বায়ুদূষণের শহরভিত্তিক তালিকায় বিশ্বে শীর্ষেই অবস্থান করছে ঢাকা। প্রতি বছর শুষ্ক মৌসুমে এই দূষণের মাত্রা আরও বাড়ে। সম্প্রতি নতুন করে আবারও যুক্ত হয়েছে যানবাহনের কালো ধোঁয়া। একসময় নানান উদ্যোগে প্রায় বন্ধ হয়ে আসা পরিবহনের এই কালো ধোঁয়ার মাত্রা সম্প্রতি বেড়েছে। এই কালো ধোঁয়ার কারণে বায়ুদূষণ আরও বৃদ্ধি পাবে বলে শঙ্কার কথা জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, কালো ধোঁয়া থেকে যেসব রাসায়নিক পদার্থ বাতাসে মিশে যায়, তা মানবদেহের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সরকার দূষণ নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নানা উদ্যোগের কথা বললেও কালো ধোঁয়া ‘নতুন উপদ্রব’ হিসেবে আবারও সামনে উঠে আসছে।
রবিবার (১৬ অক্টোবর) মিরপুরের দিক থেকে আসা শিকড় পরিবহনের একটি বাস কালো ধোঁয়া ছাড়তে-ছাড়তে কারওয়ান বাজারের সার্ক ফোয়ারা সিগনালে এসে দাঁড়ায়। সিগনাল ছাড়লে একইভাবে বায়ুদূষণ করতে করতে শাহবাগের দিকে ছুটে গেলো গাড়িটি। মাত্রাতিরিক্ত কালো ধোঁয়া থেকে নিজেদের রক্ষা করতে অন্যান্য পরিবহনের যাত্রী এবং আশপাশের পথচারীরা নাকে হাত বা কাপড় চেপে ধরে রাখলেন বেশ কিছুক্ষণ।
এর ঘণ্টাখানেক পরেই রামপুরা ব্রিজের ওপর আব্দুল্লাহপুর থেকে সদরঘাট রুটে চলাচল করা ভিক্টর ক্লাসিকের একটি বাসও একইভাবে ছুটতে দেখা যায়। একটি-দুইটি নয়, প্রতিনিয়ত হরহামেশাই দেখা যাচ্ছে রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে। একই দৃশ্য দেখা গেছে রাজধানীর কাকরাইল ও প্রেসক্লাব এলাকাতেও।
প্রতিবছরই শীতের শুষ্ক মৌসুমে এমনিতেই বাতাসে দূষণের মাত্রা বেড়ে যায়। এর ওপর হঠাৎ রাজধানীতে কালো ধোঁয়া কীভাবে এলো, সেই খোঁজ নিতেই গত দুই দিন ঢাকার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি সড়ক ঘুরে প্রায়শই এমন দৃশ্য দেখা যায়। সরেজমিন পর্যবেক্ষণ বলছে, কালো ধোঁয়া নির্গমনের ক্ষেত্রে যানবাহনগুলোর মধ্যে সবার শীর্ষে রয়েছে গণপরিবহন-বাস। ফিটনেসবিহীন ও পুরোনো লক্কড়ঝক্কড় গাড়িগুলো এক্ষেত্রে সবচাইতে এগিয়ে। এই তালিকায় বাসের পরে রয়েছে যথাক্রমে বিভিন্ন কোম্পানি ও প্রতিষ্ঠানের মাইক্রোবাস, প্রাইভেটকার, লেগুনা, ব্যক্তিগত গাড়ি ও মোটরসাইকেল।
পরিবহন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, যেসব কারণে যানবাহন থেকে কালো ধোঁয়া ছড়াচ্ছে, তার মধ্যে রয়েছে- গাড়ির ইঞ্জিন পুরনো হয়ে যাওয়া, ইঞ্জিনের সক্ষমতা কমে যাওয়া, যান্ত্রিক ত্রুটি, নির্দিষ্ট সময় পর পর গাড়ির ইঞ্জিন ওয়েল পরিবর্তন না করা এবং ফিটনেসবিহীন গাড়ি চালানো। এসবের জন্য মূলত যানবাহনের মালিক ও চালকরা দায়ী। তবে এ নিয়ে জানতে চাইলে এক পক্ষ অন্য পক্ষের ওপর দায় চাপানোর চেষ্টা করছেন।
শনিবার (১৫ অক্টোবর) রাসেল স্কয়ারের সিগনালে থাকা বিকাশ পরিবহনের একটি বাস কালো ধোঁয়া বেরোচ্ছিল। এ সময় চালককে জিজ্ঞাসা করলে নিজের নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, পুরনো গাড়ি কিনে ভালো বডি বসিয়ে, রঙ করে রাস্তায় নামিয়েছেন মালিক। পুরনো ইঞ্জিন কালো ধোঁয়া তো ছাড়বেই। সেটা দেখার দায়িত্বতো আমার না, গাড়ি চালানোই আমার কাজ।’
রবিবার (১৬ অক্টোবর) ভিক্টর ক্লাসিক পরিবহনের একটি বাসের মালিক মো. ইকরাম বলছেন, ‘ইঞ্জিন নতুন হলেও সময়মতো ইঞ্জিন পাল্টানো হয় না। এ কারণে গাড়ি থেকে কালো ধোঁয়া বের হয়। এ জন্যতো মালিকরা দায়ী নন, চালক-শ্রমিকরাই দায়ী। আবার এর বিপরীত চিত্রও দেখা যায়। সোজা কথায় বললে- গাড়ি বা ইঞ্জিনের দিকটির জন্য মালিক পক্ষ আর এর পরিচালন বা ব্যবহারের দিকটির জন্য চালক-শ্রমিকরা দায়ী।’
বিভিন্ন কারণে দূষিত এই মেগা সিটিতে যানবাহনের কালো ধোঁয়া যে কতটা প্রভাব পড়ছে নগরবাসীর জনজীবনে, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। রাসেল স্কয়ারে বাসের জন্য অপেক্ষমাণ শেখ শহিদুল ইসলাম নামের একজন মধ্য বয়স্ক ব্যক্তি বলছিলেন, ‘মুখে মাস্ক থাকার পরেও প্রায়শই কালো ধোঁয়া থেকে রক্ষা মিলছে না। যাদের মুখে মাস্ক নাই, তারা তো হাত বা কাপড় দিয়ে নাক চেপে রাখছেন।’
যানবাহনের কালো ধোঁয়া নিয়ে সরকারের তরফে ১৯৮৩ সালের একটি মোটরযান অধ্যাদেশ রয়েছে। তাতে স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক ধোঁয়া নির্গমন করাকে ‘শাস্তিযোগ্য অপরাধ’ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এ জন্য ২০০ টাকা জরিমানাসহ শাস্তির বিধানও আছে। কিন্তু এর প্রয়োগ করা হচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মো. মোজাম্মেল হক চৌধুরী। তিনি বলেন, ‘শাস্তি হলে পরিস্থিতির উন্নতি হতো। তবে পরিবহন মালিক ও শ্রমিকদের এ ক্ষেত্রে সচেতন হওযাটা বেশি জরুরি।’
এদিকে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ‘ফিটনেসবিহীন গাড়িই মূলত কালো ধোঁয়া ছড়ানোর প্রধানতম উৎস। এসব গাড়ির ইঞ্জিন পুরনো হওয়ায় জ্বালানি সম্পূর্ণভাবে পুড়তে পারে না। তখন সেই তেল কালো ধোঁয়ার আকারে বের হয়ে আসে। ফিটনেস যুক্ত গাড়িতে উল্টোটি হয়, তেল সম্পূর্ণভাবে পুড়ে যায়, ফলে কালো ধোঁয়া বের হয় না।’
এই কালো ধোঁয়ায় কী কী ধরনের উপাদান আছে জানতে চাইলে বায়ু দূষণ বিশেষজ্ঞ মো. কামরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কালো ধোঁয়ার মধ্যে থাকে কার্বন মনোক্সাইড, ব্ল্যাক কার্বন, সালফার ডাই অক্সাইড, নাইট্রোজেন ডাই অক্সাইড প্রভৃতি। আবার কালো ধোয়া নির্গতের সময় ধূলিকনাও চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। এসব পদার্থ বাতাসে ছড়িয়ে পড়ার কারণে বাতাসে দূষণ বেড়ে যাচ্ছে। যা মানুষের জন্য ভীষণ ক্ষতিকর।’
তিনি আরও বলেন, ‘চলতি মাসের শেষ দিক থেকে শীত মৌসুমের দেখা পাবো আমরা। এ সময় আবহাওয়া এমনিতেই শুষ্ক থাকে। ফলে বাতাসের দূষণের মাত্রা এমনিতেই বেড়ে যায়। এই অবস্থায় গাড়ির এই কালো ধোঁয়া দূষণের নতুন মাত্রা যোগ করতে পারে।’
তিনি বলেন, ‘প্রতিবছর এই শুষ্ক মৌসুমের সময় আমরা নানা উদ্যোগের কথা সরকারকে বলে থাকি। কিন্তু বাস্তবে তার কিছুই বাস্তবায়ন হয় না। ফলে দূষণের মাত্রা কমার বদলে দিন দিন তা বেড়েই চলেছে।’
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, গত সপ্তাহে রাজধানীসহ বিভিন্ন এলাকায় বৃষ্টি হওয়া দূষণের মাত্রা কম ছিল। তবে চলতি সপ্তাহে বৃষ্টি না হওয়ায় এই মাত্রা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে দুপুরের দিকে প্রায়ই মাত্রার দিক থেকে বিশ্বের শীর্ষ অবস্থানে থাকা শহরগুলোর তালিকায় প্রায়ই জায়গা করে নিচ্ছে ঢাকা।’