সকালে হালকা কুয়াশা আর শেষ রাতে হালকা ঠান্ডা মনে করিয়ে দিচ্ছে শীতের আগমনী বার্তা। চলতি অক্টোবর থেকে রাজধানীর পাইকারি ব্যবসায়ীরা শীতবস্ত্র দিয়ে দোকান ও গুদামঘর ভর্তি করেছেন। তবে এখনও শীত না আসা, দেশের রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা, বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতাসহ নানামুখী আশঙ্কায় এ বছর ব্যবসা নিয়ে চিন্তিত ব্যবসায়ীরা।
সরেজমিনে রাজধানীর বঙ্গবাজার, সিটি প্লাজা, জাকির প্লাজা, নগর প্লাজা, ঢাকা ট্রেড সেন্টার, গুলশান ট্রেড সেন্টারে শীতবস্ত্রের পাইকারি দোকানগুলোয় দেখা যায়, লট লট কাপড় নিয়ে দোকান ভর্তি করলেও ক্রেতাদের তেমন আনাগোনা নেই। ক্রেতার অপেক্ষায় অনেকটা অলস সময় পার করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা প্রহর গুনছেন শীতের প্রকোপ বাড়ার।
ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শীতবস্ত্র নিয়ে প্রস্তুত থাকলেও এ বছর ক্রেতার দেখা পাচ্ছেন না তারা। সাধারণত শীত আসার আগ মুহূর্তে পণ্য তোলেন তারা, এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি। তবে আগে অক্টোবরের শেষ সপ্তাহে সারা দেশ থেকে আঞ্চলিক পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা ভিড় জমালেও এবার ক্রেতার অপেক্ষায় বসে আছেন তারা। শীত দেরিতে এলেও এর ব্যত্যয় হতো না। আগেভাগে পণ্য নিয়ে প্রস্তুত হতেন খুচরা দোকানিরা, অনেকে চাহিদাপত্র অথবা কুরিয়ারে টাকা পাঠিয়ে পণ্য নিতেন। কিন্তু নভেম্বর শুরু হলেও এখনও ক্রেতার উপস্থিতি নেই।
এ অবস্থার জন্য দেশে চলমান অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিকে দায়ী করছেন ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন, এ বছর শীত যদি আরও দেরিতে আসে, তাহলে লোকসানের মুখে পড়বেন সিংহভাগ ব্যবসায়ী।
রাজধানীর বঙ্গবাজার মার্কেটের আল মদিনা গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী মহাসিন মিয়া বলেন, ‘আগে নভেম্বরের শুরুতে মার্টেকে পা ফেলানোর জায়গা থাকতো না মফস্বল থেকে আসা পাইকারি আর খুচরা ব্যবসায়ীদের জন্য। আমাদেরও দম ফেলার সময় থাকতো না। এখন সারা দিন বসে আছি। জিনিসপত্রের দাম বাড়ছে। স্বাভাবিকভাবে সবার হাত খালি। মাল কীভাবে কিনবে? শীত একটু বাড়লে খদ্দের আসা শুরু হবে বলে আশা করছি।’
একই মার্কেটের নাহার গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী মো. ইউসুব আলী বলেন, ‘২২ বছর ধরে ব্যবসা করি। এমন খারাপ অবস্থা দেখিনি কখনও। গত বছরও ১০ জন কর্মচারী রেখেও মাল দিয়ে কুলাতে পারিনি। খাওয়া-নামাজের কোনও সময় ছিল না। শীত আসার আগেই দেশের ৬৪ জেলা থেকে লোক আসতো, আগেভাগে পণ্য নিয়ে তৈরি থাকতে হতো। এবার চার কর্মচারী নিয়ে বসে আছি। আজ সারা দিনে একজন কাস্টমার মাল দেখতেও আসেনি। আশা করছি শীত একটু বাড়লে বেচাকেনা বাড়বে। তাতেও লাভের মুখ কতটা দেখতে পারবো জানি না।’
অর্থনৈতিক অস্থিতিশীলতা
ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের ফলে অস্থিতিশীল বিশ্ব অর্থনীতি, যার প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশেও। ব্যবসায়ীরা বলছেন, ‘দেশে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে সাধারণ মানুষও বাধ্য হয়ে কমিয়েছে খরচ। ফলে মফস্বলের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদেরও টান পড়েছে পুঁজিতে। তাই মাল তুলে প্রস্তুত থাকলেও ক্রেতার দেখা পাচ্ছেন না রাজধানীর পাইকারী ব্যবসায়ীরা।’
দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির ফলে দাম বেড়েছে দেশীয় ও আমদানি করা শীতবস্ত্রের। পণ্যভেদে গত বছরের তুলনায় এবার খরচ বেড়েছে ৪০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত। এ ছাড়া তেলের দাম বাড়ায় পরিবহন খরচ বেড়েছে। এ কারণে পণ্য কিনতে শীত বাড়ার অপেক্ষা করছেন মফস্বলের পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীরা।’
সিটি প্লাজার পাইকারি ব্যবসায়ী সুজন হাসান বলেন, ‘যেকোনও বয়সীর শীতবস্ত্রের দাম বেড়েছে। সাধারণত শিশুদের পণ্যগুলো চায়না থেকে আমদানি করা হয়। আমরা আমদানিকারক থেকে এবার ১৫০ থেকে ৩০০ টাকা বেশি দিয়ে পণ্য কিনেছি। দেশে উৎপাদিত শীতের কাপড়গুলোও ৪০ থেকে ১৫০ টাকা বেড়েছে। একলাফে এত দাম বেড়ে যাওয়ায় আমাদেরও মুনাফা কম করতে হচ্ছে।’
জাকির প্লাজার ব্যবসায়ী শরিফুল হাসান বলেন, ‘দ্রব্যমূল্যের দাম বেড়েছে, পরিবহন খরচ বেড়েছে, মফস্বলের পাইকারি-খুচরা ব্যবসায়ীরা তাই ঢাকায় আসছেন না। তারাও শীত বাড়ার অপেক্ষা করছেন। এখন মাল তুলে যদি বিক্রি না হয়, বিপদে পড়বেন। সবারই পুঁজির সংকট।’
করোনার প্রভাব
ব্যবসায়ীরা বলছেন, করোনাকালীন ঘাটতি এখনও পিছু ছাড়েনি তাদের। ব্যবসা না থাকলেও করোনার আগে নেওয়া ব্যাংক ঋণ ও কিস্তি টানতে হচ্ছে তাদের। যেসব ব্যবসায়ী ঋণ শোধ করতে পারেননি, তারা নতুন করে ব্যবসায় লগ্নি করতে পারেননি। এ ছাড়া ব্যবসার পরিস্থিতি ভালো না হওয়ায় অনেকে ঋণ নেওয়ার সাহসও করেননি। যার প্রভাব পড়েছে খুচরা থেকে রাজধানীর বড় পাইকারি ব্যবসায়ীদের ওপর।
বঙ্গবাজারের বিসমিল্লাহ গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী মো. মিজানুর রহমান বলেন, ‘করোনার সময় কারোরই ব্যবসা ভালো হয়নি। সবারই পুঁজির ক্ষতি হয়েছে কমবেশি। যারা লোন নিয়েছিল, শোধ করতে পারেনি, ব্যবসায় নতুন লগ্নিও করতে পারেনি। এটা শুধু আমাদের ঢাকার ব্যবসায়ীদের অবস্থা এমন না, মাঝারি থেকে খুচরা ব্যবসায়ী সবার একই অবস্থা। হাতে টাকা না থাকলে ঢাকায় মাল কীভাবে নিতে আসবে? মফস্বল থেকে ব্যবসায়ীরা না এলে আমাদেরও ব্যবসা হবে না। কারণ ঢাকায় তো শীত নেই, শীত গ্রামে।’
রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা
আগামী বছর জাতীয় নির্বাচন ঘিরে রাজনৈতিক পরিবেশ নিয়েও শঙ্কায় আছেন ব্যবসায়ীরা। চলতি বছরের ১০ ডিসেম্বর থেকে বিএনপির মহাসমাবেশ-পরবর্তী সময় নিয়েও তাদের মনে ভীতি রয়েছে বলে জানান তারা। দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠলে ব্যবসায় ক্ষতি হবে। বিশেষ করে করোনা ঘাটতি এখনও কাটিয়ে না উঠতে পারেননি। যদি এ বছরও ব্যবসা না হয়, তাহলে ব্যবসায় দীর্ঘমেয়াদি চাপ তৈরি হবে বলে মনে করছেন তারা।
ঢাকা ট্রেড সেন্টারের ইমন গার্মেন্টসের স্বত্বাধিকারী কামরুল ইসলাম বলেন, ‘করোনায় আমাদের ব্যবসা হয়নি, এক বছর যেতে না যেতে জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, এখনও কাস্টমার নাই। আগামী ১০ ডিসেম্বর বিএনপির সমাবেশের পর যদি আবার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট খারাপ হয়, তাহলে আমাদের ব্যবসা হবে না। যেহেতু শীত দেরিতে আসছে, এখনও কাস্টমার আসছে না, আমরা ডিসেম্বরের জন্যই অপেক্ষা করছি। যদি পরিবেশ খারাপ হয়, ব্যবসায়ীরা ঢাকা আসতে পারবেন না।’
নগর প্লাজার ব্যবসায়ী ইকবাল বলেন, ‘আসছে বছর নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু। ভাব এখন ভালো মনে হচ্ছে না। যেহেতু ব্যবসায়ীরা এখনও আসছে না, ডিসেম্বর-জানুয়ারি কম-বেশি ব্যবসা হবে আমরা আশা করছি। কিন্তু রাজনৈতিক অবস্থা খারাপ হলে আমাদের কোনও ব্যবসা হবে না। সবারই কম-বেশি লোন নেওয়া আছে। পণ্য বেচে লোন শোধ করতে হবে, না হলে পুঁজি নষ্ট হবে।’