তু, তিনি বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা পরিত্যক্ত সাধারণ জিনিস দিয়েই এই যন্ত্র তৈরি করেছেন। আর এতে তার খরচ পড়েছে মাত্র ৪৫০ টাকা।
গবেষক ড. ইন্দ্রানী ধর জানান, বাসায় ব্যবহার করা বোতল,পরিত্যক্ত স্যালাইনের নল ও মানুষের দেহের ত্বকের মতো আর্টিফিসিয়াল মেমব্রেন ব্যবহার করে এই যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে।
ইন্দ্রানী ধর বলেন,‘দেশে ডেঙ্গু পরিস্থিতি ভয়াবহ হতে পারে তা বোঝা গেছে ২০১৭ সালেই। আমার গবেষণায় তা বলা ছিল। ভবিষ্যৎ পরিস্থিতি সামাল দিতে বেশ কিছু সুপারিশও ছিল গবেষণায়। ওই সময় সংগৃহীত পূর্ণাঙ্গ এডিস মশা থেকে ডেঙ্গু ভাইরাস (DENV) সেরোটাইপ ১ ও ২ নির্ণয় করা হয়েছিল। আরও একটি ভাইরাসের সন্ধান আমাদের কাছে থাকলেও তখন সময়ের অভাবে তা শনাক্ত করা যায়নি।’
তিনি আরও বলেন,‘এই গবেষণার অংশ হিসেবে মশাকে কৃত্রিমভাবে রক্ত পান করানোর জন্য একটি ডিভাইস তৈরি করি। এই যন্ত্র তৈরি ও এটা কার্যকর কিনা তা পরীক্ষা করেছেন আমার গবেষণার সুপারভাইজার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল সায়েন্স বিভাগের ডিন, প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. আব্দুল জাব্বার হাওলাদার ও প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কবিরুল বাশার এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভায়োরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাইফ উল্লাহ মুন্সী স্যার। তারা পুরো বিষয়টি তত্ত্বাবধান করেছেন। এটি একটি টিমওয়ার্ক। তিন জন স্যারের তত্ত্বাবধানে আমি এটি করেছি ২০১৭ সালে।’
জানতে চাইলে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজিক্যাল সায়েন্স বিভাগের ডিন অধ্যাপক ড. আব্দুল জব্বার হাওলাদার বলেন, ‘‘আড়াই বছর ধরে পূর্ণাঙ্গ মাঠপর্যায়ের কাজ করা হয়েছে এডিস মশা নিয়ে। সংগৃহীত পূর্ণাঙ্গ এডিস মশা থেকে ডেঙ্গু ভাইরাস (DENV) সেরোটাইপ ১ ও ২ নির্ণয় করা হয়েছিল। ‘আর্টিফিসিয়াল ফিডিং ডিভাইস’ বাংলাদেশে প্রথম তৈরি করা হয়। বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের সঙ্গে যৌথভাবে এটি প্রমাণ করা হয়েছে এডিস মশাকে কৃত্রিমভাবে রক্ত খাইয়ে।’’
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভায়োরোলজি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. সাইফ উল্লাহ মুন্সী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন,‘মশাকে রক্ত খাইয়ে জীবাণু শনাক্ত করতে হয়। ডেঙ্গু বা চিকুনগুনিয়া ভাইরাস মানুষ ছাড়া অন্য কোনও প্রাণীর দেহে থাকে না। তাই যে মানুষের দেহে ভাইরাস আছে তার হাত বাড়িয়ে দিয়ে রক্ত খাইয়ে আমাদের পরীক্ষা করতে হয়। অথবা মশার মাথা ফুটো করে মাথার মধ্যে ভাইরাস ইমপুট করতে হয়,সেই মশা নিয়ে গবেষণা করতে হয়। এসব কারণে মশা নিয়ে গবেষণা করা কষ্টকর। সেই জন্যই বিশ্বজুড়ে মসকিউটো ফিডিং অ্যাপারেটাস দিয়ে মশাকে রক্ত খাওয়ানোর যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। সেটার দাম অনেক বেশি, ২ থেকে ৩ হাজার ডলার। বিদেশি দামি যন্ত্রে যা হয়,একই কাজ কীভাবে কম দামে বানানো যায় সে ভাবনা থেকেই এমন যন্ত্র তৈরি করা হয়েছে। আমাদের বাসাবাড়িতে ব্যবহার করা জিনিস দিয়ে খুব অল্প খরচে এটা তৈরি করা হয়েছে।’
অধ্যাপক ড. সাইফ উল্লাহ মুন্সী আরও বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে এটা পরীক্ষা করে আমরা দেখেছি। মশা ধরে সেই মশাকে সংগ্রহ করা রক্ত খাওয়ানো হয়েছে। রক্ত খাওয়ানো মশাগুলোকে ডিম পাড়ানোর ব্যবস্থা করানো হয়। এতে প্রমাণ হয়, রক্ত না খেলে মশা ডিম পাড়তে পারে না। সেই ডিম থেকেই লার্ভা হয়েছে। সেই লার্ভা থেকে মশা তৈরি করার পর এগুলো থেকে আমরা ভাইরাস শনাক্ত করেছি।’
ডেঙ্গু গবেষক ড. ইন্দ্রানী ধর বলেন,‘আমার পিএইচডি গবেষণার একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল সংগৃহীত মশাকে কৃত্রিমভাবে রক্ত পান করানো। তাই মশাকে কৃত্রিমভাবে রক্ত পান করানোর জন্য ‘আর্টিফিসিয়াল ব্লাড ফিডিং ডিভাইস’টি তৈরি করা হয়েছিল ২০১৭ সালে। এই ফিডিং ডিভাইসটির প্রধান দুটি অংশ হলো ‘ফিডিং কনটেইনার’ এবং ‘সাইফন’। আবার ফিডিং কনটেইনারটিতে মূলত রক্ত এবং উষ্ণ পানি সঞ্চালনের (সাইফন পদ্ধতিতে) দুটি চেম্বারের ব্যবস্থা ছিল। সংগৃহীত মশাকে খাওয়ানোর জন্য রক্তের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড মানব দেহের তাপমাত্রার সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে সাইফন পদ্ধতির মাধ্যমে উষ্ণ পানি সঞ্চালন করা হয়। ডিভাইসটি ঘরে ও ল্যাবরেটরিতে ব্যবহার করা সাধারণ জিনিস দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। মানুষের শরীরের তাপমাত্রা ৩৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বজায় রেখে, মানুষের দেহের ত্বকের মতো আর্টিফিসিয়াল মেমব্রেন ব্যবহার করে এডিস মশাকে রক্ত পান করানো হয়। এ ডিভাইসটির মাধ্যমে মশাবাহিত যে কোনও জীবাণু রক্তের সঙ্গে মিশিয়ে মশাকে সংক্রমিত করা সম্ভব। এমনকি মশাবাহিত রোগ নিয়ন্ত্রণের জন্য জৈবিক দমনে ডিভাইসটি ব্যবহার করা সম্ভব।’
ড. ইন্দ্রানী ধর ২০০০ সালে ‘এনটোমোলজিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট সার্ভে অন ডেঙ্গু আউটব্রেক ইন ঢাকা সিটি’ (Entomological Assessment Survey on Dengue Outbreak in Dhaka city)-তে সহায়ক কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে গবেষণা ল্যাবে কাজ করেছেন। ওই সময় গবেষণা কার্যক্রমটি ঢাকা সিটি করপোরেশন ও আইসিডিডিআর-বি যৌথভাবে পরিচালনা করে। আইসিডিডিআর-বি পরিচালিত ‘অ্যানাটোমোলজিক্যাল অ্যাসেসমেন্ট অন ডেঙ্গু রেসপন্স প্রোগ্রাম’ -এ কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে গবেষণা কাজ করেন। ঢাকা সিটি করপোরেশন পরিচালিত এডিস ও কিউলেক্স মশা বিষয়ক জরিপ প্রকল্পেও কীটতত্ত্ববিদ হিসেবে ২০০১-২০০২ পর্যন্ত কাজ করেন তিনি। সিনিয়র রিসার্চ অ্যাসিসট্যান্ট হিসেবে ডেঙ্গু, ম্যালেরিয়ার ওপর ২০০৩ সালের জুন থেকে ২০০৫ সাল পর্যন্ত আইসিডিডিআর-বি’তে এপিডেমোলজি ল্যাব-এ কাজ করেন ড. ইন্দ্রানী।
২০০৫ সালের ২ জুলাইয়ে সিলেটের এমসি কলেজে প্রভাষক হিসেবে সরকারি চাকরিতে যোগ দেওয়া এই গবেষক বর্তমানে কারিগরি শিক্ষা বোর্ডের উপ-পরিদর্শক হিসেবে কর্মরত আছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ১৯৬৪ সালের ‘ঢাকা ফিভার’ দিয়েই শুরু হয় ভাইরাস ঘটিত ডেঙ্গু জ্বর। তবে ২০০০ সালে বাংলাদেশে প্রথম ডেঙ্গু জ্বরের মহামারি হয়। সেই বছর ৯৩ জনের মৃত্যু এবং তার পরের বছরগুলোতে থেমে থেমে জ্বরের প্রকোপসহ মৃতের সংখ্যা কমবেশি হয়। পরিস্থিতিও সহনশীল ছিল। তবে ২০১৯ সালে ডেঙ্গু পরিস্থিতি নিয়ে উৎকণ্ঠা দেখা দেয়।