X
বৃহস্পতিবার, ২৮ মার্চ ২০২৪
১৪ চৈত্র ১৪৩০

ধানমন্ডিতে ছিনতাই বেড়েছে, ওসি বলছেন চুরি

আব্দুল হামিদ
০৮ নভেম্বর ২০২২, ২৩:৩৩আপডেট : ০৯ নভেম্বর ২০২২, ২০:১৬

রাজধানী ঢাকায় ছিনতাই এখন নিত্যনৈমিত্তিক ঘটনা। সম্প্রতি ধানমন্ডি এলাকায় আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে ছিনতাইকারীদের দৌরাত্ম্য। এক্ষেত্রে পুলিশের ভূমিকা নিয়েও প্রশ্ন উঠেছে। ছিনতাইয়ের ঘটনায় ভুক্তভোগীরা পুলিশের দৃশ্যমান তৎপরতা দেখতে চান। তবে পুলিশের দাবি, ছিনতাই বন্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এছাড়া সাধারণ পথচারীদেরও সতর্ক হওয়ার পরামর্শ তাদের।

ঢাকা শহরের বিভিন্ন জায়গায় ছিনতাই, ছিনতাইয়ে বাধা দেওয়ায় ছুরিকাঘাতে খুনের ঘটনাও ঘটছে। আবাসিক এলাকায় সন্ধ্যা থেকে শুরু হলেও জনসমাগম এলাকায় মধ্যরাত ও ভোরের দিকে সবচেয়ে বেশি ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে। পাশাপাশি চুরিও বাড়ছে বলে জানায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

ধানমন্ডি এলাকা থেকে মোবাইল ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন তরুণ কবি সাদ রহমান। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘গত শনিবার (৫ নভেম্বর) রাতে ধানমন্ডি ২ নম্বর রোডে বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিয়ে সাড়ে ১০টার দিকে বাসায় ফিরছিলাম। ৩ নম্বর রোডে ল্যাবএইড হাসপাতাল পার হয়ে ভূতের গলির বাসার কাছাকাছি আসতেই ছিনতাইকারীদের কবলে পড়ি।’

তিনি বলেন, ‘ধানমন্ডি ৩ নম্বর রোডের মুখে রিকশায় এক বন্ধুকে নিয়ে বসে আছি। একটা পার্সেল আসার কথা, সেটা রিসিভ করার জন্য। এসময় মোবাইল ব্যবহার করছিলাম। এসময় পাশ দিয়ে একটি মোটরসাইকেল যাওয়ার সময় ছোঁ মেরে মোবাইল ফোনটি নিয়ে সোজা মিরপুরের দিকে চলে যায়। বিষয়টি মানতেই পারছিলাম না। আমার চোখের সামনে দিয়ে শখের ফোনটা নিয়ে চলে গেলো।’

ঢাকা শহরের গত ১০ বছরের ছিনতাইয়ের ঘটনাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, কিছু ঘটনায় বিচার হলেও অধিকাংশের অগ্রগতি নেই। ধরাছোঁয়ার বাইরে রয়েছে অধিকাংশ অপরাধী। গত নয় মাসের (জানুয়ারি-সেপ্টেম্বর) হিসাব অনুযায়ী, রাজধানীতে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ৭২টি। তবে জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এই তিন মাসে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটেছে ৩৮টি। যা গত ছয় মাসের চেয়ে অনেক বেশি। এরমধ্যে ৮৮ ভাগ ছিনতাইকারীর বিচার হয়নি। আইনের দুর্বলতা যতটা, তার চেয়ে বেশি পদ্ধতিগত ও সদিচ্ছার অভাব। এছাড়া তদন্ত প্রক্রিয়ার মধ্যে বড় ধরনের ঘাটতি আছে।

ধানমন্ডিসহ আশপাশের এলাকায় টানা পার্টি ও অস্ত্রের মুখে ছিনতাইয়ের ঘটনা ঘটছে বেশি। ফাঁকা রাস্তায় নির্বিঘ্নে ছিনতাই করছে টানা পার্টি। তারা বিভিন্ন গলিতে মোটরসাইকেল নিয়ে ঘুরছে, সুযোগ মতো রিকশায় থাকা যাত্রী ও পথচারীদের মোবাইল ও ব্যাগ টান দিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। ওই সময় রাস্তা ফাঁকা থাকায় কোনও বাধা ছাড়া নিরাপদে চলে যাচ্ছে। আর একটি গ্রুপ অস্ত্রের মুখে ছিনতাই করছে। তারা নিজেদের সঙ্গে থাকা অস্ত্র বের করে মূল্যবান জিনিসপত্র দিতে বলছে। কেউ বাধা দেওয়ার চেষ্টা করলেই আঘাত করছে, এতে হতাহতের ঘটনাও ঘটছে।

সাদ রহমানের মোবাইল ফোন ছিনতাই হলেও তিনি সাধারণ ডায়েরি করেছেন। তিনি বলেন, মোবাইল ছিনতাই হলেও  কোনও আইনি ঝামেলাই জড়াতে চাই না, তাই জিডি করেছি। মোবাইল নিয়ে যাওয়ার পরে থানায় জিডি করে রাখছি। পরে নতুন মোবাইল কিনেছি।

 ২২ অক্টোবর রাতে ধানমন্ডি লেকে হাঁটতে বের হয়ে ছিনতাইকারীদের হাতে খুন হন মেরিন ইঞ্জিনিয়ার শাহাদত হোসেন মজুমদার (৫১)। ওই ঘটনায় চার কিশোরকে গ্রেফতার করেছে পুলিশ। তারা হলেন, মো. রাব্বি, সোহেল, সজিব ও দোলাল। এরমধ্যে মো. রাব্বি, সোহেল ১৬৪ ধারায় আদালতে জবানবন্দিও দিয়েছে।

পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, অধিকাংশ ঘটনায় দেখা যাচ্ছে ভুক্তভোগীরা মামলা করতে চান না। তারা নিজেদের নিরাপত্তার জন্য শুধু জিডি করেই চুপ থাকেন। যে ঘটনায় মামলা হয়, আজ হোক আর কাল হোক অপরাধীদের আইনের আওতায় আসতেই হবে। কিন্তু সেটা হচ্ছে না। পুলিশের একার পক্ষে অপরাধ দমন করা সম্ভব না। ভুক্তভোগীদেরও এগিয়ে আসতে হবে।

ছিনতাইয়ের ঘটনায় থানায় হারানোর জিডি হওয়ার কারণ জানতে চাইলে তিন বলেন, ভুক্তভোগীরা ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা করতে চান না। তারা জিডি করতে চান। এজন্য ছিনতাই হলেও এটাকে হারিয়ে গেছে উল্লেখ করতে হয়। এখানে থানা পুলিশের কিছু করার নেই। ভুক্তভোগীরা মামলা করতে চাইলে অবশ্যই থানা মামলা নিতে বাধ্য। কিন্তু তারা মামলা করতে না চাইলে হারানো একটি জিডি নেওয়া হয়। কারণ, ছিনতাইয়ের জিডি হয় না, মামলা করতে হয়ে। জিডি করতে হলে চুরি উল্লেখ করতে হয়।

রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে হাজারেরও বেশি ছিনতাই, চুরি ও অপহরণ করে একটি চক্র। কিন্তু এসব ঘটনায় তাদের বিরুদ্ধে কোনও মামলা হয়নি। তবে  দুজন ভুক্তভোগী পৃথক দুটি মামলা করায় ওই চক্রের বেশ কয়েকজন সদস্যকে গ্রেফতার করে গোয়েন্দা পুলিশ। পুলিশ বলছে, চুরি, ছিনতাই ও অপহরণের ঘটনায় মামলা না হওয়ায় রাজধানীতে অপরাধ বেড়ে যাচ্ছে। এজন্য সাধারণ মানুষের যেকোনও ঘটনায় থানায় মামলা করা জরুরি।

সোমবার (৭ নভেম্বর) বিকালে সরেজমিন ধানমন্ডি মডেল থানায় দেখা যায়, কয়েক ঘণ্টার মধ্যে মোবাইল হারানো, ট্রেড লাইসেন্স, চেক বইয়ের রিসিট হারানোর জিডি করতে ভুক্তভোগীরা আসছেন। এছাড়া ব্ল্যাকমেইলিং ও হ্যারাসমেন্টের অভিযোগ আসছে। এসময় ডিউটিতে থাকা এক পুলিশ সদস্য বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রতিদিনই থানায় মোবাইল ছিনতাই ও হারানোর অভিযোগ আসেই। সম্প্রতি বেশি আসছে এমন অভিযোগ।

থানার এক কর্মকর্তা বলেন, প্রতারণার পাশাপাশি মোবাইল ছিনতাই ও হারানোর জিডিও বেশি হচ্ছে। এরমধ্যে আমরা অনেক মোবাইল ফোন উদ্ধার করেছি। আর ছিনতাইয়ের ঘটনায় আইনি ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

ধানমন্ডি থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) ইকরাম আলী মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ধানমন্ডি এলাকায় মাদক ও চুরির ঘটনা ঘটছে বেশি। এছাড়া ছিনতাইয়ের ঘটনা থাকলেও মোবাইল টানা পার্টির বিরুদ্ধে জিডিও হচ্ছে। পথচারীদের কাছ থেকে টানা পার্টি মোবাইল ফোন নিয়ে যাচ্ছে। এসব বিষয়ে আমাদের টিম কাজ করছে।

ধানমন্ডি এলাকার বিভিন্ন লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ধানমন্ডির লেক ও স্টেডিয়াম এলাকায় এই ঘটনা বেশি ঘটছে। এসব এলাকায় ভাসমান লোকদের অবাধ চলাফেরার পাশাপাশি বহিরাগতদের আনাগোনাও বেশি। তাছাড়া হাজারীবাগ থেকে ছিনতাইকারীরা এখানে এসে অপরাধ করে নির্বিঘ্নে চলে যাচ্ছে। এছাড়া টানা পার্টির সদস্যরা ধানমন্ডির মধ্যে তেমন যানজট না থাকায় অপরাধ করে পালিয়ে যেতে পারছে।

ধানমন্ডি এলাকায় প্রতিটি পয়েন্টে আরও সিসিটিভি বসানোরও দাবি করেন স্থানীয়রা। তারা বলেন, ধানমন্ডি এলাকায় অহেতুক ঘোরাফেরা করা ব্যক্তিদের চিহ্নিত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। এছাড়া তাদের চলাফেরাও নিয়ন্ত্রণে আনার দাবি তাদের।

এছাড়া এলাকাভিত্তিক বিভিন্ন ছিনতাইকারী গ্রুপ পরিবহনের ব্যবহার ছাড়াও সম্পদ লুটে নিয়ে সটকে পড়ে। দুইভাবে ছিনতাইয়ের টার্গেট করা হয়। একটি হলো, টাকা লেনদেন হয় এমন এলাকায় নির্দিষ্ট ব্যক্তিকে টার্গেট করে সুবিধাজনক স্থানে গতিরোধ করে ছিনতাই। অন্যটি হলো, টার্গেট এলাকায় চলাচলকারী কোনও ব্যক্তির সর্বস্ব লুটে নেওয়া।

কয়েক দিন আগে কারওয়ান বাজার পান্থকুঞ্জ পার্কের পাশ দিয়ে আসার সময় বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী শেখ সাইফ ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, গত মঙ্গলবার রাত ৯টার দিকে বাংলামোটর থেকে কারওয়ান বাজারে আসার সময় পান্থকুঞ্জ পার্কের পাশে কয়েকজন ছিনতাইকারী আমার পিঠে আঘাত করে মোবাইল ও মানিব্যাগ ছিনিয়ে নিয়ে যায়। পরে শাহবাগ থানায় এ ঘটনায় মামলা করি।

মেরিন ইঞ্জিনিয়ার হত্যা মামলার বিষয়ে রমনা বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মো. শহিদুল্লাহ বলেন, ‘শাহাদত হোসেনের কাছ থেকে কিছু ছিনিয়ে নেওয়ার সময় বাধা দেওয়ায় ছুরিকাঘাত করেন ছিনতাইকারীরা। উঠতি বয়সের এই কিশোররা ভয়ংকর ছিনতাইকারী।’

ছিনতাইয়ের বিষয়ে তিনি বলেন, রমনা বিভাগ এলাকায় ছিনতাইকারীদের আটক করা হয়েছে। এসব অপরাধ দমনে সবসময় উদ্যোগ থাকে। এছাড়া ছিনতাই ও অন্যান্য অপরাধ যেন না ঘটতে পারে, আর হলেও তাৎক্ষণিক আইনের আওতায় নিয়ে আসি। রমনা এলাকায় ছিনতাই রোধে নতুন পরিকল্পনা আছে। আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি।

/ইউএস/এমআর/এমওএফ/
সম্পর্কিত
ফটোকপি দোকানের কর্মচারী, জেলে, রাজমিস্ত্রি তৈরি করতো জাল টাকা
রাজধানীকে সুন্দর করতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা জরুরি: আইইবি
যাত্রাবাড়ীতে সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ গেলো যুবকের
সর্বশেষ খবর
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
কাপ্তাই হ্রদে পানি স্বল্পতায় কমেছে বিদ্যুৎ উৎপাদন
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
অ্যাপের মাধ্যমে ৪০০ কোটি টাকার রেমিট্যান্স ব্লক করেছে এক প্রবাসী!
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
মৌলভীবাজারে ৬ জনের মৃত্যুর ঘটনা মর্মান্তিক: মানবাধিকার কমিশন
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়ক অবরোধ করে শ্রমিকদের বিক্ষোভ
সর্বাধিক পঠিত
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
যেভাবে মুদ্রা পাচারে জড়িত ব্যাংকাররা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
আয়বহির্ভূত সম্পদ: সাবেক এমপির পিএস ও স্ত্রীর বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
বিএনপির ইফতারে সরকারবিরোধী ঐক্য নিয়ে ‘ইঙ্গিতময়’ বক্তব্য নেতাদের
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
নিউ ইয়র্কে পুলিশের গুলিতে বাংলাদেশি তরুণ নিহত, যা জানা গেলো
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি
কুড়িগ্রাম আসছেন ভুটানের রাজা, সমৃদ্ধির হাতছানি