X
মঙ্গলবার, ১৩ মে ২০২৫
৩০ বৈশাখ ১৪৩২

কালুরঘাটে হচ্ছে নতুন সেতু, ভিত্তিপ্রস্তরে থাকছে না প্রধান উপদেষ্টার নাম

নাসির উদ্দিন রকি, চট্টগ্রাম
১৩ মে ২০২৫, ০৮:০১আপডেট : ১৩ মে ২০২৫, ০৮:০১

দক্ষিণ চট্টগ্রামের মানুষের দীর্ঘদিনের দাবি কর্ণফুলী নদীর ওপর নতুন একটি কালুরঘাট সেতু নির্মাণ। অবশেষে তাদের দাবি পূরণ হতে যাচ্ছে। আগামী বুধবার (১৪ মে) কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতু নির্মাণকাজের আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন হতে যাচ্ছে। প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে প্রথমবারের মতো এই ভিত্তিপ্রস্তরের স্মারক ফলকে নাম থাকছে না উদ্বোধনকারীর।

যেকোনো ভিত্তিপ্রস্তরের স্মারক ফলকে উদ্বোধনকারীর নাম উল্লেখ করা যেন প্রচলিত নিয়ম। প্রচলিত সেই নিয়মের পরিবর্তন হয়েছে এবার। চট্টগ্রামে এই প্রথম কোনও স্মারক ফলকে উদ্বোধনকারীর নাম রাখা হয়নি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রেলওয়ে পূর্বাঞ্চলের মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ সুবক্তগীন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আগামী বুধবার কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন প্রধান উপদেষ্টা। তার নির্দেশনায় স্মারক ফলকে উদ্বোধনকারী হিসেবে তার নাম রাখা হয়নি। এটি ভিত্তিপ্রস্তরের স্মারক ফলকের ইতিহাসে ব্যতিক্রম। এর আগে এমনটি হয়নি। উদ্বোধনকারীর নাম রাখা ছিল প্রচলিত নিয়ম। প্রথমবার কোনও নতুন প্রকল্পের স্মারক ফলকে নাম উল্লেখ করা হয়নি। আমদের ওভাবেই নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। সে অনুযায়ী সব প্রস্তুতি নিয়েছি আমরা।’

রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, নতুন কালুরঘাট রেল ও সড়ক সেতুর অনুষ্ঠান হবে চট্টগ্রাম সার্কিট হাউজ চত্বরে। অনুষ্ঠান আয়োজন চলবে বেলা ১১টা ৪৫ মিনিট থেকে দুপুর ১টা ১৫ মিনিট পর্যন্ত।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ভিত্তিপ্রস্তর ফলক তৈরি করেছেন চট্টগ্রাম নগরের কাজির দেউরি এলাকায় অবস্থিত ‘চিটাগাং মার্বেল হাউজ’ নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী লুৎফুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘কয়েকদিন আগে ভিত্তিপ্রস্তরের ফলকটি নির্মাণের জন্য রেলওয়ের কর্মকর্তারা অর্ডার দিয়েছেন। তারা বলেছেন, ফলকটিতে ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনকারীর নাম থাকবে না। আমরা বছরের পর বছর ধরে ফলক নির্মাণের কাজ করে আসছি। সবসময় উদ্বোধন বা ভিত্তিপ্রস্তর যিনি করেন, তার নামই ফলকে থাকে। এবারই প্রথম কোনও ফলক তৈরি করলাম, যেটিতে ভিত্তিপ্রস্তরকারীর নাম নেই। আসলেই ব্যতিক্রম ঘটনার সাক্ষী হলাম। টাইলস দিয়ে তৈরি ফলকটির আকার আড়াই ফুট প্রস্থ এবং চার ফুট দৈর্ঘ্য। এটি খোদাই করে তৈরি করতে দুদিন সময় লেগেছে আমার।’

রেলওয়ে জানিয়েছে, বর্তমানে কর্ণফুলী নদীর ওপর কালুরঘাটে একটি সেতু রয়েছে। এটি ১৯৩১ সালে  নির্মাণ করেছিল ব্রুনিক অ্যান্ড কোম্পানি নামের একটি প্রতিষ্ঠান। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর মিয়ানমারের সঙ্গে সরাসরি রেল যোগাযোগের জন্য এটি নির্মাণ করা হয়েছিল। ৬৩৮ মিটার দীর্ঘ সেতুটি ২০০১ সালে ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছিল। ২০০৪ ও ২০১২ সালে দুই দফায় সংস্কার করেছিল রেলওয়ে। কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণের পর ২০২৩ সালে ৫৫ কোটি টাকা ব্যয়ে সেতুটি আরেক দফা সংস্কার করা হয়। এরপরও অবস্থা জরাজীর্ণ। ভারী যানবাহন চলতে দেওয়া হচ্ছে না। এসব যানবাহন চলছে ফেরি দিয়ে। এ ছাড়া সেতুটি একমুখী। একদিক থেকে যানবাহন এলে অপর প্রান্তের যানবাহনগুলোকে অপেক্ষায় থাকতে হয়। এসব কারণে যাত্রী ও চালকদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ফলে নতুন সেতুর উদ্যোগ নেয় বর্তমান সরকার।

দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ হওয়ায় বোয়ালখালীসহ দক্ষিণ চট্টগ্রামবাসী উৎফুল্ল। ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের পরদিন বৃহস্পতিবার সকাল ৯টায় কালুরঘাট সেতুর পশ্চিম প্রান্ত থেকে বোয়ালখালীর সর্বস্তরের নাগরিক সমাজ ও বোয়ালখালী কালুরঘাট সেতু বাস্তবায়ন পরিষদের যৌথ উদ্যোগে একটি আনন্দ মিছিল বের করা হবে। মিছিলটি সেতুর পশ্চিম প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে পূর্ব প্রান্তে গিয়ে সংক্ষিপ্ত সমাবেশের মাধ্যমে শেষ হবে।

প্রকল্প সংশ্লিষ্ট ও রেলওয়ের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর ২০২৪ সালের ৭ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় কালুরঘাটে কর্ণফুলী নদীর ওপর রেল-কাম-রোড সেতু নির্মাণ প্রকল্পের অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ব্যয় ধরা হয় ১১ হাজার ৫৬০ কোটি টাকা। প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে রেলওয়ে। ২০২৬ সালের শুরুর দিকে নতুন সেতুর কাজ শুরু হয়ে ২০৩০ সালে সেতু দিয়ে যান চলাচল শুরুর কথা আছে। প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য গত ফেব্রুয়ারি মাসে প্রকৌশলী আবুল কালাম চৌধুরীকে প্রকল্প পরিচালক হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগে তিনি দোহাজারী-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের অতিরিক্ত প্রকল্প পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন।

রেলওয়ে সূত্র জানিয়েছে, সেতু নির্মাণের জন্য দক্ষিণ কোরিয়ার কাছ থেকে সহজ শর্তে ৮১ কোটি ৪৯ লাখ ১০ হাজার ডলার ঋণ পাচ্ছে বাংলাদেশ। যা বাংলাদেশি নয় হাজার ৫৩৪ কোটি ৪৪ লাখ ৭০ হাজার টাকা (প্রতি ডলার ১১৭ টাকা হিসাবে)। এর মধ্যে দক্ষিণ কোরিয়ার ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট কোঅপারেশন ফান্ড (ইডিসিএফ) থেকে ৭২ কোটি ৪৭ লাখ ৩০ হাজার ডলার এবং ইকোনমিক ডেভেলপমেন্ট প্রমোশন ফ্যাসিলিটি (ইডিপিএস) তহবিল থেকে নয় কোটি এক লাখ ৮০ হাজার ডলার দেওয়া হবে।

সেতুর প্রস্তাবিত নকশা অনুযায়ী, কর্ণফুলী নদীর ওপর বিদ্যমান রেল সেতুর ৭০ মিটার উজানে নতুন সেতু নির্মিত হবে। দুই পাশে দুই লেন করে চার লেনের সেতু তৈরি হবে। এক পাশে চলবে ট্রেন, অপর পাশে বাস-ট্রাকসহ সাধারণ যানবাহন চলবে। মূল সেতুর দৈর্ঘ্য ৭০০ মিটার। পানি থেকে সেতুর উচ্চতা ১২ দশমিক ২ মিটার। ভায়াডাক্টসহ সেতুর দৈর্ঘ্য হবে প্রায় ছয় কিলোমিটার।

সমীক্ষা প্রতিবেদন অনুযায়ী, সেতু দিয়ে চট্টগ্রাম-কক্সবাজার রুটে প্রতিদিন ২০ জোড়া ট্রেন এবং দিনে প্রায় ১৫ হাজার যানবাহন চলাচল করবে। এর মাধ্যমে আনুমানিক ১০ মিলিয়ন মানুষ সরাসরি উপকৃত হবেন। সাড়ে তিন দশকের বেশি সময় ধরে দক্ষিণ চট্টগ্রামের কোটি মানুষ কালুরঘাটে নতুন সেতুর অপেক্ষায় আছেন।   

এ বিষয়ে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী আবুল কালাম চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইতিমধ্যে সেতু নির্মাণের জন্য পরামর্শক নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে। এরপর ডিজাইন চূড়ান্ত করা হবে। সব ঠিক থাকলে ২০৩০ সালে সেতু দিয়ে যানবাহন ও ট্রেন চলাচল করবে বলে আশা করা যায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘বুধবার সেতুর ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করবেন মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা। তার নির্দেশনা মেনে ভিত্তিপ্রস্তরের ফলকে প্রধান উপদেষ্টার নাম রাখা হয়নি। এটি আমার দেখা প্রথম কোনও ব্যতিক্রমী নামফলক।’

রেলওয়ের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সংস্কারকাজ শেষে প্রায় ১৫ মাস পর গত ২৭ অক্টোবর যান চলাচলের জন্য খুলে দেওয়া হয় চট্টগ্রামের পুরাতন কালুরঘাট সেতু। বহু বছরের পুরোনো হওয়ায় সেতুটি দিয়ে ৮ ফুট উচ্চতার বেশি গাড়ি চলাচল করতে দেওয়া হয় না। সংস্কারকাজের জন্য ২০২৩ সালের ১ আগস্ট সেতু দিয়ে সব ধরনের যান চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেডকে ৪৩ কোটি টাকার সংস্কারকাজের জন্য কার্যাদেশ দেওয়া হয়। কাজের জন্য সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছিল ছয় মাস। কিন্তু এই সময়ের মধ্যে কাজ শেষ করতে ব্যর্থ হয় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। আর্থিক সংকট, দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং প্রাকৃতিক কারণে সংস্কারকাজ বিলম্ব হয় বলে দাবি করে রেলওয়ে ও ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। কর্ণফুলী নদীর ওপর নির্মিত এই সেতু দিয়ে চট্টগ্রামের বোয়ালখালী এবং পটিয়া ও রাঙ্গুনিয়ার একটি অংশের মানুষ চট্টগ্রাম নগরে আসা-যাওয়া করে থাকেন। 

এরই মধ্যে চট্টগ্রামের দোহাজারী থেকে কক্সবাজার পর্যন্ত নতুন রেললাইন নির্মাণ করে রেলওয়ে। ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের সঙ্গে ট্রেন চলাচল নির্বিঘ্ন করতে ৯৩ বছরের পুরোনো এই সেতু সংস্কারের উদ্যোগ নেওয়া হয়। সংস্কারকাজ শুরুর তিন মাসের মধ্যে ট্রেন চলাচলের উপযোগী হয়। ২০২৩ সালের নভেম্বরে পরীক্ষামূলক ট্রেন চালানো হয়। আর ১ ডিসেম্বর থেকে এই লাইনে বাণিজ্যিক ট্রেন চলাচল শুরু হয়। মাঝেমধ্যে সেতুটি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠায় এবং সংস্কারের প্রয়োজন পড়ায় দুর্ভোগের সৃষ্টি হওয়ার কারণে নতুন একটি সেতুর দাবি জানিয়ে আসছিল স্থানীয়রা। অবশেষে তাদের দাবি পূরণ হতে চলছে।

/এএম/
সম্পর্কিত
বাজেটে এবার কতটা বাড়বে নিত্যপণ্যের দাম?
জাপানের সঙ্গে এফওসি নিয়ে হচ্ছে কী
‘বাংলাদেশ-নেপাল-ভুটান-সেভেন সিস্টার্সের জন্য সমন্বিত অর্থনৈতিক পরিকল্পনা থাকা উচিত’
সর্বশেষ খবর
যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বাড়াতে চায় বাংলাদেশ
যুক্তরাষ্ট্র থেকে পণ্য আমদানি বাড়াতে চায় বাংলাদেশ
আ.লীগ কার্যালয় থেকে ‘চর উন্নয়ন কমিটির’ সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে
আ.লীগ কার্যালয় থেকে ‘চর উন্নয়ন কমিটির’ সাইনবোর্ড সরিয়ে ফেলা হয়েছে
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সিপিবির আলোচনা
ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে সিপিবির আলোচনা
রাশিয়ার ক্রাকোভ কনস্যুলেট বন্ধের ঘোষণা পোল্যান্ডের
রাশিয়ার ক্রাকোভ কনস্যুলেট বন্ধের ঘোষণা পোল্যান্ডের
সর্বাধিক পঠিত
পররাষ্ট্র সচিবের অফিসার্স ক্লাবের সদস্য পদ স্থগিত
পররাষ্ট্র সচিবের অফিসার্স ক্লাবের সদস্য পদ স্থগিত
আ.লীগ-ছাত্রলীগের ২৬ নেতার আত্মসমর্পণ
আ.লীগ-ছাত্রলীগের ২৬ নেতার আত্মসমর্পণ
রংপুরের হাসপাতাল নেপাল ও ভুটানের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে: প্রধান উপদেষ্টা
রংপুরের হাসপাতাল নেপাল ও ভুটানের জন্য উন্মুক্ত করে দেওয়া হবে: প্রধান উপদেষ্টা
স্বর্ণের দাম আবার কমলো
স্বর্ণের দাম আবার কমলো
সুস্থ তটিনী, তবে শুটিংয়ে ফেরার মতো নয়
সুস্থ তটিনী, তবে শুটিংয়ে ফেরার মতো নয়