X
শুক্রবার, ২৬ এপ্রিল ২০২৪
১২ বৈশাখ ১৪৩১

জঙ্গি তৎপরতা কি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে?

জামাল উদ্দিন ও আব্দুল হামিদ
১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:০১আপডেট : ১৫ জানুয়ারি ২০২৩, ১০:৩৬

জঙ্গি তৎপরতা কি আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে কিনা এমন প্রশ্ন করছেন অনেকেই। সম্প্রতি নতুন জঙ্গি সংগঠনের সন্ধান, দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কথিত হিজরতের নামে তরুণদের নিখোঁজ হওয়া এবং জঙ্গি তৎপরতায় লিপ্ত হওয়া, পাহাড়ে জঙ্গি প্রশিক্ষণ ক্যাম্পের তথ্য পাওয়া, রাজধানীর পুরান ঢাকার আদালত এলাকা থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গিকে ছিনতাইয়ের মতো ঘটনায় এই প্রশ্ন সামনে এসেছে।

আগামী এক বছরের মধ্যেই অনুষ্ঠিত হবে জাতীয় নির্বাচন। এ নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশে-বিদেশে ষড়যন্ত্র চলছে বলে বিভিন্ন সময় মন্তব্য করছেন রাজনৈতিক নেতারা। এদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, আফগানিস্তানে তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পর এ অঞ্চলের জঙ্গি ও উগ্রবাদীরা উদ্বুদ্ধ হয়েছে বলে মনে করেন।

জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বিশেষায়িত সংস্থা অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট (এটিইউ), র‌্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র‌্যাব) ও কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটসহ (সিটিটিসি) সরকারের অনেকগুলো সংস্থা কাজ করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে তাদের তৎপরতাও বেড়েছে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নির্মূল করা সম্ভব না হলেও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর কর্মকর্তাদের মতে, তাদের তৎপরতার কারণে জঙ্গি ও সন্ত্রাসবাদ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।

গত ২০ নভেম্বর (২০২২) রাজধানীর পুরান ঢাকার আদালত এলাকা থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত দুই জঙ্গি— আবু সিদ্দিক সোহেল ওরফে সাকিব ও মাইনুল হাসান শামীমকে ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাটিও সবাইকে ভাবিয়ে তুলেছে। ওই দুই জঙ্গির অবস্থান সম্পর্কেও এখনও নিশ্চিত হতে পারেনি আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো।

এদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, এখনও জঙ্গি ও উগ্রবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তথাকথিক হিজরতের নামে ঘর ছাড়ছে উঠতি বয়সের তরুণ-তরুণীরা। ইতোমধ্যে ঘরছাড়া বেশ কয়েকজন তরুণ-তরুণিকে আটক ও উদ্ধার করা হয়েছে। সবশেষ আরও পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হলেও ৫০ তরুণের খোঁজ এখনও পায়নি তারা। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতার কারণে কিছুটা নিয়ন্ত্রণে আসলেও নানাভাবে উগ্রবাদে মোটিভেটেড হওয়া তরুণদের ঘরছাড়া বন্ধ করা যাচ্ছে না। তাছাড়া কোনও তরুণ-তরুণী ঘর ছাড়লে সংশ্লিষ্ট পরিবার থেকে জানানো না হলে তাদের জানারও সুযোগ নেই। তাই এমন কোনও ঘটনা ঘটলে সেটা জানানোর অনুরোধ করেছেন তারা।

সিটিটিসির কর্মকর্তারা বলছেন, যারা উগ্রবাদে জড়াচ্ছেন তাদের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ এর মধ্যে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপপ্রচারের শিকার হয়ে তারা এ কাজে জড়িয়ে যাচ্ছেন। সেজন্য তারা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোতে নজরদারি বাড়িয়েছেন।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিটিটিসির এক কর্মকর্তা বলেন, তাদের কাছে তথ্য আছে জঙ্গিরা আবার সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছেন। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ছাড়াও নানাভাবে তারা নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ বাড়াচ্ছেন। তারা তাদের কর্মকাণ্ডের ধরনও পাল্টিয়েছে। যেমন আগে হামলাসহ বিভিন্নভাবে তারা সাধারণ মানুষের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করতো, এখন তারা সেটা করছে না। অনলাইনে তারা দাওয়াতি কাজ করছে বেশি।

বিভিন্ন সময় মিয়ানমার ও ফিলিস্তিনের মুসলমানদের ওপরের হামলার ঘটনার ফুটেজ সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েও একে অপরের মনোযোগ আকর্ষণের চেষ্টা করে যাচ্ছে। পরে কারা তাদের পোস্টে লাইক, কমেন্ট ও শেয়ার করছে সেগুলো পর্যালোচনা করে। এরপর তাদের টাগের্ট করে ইনবক্সে মেসেজ দিয়ে থাকে। প্রথমে ধর্মীয় বিষয় নিয়ে নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে। আস্তে আস্তে টার্গেট করা তরুণকে নির্জনে ইবাদত ও ধর্মীয় কাজের কথা বলে উদ্ধুব্ধ করে। চূড়ান্ত পর্যায়ে গিয়ে হিজরত করার কথা বলছে। এরমধ্যে টার্গেট করা তরুণকে কয়েক ধাপ পার হতে হচ্ছে। কিন্তু ঘর ছাড়া তরুণরা যা ভেবে পরিবার ছাড়ছেন, সেখানে গিয়ে তার কোনও মিল পাচ্ছেন না। কিন্তু তখন সেখান থেকে তার ‍ফিরে আসাও সম্ভব হয়না। ঘরছাড়া তরুণরা এসব তথ্য দেন আইন শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে।

কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম ইউনিটের (সিটিটিসি) প্রধান মো. আসাদুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে এখনও তথাকথিত হিজরতের নামে তরুণেরা ঘরে ছেড়ে বের হয়ে যাচ্ছে। এটা সম্পূর্ণ বন্ধ করা না গেলেও পরিস্থিতি আমাদের নিয়ন্ত্রণে আছে। এছাড়া পরিবারের পক্ষ থেকে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে ঘর ছাড়ার বিষয়টি না জানালে বোঝার উপায়ও থাকে না। সেজন্য ঘর ছাড়া তরুণের সংখ্যা নির্দিষ্ট করে বলা সম্ভব নয়। তিনি বলেন, কথিত হিজরতের বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তারা পর্যবেক্ষণে রেখেছেন।

র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ইতোমধ্যে ঘরছাড়া ৯জনকে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দেওয়া হয়েছে। কয়েকজনকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। নতুন করে আর কোনও তরুণ-তরুণী জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ঘর ছাড়ছে কিনা এ বিষয়ে র‌্যাবের কাছে নতুন করে কোনও অভিযোগ আসেনি।

পাহাড়ে অবস্থান করা জঙ্গিদের বিষয়ে কমান্ডার খন্দকার আল মঈন বলেন, সেখান থেকে সশস্ত্র জঙ্গিদের পাঁচজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। বাকিদের গ্রেফতারে র‌্যাবের অভিযান অব্যাহত আছে।

দেশে আবার জঙ্গিবাদের উত্থান ঘটছে কি-না জানতে চাইলে বিমানবাহিনীর সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, আগে যেটা অনেক দূরে ছিল, সেটা এখন অনেক কাছে এসে গেছে। আফগানিস্তানে তালিবানদের উত্থানের পরে এমন ভাবধারার লোকেরা উদ্ধুদ্ধ হয়ে উঠছে। কোনও জঙ্গিগোষ্টিকে স্থান দেবে না বলে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে প্রতিজ্ঞা করে তালিবানরা ক্ষমতায়ে এসেছে। কিন্তু ইতোমধ্যে সেখানে আইএস ঘাঁটি গেড়েছে। তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তান এখন পাকিস্তানেরই মাথা ব্যথার কারণ হয়ে উঠেছে। সুতরাং আগে যেটা দূরে ছিল সেটা এখন কাছে চলে এসেছে। আমাদের দক্ষিণ এশিয়ার মধ্যেই তো তারা চলে এসেছে।

ইশফাক ইলাহী চৌধুরী আরও বলেন, আল কায়েদা সাউথ এশিয়া নামে যে জঙ্গি সংগঠন আছে সেটাতো ভারতেই সক্রিয়। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশেও সেটা সক্রিয় হবার চেষ্টা করবে। তাই সামনে চ্যালেঞ্জ আছে। নানা নামে আইএস ও আল কায়েদার মতাদর্শে উদ্ধুদ্ধ হয়ে তারা আসবে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে আফ্রিকার নাইজেরিয়ার একটা অঞ্চল, সোমালিয়া,গিনি ও মালিসহ যে এলাকা তারা নিয়ন্ত্রণ করছে, তা সিরিয়ার চেয়েও অনেক বড় এলাকা। যদিও জনসংখ্যা কম। সেখানে সক্রিয় আল শাবাবও আল কায়েদার একটা অংশ। আমাদের দেশের রোহিঙ্গা ক্যাম্পও জঙ্গিবাদের উত্থানের আরেকটা ক্ষেত্র।

এ থেকে পরিত্রানের উপায় হিসেবে নিরাপত্তা বিশ্লেষক ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযান অব্যাহত থাকতে হবে। পাশাপাশি সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রত্যেকটা রাজনৈতিক দলকে অঙ্গীকার করতে হবে যে, এসব বিষয়ে তারা কোনও ছাড় দেবে না। এখনও আমরা অনেকেই জঙ্গি কর্মকাণ্ডকে বলছি সাজানো নাটক। সরকারেরও এ ক্ষেত্রে দায় আছে। তাদের বিভিন্ন সংস্থাগুলো এ নিয়ে পরিষ্কারভাবে উপস্থাপন করা উচিত। যেমন মাথায় হেলমেট পরানোর দরকার কী? তাদের জনসম্মুখে পরিচয় করিয়ে দেওয়া উচিত। যাতে সবাই তাদের চিনে রাখতে পারে। এছাড়াও পরিবার, বাবা-মা, প্রতিবেশি ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোরও এ ক্ষেত্রে দায়িত্ব রয়েছে।

আরও পড়ুন-

বিচ্ছিন্নতাবাদীদের অস্ত্র দিতে চেয়েছিল নতুন জঙ্গি সংগঠন!

বন্ধ হয়নি কিশোর-তরুণদের কথিত হিজরত

‘নির্জনে ইবাদত করতে ঘরছাড়া’ ৯ জন পৌঁছে যায় জঙ্গি ক্যাম্পে

জঙ্গি ছিনতাই: ত্রিশাল থেকে ঢাকার আদালত পাড়া

জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় মামলা: ডিএমপি কমিশনার

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২ জঙ্গি ছিনতাই: সারা দেশের আদালতে নিরাপত্তা বাড়ানোর নির্দেশ

আদালত থেকে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২ জঙ্গিকে ছিনিয়ে নিয়েছে সহযোগীরা

ছয় মাস ধরে কারাগারে মোবাইল ও ইন্টারনেট ব্যবহার করছিল জঙ্গিরা!

/এফএস/
সম্পর্কিত
পাকিস্তানে জাপানি নাগরিকদের লক্ষ্য করে জঙ্গি হামলা
ইরানের সামরিক স্থাপনায় পৃথক জঙ্গি হামলা, নিহত ৫
মস্কোতে কনসার্টে হামলায় নিহত বেড়ে ৬০, আইএস এর দায় স্বীকার
সর্বশেষ খবর
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
জেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ককে দল থেকে বহিষ্কার
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
সড়কে প্রাণ গেলো মোটরসাইকেল আরোহী বাবা-ছেলের
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
দেশের তথ্যপ্রযুক্তি বিশ্ব দরবারে উপস্থাপন করতে চান রাশেদুল মাজিদ
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
আগুন নেভাতে ‘দেরি করে আসায়’ ফায়ার সার্ভিসের গাড়িতে হামলা, দুই কর্মী আহত
সর্বাধিক পঠিত
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
দুদকের চাকরি ছাড়লেন ১৫ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
বাংলাদেশ ব্যাংকের চাকরি ছাড়লেন ৫৭ কর্মকর্তা
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
স্কুল-কলেজে ছুটি ‘বাড়ছে না’, ক্লাস শুরুর প্রস্তুতি
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
কেন গলে যাচ্ছে রাস্তার বিটুমিন?
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা
ধানের উৎপাদন বাড়াতে ‘কৃত্রিম বৃষ্টির’ পরিকল্পনা