রাজধানীর খিলগাঁও থেকে সদরঘাট যাওয়ার পথে চলন্ত বাসে এক যুবককে অচেতন করা হয়, এরপর তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) একটি আবাসিক হলে এনে আটকে রেখে মুক্তিপণ দাবির অভিযোগ উঠেছে কয়েকজন শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে। জ্ঞান ফেরার পর ওই যুবককে মারধর করে প্রায় অর্ধলাখ টাকা আদায়ের পর ছেড়ে দেওয়া হয়। এসব অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগী ওয়ালিউল্লাহ (ওয়ালি)।
তিনি লক্ষ্মীপুরের রামগঞ্জ উপজেলার নোয়াগাঁও এলাকার স্থায়ী বাসিন্দা। ঢাকার তিতুমীর কলেজ থেকে স্নাতক (সম্মান) পাস করে বর্তমানে চাকরির সন্ধানে রয়েছেন। বুধবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাত সাড়ে ৯টার দিকে বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদ সালাম-বরকত হলে এ ঘটনা ঘটে।
বুধবার রাত সাড়ে ১২টায় সাংবাদিক ও হল প্রশাসনের কাছে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ জানান ওয়ালি। এসময় তিনি ছবি দেখে মারধর ও টাকা আদায়ের সঙ্গে জড়িত একজনকে চিহ্নিত করেন। অভিযুক্তের নাম অসিত পাল। তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের ৪৫ ব্যাচের বাংলা বিভাগের ছাত্র, এছাড়া তিনি জাবি শাখা ছাত্রলীগের উপ-পরিবেশ বিষয়ক সম্পাদক। এই ঘটনার সুষ্ঠু তদন্ত সাপেক্ষে জড়িতদের শাস্তি ও তার টাকা ফেরতের দাবি জানান ওয়ালিউল্লাহ।
হল প্রশাসনের উপস্থিতিতে ভুক্তভোগী ওয়ালিউল্লাহ বলেন, ‘বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশে বাসাবো থেকে সদরঘাটের বাসে উঠেছিলাম। এরপর আমার আর কিছু মনে নেই। পরে কিছুটা সেন্স ফিরে এলে বুঝতে পারি, কেউ আমাকে অনুসরণ করতে বলছে। আমিও অনুসরণ করতে থাকি। কিন্তু মুখ দিয়ে কিছু বলতে পারছিলাম না। পরে তারা আমাকে একটি কক্ষে নিয়ে যায়। সেখানে চার জন ছিল ও তারা একে অপরের সঙ্গে কথা বলছিল। এসময় তারা আমাকে একটি চেয়ারে বসিয়ে মারধর করে ও টাকা চায়।’
ওয়ালি দাবি করেন, এসময় অসিতসহ বাকি তিন জন তার কাছে ১০ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করেন। এছাড়া ব্যাগে থাকা নগদ ৪০ হাজার টাকা ও বিকাশের একটি এজেন্ট নম্বরে পরিবার থেকে পাঁচ হাজার টাকা আনিয়ে হাতিয়ে নেন।
এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের সালাম বরকত হলের পাশেই ওই বিকাশ এজেন্টের দোকানের অবস্থান। দোকানদার আদম আলী বিকাশের মাধ্যমে পাঁচ হাজার টাকা আসার বিষয়টি স্বীকার করেছেন। এছাড়া বিকাশে টাকা আদায়ের বিষয়ে সত্যতা মিলেছে বলে জানায় হল প্রশাসন।
ওয়ালিউল্লাহ বলেন, ‘তারা আমাকে মারধর করে ১০ লাখ টাকা দাবি করেন। আমার শরীরে লোহার পাইপ দিয়ে আঘাত করে ও ছুরি দিয়ে আঘাতের ভয় দেখায়। আমি চাকরি না থাকায় এত টাকা দিতে অপারগতা প্রকাশ করলে ঘাড়ে জোরে আঘাত করে। এসময় আমি তাদের ঘাড় ভেঙে গেছে বললে তারা মারধর বন্ধ করে দেয়। একপর্যায়ে ঘাড়ে একটি মাফলার পেঁচিয়ে নিচে নামিয়ে হলের বড় গেট দিয়ে বের করে দেয়।’ এসময় ওয়ালি উল্লাহর শরীরে বিভিন্ন ভারি বস্তু দিয়ে আঘাতের চিহ্ন ও কিছু জায়গায় ছোট ছোট তাজা ক্ষত দেখতে পাওয়া যায়।
জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের জাহানারা ইমাম হল সংলগ্ন এলাকা থেকে ভুক্তভোগীকে অচেতন অবস্থায় উদ্ধার করে কয়েকজন শিক্ষার্থী। পরে ঘটনাটি সম্পর্কে জানাজানি হয়ে গেলে বিশ্ববিদ্যালয়ে কর্মরত কয়েকজন সাংবাদিক ও শহীদ সালাম বরকত হল প্রভোস্টের উপস্থিতিতে ঘটনার প্রাথমিক তদন্ত করা হয়। প্রাথমিকভাবে ঘটনার সত্যতা পাওয়া গেছে বলে জানান হলটির প্রভোস্ট অধ্যাপক ড. সুকল্যাণ কুন্ডু।
প্রাথমিক তদন্তে প্রাধ্যক্ষসহ হলের দায়িত্বরত শিক্ষকরা ওয়ালিউল্লাহর দেওয়া বিবরণের ভিত্তিতে কয়েকটি কক্ষ তল্লাশি করেন। এসময় অসিত পালের কক্ষ (২১৪ নম্বর কক্ষ) থেকে একটি ভাঙা চেয়ার, তার ট্রাংক ও বিভিন্ন মাদকদ্রব্য গ্রহণের কিছু আলামত জব্দ করেন। এছাড়া হল প্রশাসনকে অসিতের কক্ষটি সিলগালা করে দিতে বলা হয়।
এসময় ট্রাংকের ভেতর থেকে ওয়ালিউল্লাহর বর্ণনা মতো একটি লোহার পাইপ পাওয়া যায়। এছাড়া ভাঙা চেয়ারটিতে বসিয়ে ওয়ালিউল্লাহকে মারা হয়েছিল বলে ওয়ালিউল্লাহ নিশ্চিত করেন।
ঘটনার বিষয়ে জানতে অভিযুক্ত অসিত পালের সঙ্গে মোবাইল ফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তার নম্বর বন্ধ পাওয়া যায়। এসময় উপস্থিত হল ছাত্রলীগের নেতারা জানান, অসিতের অসঙ্গতিপূর্ণ আচরণের জন্য তাকে তিন-চার মাস আগে হল থেকে বের করে দেওয়া হয়েছে। এখন সে হলের বাইরে অবস্থান করছে।
হল প্রভোস্ট অধ্যাপক সুকল্যাণ কুমার কুণ্ডু বলেন, ‘আমার হলে এমন একটি ঘটনা ঘটেছে, তা আমাদের জন্য দুঃখজনক। আমরা তাকে আপাতত মেডিক্যাল থেকে সিকিউরিটি অফিসে স্থানান্তর করবো। ভুক্তভোগী বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ বরাবর লিখিত অভিযোগ দিলে কর্তৃপক্ষ যথাযথ ব্যবস্থা নেবে। এছাড়া তদন্ত সাপেক্ষে বাকি অভিযুক্তদেরও খুঁজে বের করা হবে।’
অধ্যাপক কুণ্ডু আরও বলেন, ‘ভুক্তভোগীকে অচেতন করতে স্কোপোলামিন নামক ড্রাগ ব্যবহার করার সম্ভাবনা বেশি। তার বিবরণ অনুযায়ী ড্রাগ গ্রহণের পর শরীরে যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল তা মিলে যায়। এই ড্রাগ প্রয়োগ করা হলে ব্যক্তিকে যা করতে বলা হবে, সে তা করবে। তার মস্তিষ্ক স্বাভাবিকভাবে কাজ করবে না ‘
এসময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রগতিশীল শিক্ষার্থী সংগঠনের কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন। স্কোপোলামিন নামে ড্রাগের বিষয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে তারা গণমাধ্যমকে বলেন, এসব ড্রাগের বিষয়ে এখন থেকেই বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সচেতন হওয়া দরকার ও নজরদারি বাড়াতে হবে। এই ড্রাগের ব্যবহার ছড়িয়ে পড়লে চুরি, ছিনতাই, রেপের ঘটনাগুলো বাড়বে। এটি আমাদের সচেতন সমাজের জন্য শঙ্কার বিষয়।’
এ বিষয়ে প্রমাণ সাপেক্ষে অভিযুক্ত শিক্ষার্থীর বিরুদ্ধে কোনও পদক্ষেপ নেওয়া হবে কিনা জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রক্টর অধ্যাপক আ স ম ফিরোজুল হাসানের সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাকে পাওয়া যায়নি।
এ বিষয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. নূরুল আলমের সঙ্গে মোবাইলফোনে একাধিকবার যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি কল রিসিভ করেননি।