রাজধানীর মিরপুরের কচুক্ষেত এলাকায় রাঙাপরী জুয়েলার্সের দোকানে চুরির ঘটনায় স্বর্ণ চুরি, পরিকল্পনা এবং কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত ৭ জনের তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা পুলিশ। এসব তথ্য খতিয়ে দেখে তাদের অবস্থান শনাক্ত করে আইনানুগ ব্যবস্থা এবং গ্রেফতারি কার্যক্রমের বিষয়ে অভিযান পরিচালিত হচ্ছে। এ চক্রের সদস্যরা শুধু স্বর্ণ চুরি করতো। টার্গেট থাকতো বড় কিংবা ছোট স্বর্ণের দোকান।
বিভিন্ন সিকিউরিটি এজেন্সিতে মিথ্যা তথ্য দিয়ে চাকরি নিয়ে একপর্যায়ে চুরি করে চম্পট দিতো। মিরপুর গোয়েন্দা পুলিশের অভিযানে এ ঘটনায় সংশ্লিষ্ট শামীম হোসেন নামে একজনকে গ্রেফতার করা হয়। তার কাছ থেকে বেশ কিছু তথ্য পাওয়া গেছে।
গত ৫ ফেব্রুয়ারি রাঙাপরী জুয়েলার্সে ৩০০ ভরি স্বর্ণ চুরি হয়। এসময় ২০ লাখ নগদ টাকাও নিয়ে যায় চোরচক্র। এসবের মধ্যে গ্রেফতারের সময় শামীমের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৯ লাখ টাকা মূল্যের স্বর্ণ। চুরি করা স্বর্ণ বিক্রি ও লেনদেনের বিষয়েও চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছে গোয়েন্দা কর্মকর্তারা।
গোয়েন্দা পুলিশ জানতে পারে, বিদেশ থেকে স্বর্ণ চুরির পরিকল্পনা করা হয়, আর সেই পরিকল্পনা অনুযায়ী দেশে ছক এঁকে বাস্তবায়ন করা হয়। পরিকল্পনা থেকে ছক আঁকা—সবই বিদেশ থেকে নাসির করে দিতো। সম্পর্কে বোন জামাই নাসিরের সঙ্গে ২০ বছর আগে চুরি করতে গিয়ে গড়া সম্পর্ক এখনও অটুট শামীমের। সেই নাসির হোসাইন বর্তমানে ফ্রান্সে অবস্থান করছে। ডিভোর্স হয়ে যাবার পরও বোনের প্রাক্তন স্বামীর সঙ্গে দেশে বসে স্বর্ণ চুরির পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করছে। এর আগেও রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় স্বর্ণ চুরির মতো ঘটনা ঘটিয়েছে এই চোর চক্র। রাজধানীর মিরপুরের কচুক্ষেত এলাকায় রজনীগন্ধা কমপ্লেক্সে রাঙাপরী স্বর্ণের দোকানে চুরির ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের হাতে আসে এসব তথ্য।
গোয়েন্দারা বলছেন, ফ্রান্সে অবস্থান করা নাসির তার পরিকল্পনা অনুযায়ী রাজধানীর মিরপুরের কাফরুলে বেস্ট সিকিউরিটি অ্যান্ড লজিস্টিক লিমিটেডের সিকিউরিটি এজেন্সিতে কাজে যোগদানের কথা বলে শামীম হোসেনকে। শামীম হোসেনসহ আরও দুজন তাদের পরিচয়পত্র এবং চেয়ারম্যানের সার্টিফিকেট, ভোটার আইডি কার্ড জাল করে সেই সিকিউরিটি এজেন্সিতে চাকরি নেয়। পরবর্তী সময়ে পরিকল্পনা অনুযায়ী কিভাবে কি করতে হবে এ বিষয়ের ছক এঁকে দেয় নাসির। এমনকি স্বর্ণ চুরির আগে যেসব খরচ হতো সেসব খরচের টাকাও ফ্রান্স থেকে পাঠাতো নাসির। বিদেশে অবস্থান করা নাছিরের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা রয়েছে। বেশ কয়েকটি চুরির মামলা রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এক সময় পটুয়াখালী এবং রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় চুরি করতো। চার বছর আগে ফ্রান্সে পাড়ি দিয়ে সেখানে অবস্থান করে পরিবারের অন্যান্য সদস্যদের মাধ্যমে চুরির ঘটনা ঘটিয়ে যাচ্ছে সে। মূলত বিভিন্ন সিকিউরিটি এজেন্সিতে ভুল তথ্য দিয়ে চাকরিতে প্রবেশের পরে স্বর্ণ চুরির ঘটনা ঘটিয়ে লুকিয়ে পড়ে চক্রটি। এর আগেও এই চক্রটি রাজধানীসহ বিভিন্ন জায়গায় চুরির ঘটনা ঘটিয়েছে।
দায়িত্বশীল এক কর্মকর্তা বলছেন, বিশেষ করে স্বর্ণের দোকানগুলোকে টার্গেট করে চুরি করতো এ চক্রের সদস্যরা। স্বর্ণ ছাড়া অন্য কোনও বিষয়ের দিকে তাদের তেমন কোন নজর ছিল না। চুরি করা স্বর্ণ পুরান ঢাকার বেশ কয়েকটি দোকানে বিক্রি করতো। রাঙাপরী জুয়েলার্স থেকে চুরি করা প্রায় ৩০০ ভরি স্বর্ণ পুরান ঢাকার বেশ কয়েকজন স্বর্ণ ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করেছে। এখন পর্যন্ত স্বর্ণগুলো উদ্ধারে কাজ চলছে। চোরাই স্বর্ণ কেনার সঙ্গে জড়িত কয়েকজন ব্যবসায়ীর নাম পাওয়া গেছে। সে অনুযায়ী তাদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় নিয়ে আসা হবে।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন সফটওয়্যার ব্যবহার করে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখতো শামীম ও নাসির। এছাড়াও তাদের পরিবারের আরও কয়েকজন এই চুরির ঘটনার সঙ্গে জড়িত। রাঙাপরী জুয়েলার্সে সিসিটিভি থাকায় ঘটনার পর চুরির সঙ্গে সম্পৃক্ত চারজনের ছবি পাওয়া যায়। তবে তাদের সঠিক পরিচয় এবং ঠিকানা না জানার কারণে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে। এ ঘটনার দায় সিকিউরিটি এজেন্সিও এড়াতে পারে না। সিকিউরিটি এজেন্সির গাফিলতি রয়েছে তথ্য যাচাইয়ের ক্ষেত্রে।
এদিকে ঘটনার এক মাসের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও চুরি যাওয়া কোন স্বর্ণ ফিরে পায়নি রাঙাপরী জুয়েলার্সের মালিক আবুল কালাম ভূঁইয়া। হতাশা নিয়ে তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমার তো সবকিছুই শেষ। এখন কয়েক জনের কাছ থেকে ধার করে টাকা এনে দোকানে স্বর্ণালঙ্কার উঠিয়েছি। এতকিছুর পরেও চুরি যাওয়া স্বর্ণ পাব কিনা এই শঙ্কা থেকেই যাচ্ছে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর গোয়েন্দা বিভাগের উপ-কমিশনার মানস কুমার পোদ্দার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সিসিটিভির ফুটেজ থাকার পরও তাদের পরিচয় শনাক্ত না হওয়ার কারণে তাদেরকে এখনও গ্রেফতার করা সম্ভব হচ্ছে না। কিছুটা সময় লাগছে। তবে আমরা আমাদের অভিযান অব্যাহত রেখেছি। বেশ কিছু চাঞ্চল্যকর এবং সুনির্দিষ্ট তথ্যের ভিত্তিতে আমরা অভিযান পরিচালনা করছি। অচিরেই এ বিষয়ে আপনাদের সঠিক তথ্য জানাতে পারবো। চুরি করা স্বর্ণগুলো তারা কোথায় বিক্রি করেছে এ বিষয়ে আমরা তথ্য পেয়েছি। সে অনুযায়ী আমরা অভিযান পরিচালনা করছি।
ডিএমপি’র মিরপুর গোয়েন্দা বিভাগের অতিরিক্ত উপ-কমিশনার সাইফুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রাজধানীর কচুক্ষেতে রাঙাপরী জুয়েলার্সের স্বর্ণ চুরির ঘটনায় সাতজনকে শনাক্ত করেছি। জিজ্ঞাসাবাদে শামীমের কাছ থেকেও আরও চাঞ্চল্যকর তথ্য পেয়েছি। ৭ জনকে শনাক্ত করার পাশাপাশি অবস্থান নিশ্চিত করে তাদেরকে অচিরেই গ্রেফতার করা হবে।