অনলাইনে বিভিন্ন কনটেন্ট থেকে ধর্মীয় অপব্যাখ্যার শিকার হয়ে ঘর ছাড়েন ৯ তরুণ-তরুণী। তারা দাবি করছেন, নির্জনে ইবাদত করতে বাড়ি থেকে বের হয়ে পৌঁছে যান জঙ্গি ক্যাম্পে। পরে ভুল বুঝতে পেরে জঙ্গি ক্যাম্প থেকে ফিরে আসেন তারা। কিন্তু পরিবারে ফিরে আসতে না পারায় বিভিন্ন স্থানে ঘুরতে থাকেন। এসময় র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন (র্যাব) তাদের হেফাজতে নিয়ে কাউন্সিলিংয়ের মাধ্যমে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করে।
সোমবার (২ জানুয়ারি) বেলা ১২টার দিকে রাজধানীর কুমিটোলায় র্যাব সদর দফতরে ‘নব দিগন্তের পথে’ নামে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে ঘরে ছাড়া ৯ তরুণ-তরুণীকে জঙ্গিবাদ থেকে ফিরিয়ে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করার জন্যই আয়োজিত হয় এই অনুষ্ঠান। তাদের মধ্যে চার জন ছেলে ও পাঁচ জন মেয়ে।
প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থেকে র্যাবের মহাপরিচালক অতিরিক্ত আইজিপি এম খুরশীদ হোসেন আনুষ্ঠানিকভাবে তাদের পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেন। এসময় র্যাবের মহাপরিচালক অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরে আসা ৯ জন তরুণ-তরুণীকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান এবং বই উপহার প্রদান দেন। এসময় প্রত্যেককে নগদ ১০ হাজার টাকা করে দেন তিনি। তাদের সঠিক শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সুন্দর ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার মাধ্যমে দেশ সেবায় অংশগ্রহণের প্রত্যাশা ব্যাক্ত করেন র্যাব ডিজি।
র্যাবের গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মশিউর রহমান জুয়েলের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি ছিলেন র্যাবের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন) কর্নেল মো. কামরুল হাসান, অতিরিক্ত মহাপরিচালক (প্রশাসন) ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ। এছাড়া বিশেষ আলোচক ছিলেন মুফতি মানসুর আহমাদ।
র্যাব বলছে, এখন পর্যন্ত বিভিন্ন জঙ্গি সংগঠনের প্রায় ২৯০০ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। জঙ্গিবিরোধী অভিযান পরিচালনার পাশাপাশি ডি-রেডিক্যালাইজেশনের মত নতুন পন্থা অনুসরণ করে পথভ্রষ্টদের সমাজের মূল ধারায় ফিরিয়ে এনে তাদের বিভিন্ন পুনর্বাসনের মাধ্যমে সরকারের সন্ত্রাসবিরোধী পরিকল্পনা বাস্তবায়নের প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছে। ইতোমধ্যে উগ্রবাদের বিভিন্ন পর্যায়ে অংশগ্রহণকারী ২১ জনকে ডি-রেডিক্যালাইজেশনের মাধ্যমে পরিবারের কাছে ফিরিয়ে দিয়েছে র্যাব।
র্যাবের পক্ষ থেকে আরও জানানো হয়, জঙ্গিবাদ একটি আদর্শিক সমস্যা। সুতরাং তা মোকাবিলায় প্রয়োজন ধর্মের সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরা। র্যাব শুরু থেকেই ধর্মের এই অপব্যাখ্যাকে মোকাবিলার জন্য জঙ্গিবাদের Counter Narrative হিসেবে ‘জঙ্গিবাদীদের অপব্যাখ্যা এবং পবিত্র কুরআনের সংশ্লিষ্ট আয়াত ও হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যা’ সম্বলিত একটি বই প্রকাশ করেছে, যা জঙ্গিবাদ বিরোধী প্রচারণায় অবদান রাখছে।
যেভাবে এই পথে নামেন তারা
এই ৯ তরুণতরুণীর একজন জানান, তারা প্রায় সবাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বিভিন্ন দেশের মুসলিম নারী ও শিশুদের ওপর নির্যাতনের ভিডিও ও ছবি দেখে তাদের প্রতি সহানুভূতিশীল হন। তারা নিয়মিত ওই সব ভিডিও এবং ছবি তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ারের পাশাপাশি লাইক ও কমেন্ট করতেন। এদের মধ্যে একজন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে যারা ওই সব ভিডিও, ছবি শেয়ার ও কমেন্ট করতো তাদের টার্গেট করে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠায়। যারা তার ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট গ্রহণ করে তাদের নিয়ে ‘দুনিয়াকি ইয়ে মুসাফির’ নামে একটি মেসেঞ্জার গ্রুপ খুলে যুক্ত করে। ওই গ্রুপে এই ৯ সদস্য ছিলেন।
তিনি জানান, মেসেঞ্জার গ্রুপটি ছিল জঙ্গিবাদে নার্সিং করার। পরে তাদের মেসেঞ্জার গ্রুপ থেকে টেলিগ্রাম গ্রুপে নিয়ে যায় এবং সেখানে ইসলামিক বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করতো। সেখানে তারা বিভিন্ন ইসলামিক ভিডিও পোস্ট করতো এবং বিভিন্ন লেখকের বই ডাউনলোড করে গ্রুপে দিত। পরবর্তীতে গ্রুপের এডমিন মাঝে মাঝে তাদের পড়াশোনার বিষয়ে জিজ্ঞাসা করতো। একপর্যায়ে তাদের বলা হয়, নির্বিঘ্নে ধর্ম পালন করতে হলে সব ফেৎনা থেকে দূরে সরে গিয়ে পাহাড়ি এলাকায় নিরিবিলি পরিবেশে যেতে হবে। সেখানে গিয়ে ধর্ম পালন করার নির্দেশ কোরআন ও হাদিসে আছে উল্লেখ করে ধর্মীয় ভুল ব্যাখ্যার মাধ্যমে উদ্বুদ্ধ করতো।
ভুক্তভোগী জানান, ওই ৯ জনই কথিত হিজরত করার বিষয়ে একমত পোষণ করেন। তখন তারা গুগল ম্যাপ বিশ্লেষণ করে রাঙামাটির পাহাড়ি এলাকায় যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। সেই অনুযায়ী তারা গত ২২ ডিসেম্বর বাড়ি ছাড়ার সিদ্ধান্ত নেন। সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ২৩ ডিসেম্বর তারা চট্টগ্রামের একটি স্থানে একত্রিত হন। সেখান থেকে ওই দিনই বাসে করে রাঙামাটিতে যান এবং সেখানে গিয়ে লোক সমাগম দেখে তারা হিজরতের জন্য অনুকূল নিরিবিল কোনও স্থান না পেয়ে চট্টগ্রামে ফেরত আসেন।
পরদিন তারা সবাই বান্দরবান গিয়েও সুবিধাজনক স্থান না পেয়ে একই দিনই আবার চট্টগ্রাম ফেরত আসেন। সুবিধাজনক স্থান না পাওয়ায় চট্টগ্রাম এসে তারা পরবর্তীতে কী করবে সে বিষয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। এরমধ্যে একজন নারী সদস্য অসুস্থ হয়ে পড়লে তারা স্থানীয় একটি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা করান। পরে গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে চট্টগ্রাম থেকে তাদের হেফাজতে নেয় র্যাব।