সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮ এর ৪০(৩) ধারায় বলা আছে, কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত কারিগরি বিনির্দেশের (টেকনিক্যাল স্পেসিফিকেশন) ব্যত্যয় ঘটিয়ে কোনও মোটরযানের দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, উচ্চতা, আসন বিন্যাস ইত্যাদি পরিবর্তন করা যাবে না। এছাড়া জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের ২৬তম সভার সুপারিশে বলা আছে, যাত্রীবাহী বাসের প্রস্তুতকারক প্রতিষ্ঠান বা কর্তৃপক্ষ নির্ধারিত আসনের চেয়ে এর সংখ্যা বাড়ানো যাবে না।এছাড়া দুই সিটের মাঝের দূরত্ব ন্যূনতম ২৬ ইঞ্চি হতে হবে এবং গাড়ির বডির সঙ্গে সিটের সংযোগ বা ওয়েল্ডিং ভালোভাবে করতে হবে।
কারণ হিসেবে বলা আছে, বাসের আসন সংখ্যা বাড়িয়ে বেশি যাত্রী পরিবহন করার কারণে প্রতিটি আসনের মাঝে পা রাখার জায়গা বা ফাঁকা স্থান কমে যায়। কোনও দুর্ঘটনায় যাত্রীরা সিটের মধ্যে প্রচণ্ড মাত্রায় চেপে যায় এবং হতাহতের সংখ্যাও এ কারণে বেশি হয়। আবার বাসের পাটাতনের সঙ্গে সিটগুলো স্ক্রু দিয়ে হালকাভাবে লাগানো থাকে বা ওয়েল্ডিং করলেও তা অল্পকিছু অংশ করা হয়। এর ফলে কোনও সংঘর্ষে এই সিটগুলো উঠে চলে আসে এবং যাত্রীদের আহত করে।
সরেজমিনে দেখা যায়, সড়ক পরিবহন আইন ও জাতীয় সড়ক নিরাপত্তা কাউন্সিলের সুপারিশ অমান্য করে রাজধানীতে চলাচলকারী প্রায় প্রতিটি বাসেই আসন বাড়িয়ে ফাঁকা জায়গা কমিয়ে বহাল তবিয়তে চলছে।যাত্রীদের অভিযোগ, দুই আসনের দূরত্ব ২৬ ইঞ্চি কমিয়ে ইচ্ছেমতো আসন বসিয়েছে মালিকরা। যার কারণে আসনে বসতে ও বের হতে সমস্যা হয় যাত্রীদের। কিন্তু কোনও ব্যবস্থা নিতে দেখা যায় না কোনও কর্তৃপক্ষকে।
রাজধানীতে চলাচলকারী রাঈদা পরিবহন, ভিক্টর পরিবহন, সাভার পরিবহন, শিকড় পরিবহন, তুরাগ পরিবহন, বৈশাখী পরিবহন, অছিম পরিবহনসহ প্রায় প্রত্যেকটি পরিবহনের বিরুদ্ধে কারিগরি নির্দেশনা পরিবর্তন করে আসন বাড়ানোর অভিযোগ রয়েছে।
গত ১৪ অক্টোবর সরেজমিনে ঘুরে দেখা যায়, নতুন বাজার থেকে আজিমপুরগামী দেওয়ান পরিবহনের বাসে আসন বাড়ানো হয়েছে। গাড়িটির নম্বর ঢাকা মেট্রো- ব১৫-৪০৮৮। গাড়িটিতে উঠে দেখা যায় এটিতে ৪৫টি আসন রয়েছে। বাসের ইঞ্জিনের ওপর তিন জনের আসন দেওয়া হয়েছে যা একেবারে অবৈধ ও যাত্রীর স্বাস্থ্যের জন্য হানিকর।
এছাড়াও কুড়িল থেকে আজিমপুরগামী আইসার ব্রান্ডের স্মার্ট উইনার বাসে উঠেও একই চিত্র পাওয়া যায়। এটাতে ৪১টি আসন দেখা যায়। বাসটির নম্বর ঢাকা মেট্রো ব১৩-১৩৯০। বাসটির ইঞ্জিন ও ব্যাটারির ওপর যাত্রীর জন্য আসন পাতা হয়েছে। আসনে ঢুকে বসতে আর বের হতে সমস্যা হচ্ছিল যাত্রীদের। এসময় চালকের সহকারীকে বিষয়টি জিজ্ঞেস করা হলে তিনি জানান, এটা মালিক লাগিয়েছেন। তাদের কিছুই করার নেই।
এ বাসের যাত্রী রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা কী বলবো বলার ভাষা নেই। মালিকরা মুনাফার লোভে এতগুলো আসন বসিয়েছে। আমাদের বসতে ও পা রাখতে কষ্ট হচ্ছে। দুই আসনের মাঝের জায়গা নিয়েই তারা ব্যবসা করে। আর দাঁড় করিয়ে তো যাত্রী নেয়ই। তিনি বিষয়টি দেখভালের দায়িত্বে থাকা সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন তোলেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বাস মালিক জানিয়েছেন, আইসার ব্রান্ডের বাসগুলো সাধারণত ৩৫ আসনের। কিছু বাস মালিক মুনাফার লোভে আসন বাড়ায়। ঢাকা চলাচলকারী সবগুলো বাসই মোটামুটি ৩৫ ও ৩৯ আসনের, আর বড় কিছু আছে ৫০ আসনের। ঢাকায় প্রায় সব বাসেই এ অনিয়ম পাবেন। বিআরটিএ-ও জানে, পুলিশ জানে। টাকা থাকলে সবই মিটমাট হয়।
তিনি আরও বলেন, আইনানুযায়ী বাস তো অনেক বার বিআরটিতে নিতে হয়। যেমন রেজিস্ট্রেশনের সময়, মালিকানা পরিবর্তনের সময় ও ফিটনেস সনদ নেওয়ার সময়। কিছু মালিক এসময় আসনগুলো খুলে রাখে এসময়। কেউ রাখেও না। টাকায় তো সব হয়।
জানতে চাইলে, বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েতুল্লাহ বলেন, আমরা আমাদের মালিকদের অনেকবার বলেছি এ অসুবিধা সৃষ্টি না করার জন্য। চিঠিও দিয়েছি। কেউ শোনে না। বিআরটিএ'র ম্যাজিস্ট্রেট আছে। তারা জরিমানা করে দিক। আমাদের কোনও আপত্তি নাই।
এবিষয়ে জিজ্ঞেস করা হলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের চেয়ারম্যান নুর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, আমাদের ম্যাজিস্ট্রেট মাঝেমধ্যেই এ ধরনের বাসের মালিকদের জরিমানা করে। আমাদের কর্মকর্তারা এ ধরনের ত্রুটি যুক্ত গাড়িকে ফিটনেস সনদ দেন না। আমি নিজে হঠাৎ পরিদর্শন করে দেখেছি, আমাদের কর্মকর্তারা ৩০-৪০টি গাড়িকে ফিটনেস সনদ দিচ্ছে না। এছাড়া আমরা এ ধরনের ত্রুটিমুক্ত করার জন্য আমরা পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, যাত্রী সাধারলকেও এ ব্যাপারে সচেতন হতে হবে। একটা বাস দেখলেই বোঝা যায় আসন বাড়ানো হয়েছে কিনা। তারা অনেক সময় বাসের সহকারীর সঙ্গে তর্ক করে চলে যায়। আমাদের কাছে অভিযোগ দেয় না। তারা চাইলে আমাদের হটলাইন নাম্বারে কল দিতে পারে।
ছবি: নাসিরুল ইসলাম।