X
মঙ্গলবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৪
৩ বৈশাখ ১৪৩১
রাজধানীর গণপরিবহন

ই-টিকিটিংয়ে চালক-সহকারীদের অনীহা, যাত্রীদের ভোগান্তি

আব্দুল হামিদ
১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০আপডেট : ১২ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ১২:০০

রাজধানীতে গণপরিবহনে বাস ভাড়ায় শৃঙ্খলা ফেরাতে গত বছরের সেপ্টেম্বর থেকে পরীক্ষামূলকভাবে চালু হয় ‘ই-টিকিটিং’ ব্যবস্থা। পরে পর্যায়ক্রমে রাজধানীভিত্তিক অধিকাংশ বাসেই চালু করা হয়েছে এই ব্যবস্থা। এতে করে নগরবাসী প্রত্যাশা করেছিলেন, ভাড়া নিয়ে দীর্ঘদিনের বিশৃঙ্খলা এবার একটা সমাধানে আসা যাবে। বাসে উঠে আর ভাড়া নিয়ে তর্কে জড়াতে হবে না। কিন্তু কিছুদিন যেতে না যেতেই সে আশায় গুড়ে বালি। এরই মধ্যে টিকিটের নামে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেওয়ার অভিযোগ উঠেছে। সারা রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো হলেও নির্দিষ্ট স্টপেজ থেকেই ভাড়া আদায়েরও অভিযোগ করছেন যাত্রীরা। আবার একই রুটে চলাচল করা বিভিন্ন কোম্পানির বাসের স্টপেজও ভিন্ন ভিন্ন, ভাড়ার বৈষম্য থাকে ই-টিকিটে। তবে সব ছাপিয়ে বড় অভিযোগ হলো, যারা এই উদ্যোগ বাস্তবায়ন করবেন, বাসের সেই চালক-সহকারীরা টিকিট দিতেই আগ্রহ প্রকাশ করছেন না। যাত্রীরা বলছেন, অনেক সময় বাসের সহকারীদের কাছ থেকে টিকিট চেয়ে নিতে হয় যাত্রীদের।  

গত বছর জ্বালানি তেলের দাম বাড়ানোর পর থেকে রাজধানীতে গণপরিবহনে (বাস) ভাড়া নিয়ে বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়। পরে শৃঙ্খলা ফেরাতে বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও শেষ পর্যন্ত ই-টিকিটেই এর সমাধান দেখছিল সরকারও। গত কয়েকদিন রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় বেশ কিছু বাসে যাতায়াত করে দেখা যায়, ই-টিকেটের নামে যাত্রীদের থেকে বেশি ভাড়া রাখছেন বাসের সহকারীরা। এ নিয়ে যাত্রী ও সহকারীদের মধ্যে বাগবিতণ্ডার ঘটনাও ঘটছে। তবে দেখা গেছে, ই-টিকিটের নির্ধারিত ভাড়া না নিলেও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই টিকিট দিচ্ছেন না তারা। এছাড়া সারা রাস্তা থেকে যাত্রী ওঠালেও নির্দিষ্ট স্টপেজ থেকেই টিকিট দেওয়া হচ্ছে যাত্রীদের। এতে করে ক্ষোভ ঝাড়ছেন সাধারণ যাত্রীরা। তবে সিটি করপোরেশনের উদ্যোগে করা ‍‘নগর পরিবহনের’ সেবা নিয়ে সন্তুষ্ট সাধারণ যাত্রীরা। যেখানে দেখা গেছে, অন্যান্য পরিবহনের থেকে যাত্রী সেবার মান ভালো। এছাড়া টিকেটের মূল্য, স্টপেজ মেনেই যাত্রী ওঠা-নামা করছে নগর পরিবহন।

খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, ঢাকা শহরে ৬০টি কোম্পানির ৩ হাজার ৩১৪টি বাস রয়েছে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন শহর থেকেও ঢাকায় প্রবেশ করে আরও ৩৭টি কোম্পানির আরও ২ হাজার ৩৩৬টি বাস। সবমিলিয়ে ঢাকা শহরে মোট ৯৭ কোম্পানির ৫ হাজার ৬৫০ বাস চলাচল করে। এরমধ্যে প্রথম ধাপে মিরপুরকেন্দ্রিক ৩০টি বাস কোম্পানিকে ই-টিকিটিংয়ের আওতায় আনা হয়। আর দ্বিতীয় ধাপের ১৫টি মিলিয়ে মোট ৪৫টি কোম্পানি ই-টিকিট ব্যবস্থা চালু হয়েছে।

রাজধানীর মোহাম্মদপুর থেকে ছেড়ে আসা মিডলাইন পরিবহন, বিকল্প পরিবহন, রমজান পরিবহন, বাহন পরিবহন, যাত্রাবাড়ী থেকে ছেড়ে আসা গাবতলী এক্সপ্রেস (৮ নম্বর) বাস, ট্রান্স সিলভা লিমিটেড এবং মঞ্জিল পরিবহন লিমিটেডের বিরুদ্ধে অভিযোগ পাওয়া গেছে সবচেয়ে বেশি।

অনেকেই মনে করেন, বাসে ই-টিকেট চালু থাকলে যাত্রী হয়রানি কমবে। কারণ কোনও বাসে যাত্রী হয়রানি হলে ওই বাসের টিকেট দেখে বাসের নম্বর, সহকারীর নাম ও কর্তৃপক্ষের নম্বর পাওয়া যায়। তবে অন্য বাসের টিকেটে ইস্যুকারী নাম-বয়স দেওয়া থাকলেও মিডলাইন পরিবহনে তেমন তথ্য নেই।

সম্প্রতি মিডলাইন পরিবহনের কয়েটি বাসে বেশ কিছু সময় চলাচল করে দেখা গেছে, একটি বাসে তিন স্টপেজ থেকে ওঠা তিন যাত্রীর কাছ থেকে একই ভাড়া নেওয়া হয়েছে। এটা নিয়ে বাসের সহকারীর সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়াতে দেখা গেছে যাত্রীদের। তাদের টিকেট সংগ্রহ করে দেখা যায়, তাদের একজন মোহাম্মদপুর, একজন ধানমন্ডি-১৫ এবং একজন জিগাতলা থেকে বাসে উঠেছেন। প্রত্যেকেই নামবেন গুলিস্তানে। কিন্তু সবার কাছ থেকেই ২০ টাকা করে ভাড়া রাখছেন বাসের সহকারী।

এ বিষয়ে মাসুম বিল্লাহ নামে এক বাস যাত্রীর সঙ্গে কথা হয় বাংলা ট্রিবিউনের। তিনি বলেন, এই দেখেন আমাদের তিন জনের কাছ থেকে কীভাবে ভাড়া নিলো। আগে (ই-টিকেট) কখনও ১০ টাকা-১৫ টাকা, আবার কখনও ২০ টাকাও ভাড়া দিতাম। এখন যেখান থেকেই উঠি ২০ টাকা দিতে হচ্ছে। কিছু বললেই বলে টিকিটের দাম এটাই নির্ধারণ করা, আমাদের কিছু করার নাই। এছাড়া বাস ভাড়া দেওয়ার পর কন্ডাক্টর পজ মেশিন থেকে সমপরিমাণ মূল্যের টিকিট দিচ্ছেও না। অনেক সময় টিকেট ছাড়া ভাড়া কমও রাখছে। এজন্য সাধারণ যাত্রীদের টিকেটের ওপর থেকে আস্থা উঠে যাচ্ছে।

রুবেল আহমেদ নামে আরেক যাত্রী আক্ষেপ করে বলেন, ই-টিকেট আসার পরে ভাবছিলাম ভাড়া নৈরাজ্যের একটা বিহিত হয়েছে। কিন্তু স্বস্তির দিনগুলো বেশিদিন থাকলো না। আপনি দেখেন, বাসের সহকারীদের গলায় পজ মেশিন ঝোলানো রয়েছে। কিন্তু যাত্রীদের কাছ থেকে ভাড়া নেওয়ার পর টিকিট আর দিচ্ছে না। যাত্রীদের কেউ চাইলে টিকিট দিচ্ছে, আর না চাইলে ভাড়া নিয়েই চলে যাচ্ছে। টিকিট দেওয়ার কোনও ইচ্ছাই তাদের নেই।

এ বিষয়ে বাসের সহকারীর কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আপনি টিকেট কাটার পজ মেশিন দেখেন। এখানে ভাড়া যা নির্ধারণ করা, সেটাই আমরা নিচ্ছি। আমরা তো বেশি নিচ্ছি না। এখন যাত্রীদের কোনও অভিযোগ থাকলে টিকেটি নম্বর আছে ফোন করে অভিযোগ দিতে পারেন। মালিকপক্ষ পজ মেশিন ঠিক করে দিলে আমরা সেই ভাড়া নিতে পারবো।’

বিভিন্ন বাসে ঘুরে দেখা গেছে, বাসের সামনে পজ মেশিন রেখে ভাড়া আদায় করছে। কোনও যাত্রী টিকিট নিয়ে তর্ক করলে তখন বাধ্য হয়ে সামনে থেকে মেশিন এনে টিকিট দিচ্ছে। এক্ষেত্রেও সহকারীরা অজুহাত হিসেবে বলছেন পজ মেশিনের কাগজ শেষ হয়ে গেছে, ফিলিং স্টেশনে মেশিন চার্জে দিয়ে এসেছে। রাতের বেলা টিকিট কাটা হয় না, এমন কথাও যাত্রীদের শুনতে হয়েছে। সিটিং সার্ভিসের গাড়ি, যে কারণে যাত্রীরা পুরো বাসেই দাঁড়িয়ে যাওয়ায় সবাইকে টিকিট দেওয়া সম্ভব না বলেও অভিযোগ করেন বাসের সহকারীরা।

বিকল্প পরিবহনে মতিঝিল, পল্টন ও শাহবাগ পজ মেশিনে স্টপেজ দেওয়া। কিন্তু সারা রাস্তা থেকে যাত্রী ওঠাচ্ছে। কোনো যাত্রী কথা না বলে ভাড়া দিলে, যেখান থেকে উঠছে তার পেছনের স্টপেজ থেকে টিকেট দিচ্ছে। কোনও যাত্রী এ নিয়ে প্রতিবাদ করলে তাকে সামনের স্টপেজ থেকে টিকিট দিচ্ছে। এ অবস্থায় মতিঝিল সিটি সেন্টার ও দৈনিক বাংলা মোড় থেকে যাত্রী উঠালেও মতিঝিলের টিকেট দেওয়া হচ্ছে ১৫ টাকা। তবে কোনও যাত্রী ধমক দিয়ে কথা বললে, পুরান পল্টন মোড় থেকে কারওয়ান বাজার ১০ টাকার টিকিটও দিচ্ছে। তবে নগর পরিবহনে নটরডেম কলেজের সামনে থেকে কারওয়ান বাজার ১৫ টাকা ভাড়া রাখছে। গাবতলী এক্সপ্রেস (৮নং) বাস দৈনিক বাংলা মোড় থেকে কাওরান বাজার ১৩ টাকা ভাড়া নেয়।

গাবতলী এক্সপ্রেস (৮নং) বাসের সহকারী সুজন মিয়া বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ই-টিকেটে সুবিধা আছে। এখন কোনও যাত্রীর সঙ্গে কেওয়াজ করতে হয় না। টিকিট দিলেই ভাড়া দিয়ে দেয়। কিন্তু টিকেট কাটা পজ মেশিনে যদি স্টপেজ নিধারর্ণ করে দেয়, সেখানে আমাদের কিছু করার থাকে না। এটা কর্তৃপক্ষ ভালো বলতে পারবেন।

টিকেট না দেওয়ার বিষয়ে চানতে চাইলে সুজন মিয়া বলেন, অনেক সময় দেখা যাচ্ছে কোনও যাত্রীর কাছে টাকা কম আছে, সে ক্ষেত্রে টিকেট দেওয়া হয় না। আবার অনেক সহকারী নিজের লাভের জন্য টিকেট দিতে চায় না। টিকিটে অভিযোগ নম্বর আছে, যাত্রীরা অভিযোগ করতে পারেন। কিন্তু আমাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা জড়ায়, কেউ ফোন করে অভিযোগ দেয় না।

ই-টিকেটির বিষয়ে নিয়ে ভিন্ন কথা বলছেন আরেক বাসের সহকারী আকবর হোসেন। তিনি বলেন, ই-টিকেট কিছুই না। এটা দিলেও কিছু না, আবার না দিলেও কোনও সমস্যা নেই। কোনও যাত্রী চাইলে দেওয়া হয়, না চাইলে না। বাস আমাদের চুক্তি নেওয়া। এখন কীভাবে চালাবো, সেটা আমরা বুঝবো। এখানে মালিকের কোনও কিছু দেখার নেই। তিনি টাকা পাইলেই হলো। এ বিষয়ে আরও বেশ কয়েকটি বাসের চালক-সহকারীর সঙ্গে কথা বলে এর সত্যতা পাওয়া গেছে।

রাজধানীতে বাসের স্টপেজ নির্ধারিত, কিন্তু যাত্রী তোলা হচ্ছে সারা রাস্তা থেকেই। তাছাড়াও ইটিকিটিংও দেওয়া হচ্ছে না— এসব বিষয়ে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির মহাসচিব খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, চলতি মাসের ২৮ ফেব্রুয়ারির মধ্যে রাজধানীতে চলাচলকারী বাসে ই-টিকেটের আওতায় নিয়ে আসা হবে। এতে অতিরিক্ত ভাড়া, গণপরিবহনে নৈরাজ্য আর দুর্ঘটনা কমে আসবে বলে মনে করি। আমরা সেই বিষয়টি নিয়েই কাজ করছি। দেশে ই-টিকেট নতুন চালু হয়েছে। অনেক সমস্যা দেখা যাচ্ছে, এসব বিষয় নিয়ে ৯টি স্পেশাল টিম মাঠে কাজ করছে। সব কিছুই ঠিক হয়ে যাবে।

আর ই-টিকেট না দেওয়ার অভিযোগের বিষয়ে খন্দকার এনায়েত উল্যাহ বলেন, বাসের সহকারীরা টিকেট না দেওয়ার বিষয়ে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। কোন রুটের কোন বাসে এমনটা হচ্ছে সেটা সজর রাখছি। এ বিষয়ে বাস মালিকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। এছাড়া এখনও যারা চুক্তিভিত্তিক বাস চালাতে দিচ্ছে তাদের ওপরেও নজরদারি করা হচ্ছে।

/এসটিএস/ইউএস/
সম্পর্কিত
ভাসানটেকে সিলিন্ডার বিস্ফোরণ: একে একে চলে গেলেন ৩ জন
স্থায়ী জামিন পেলেন না ড. ইউনূস
সন্তানদের উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন পূরণ হয়েছে চা বিক্রেতা মনিরুজ্জামানের
সর্বশেষ খবর
টেস্ট পরীক্ষার নামে অতিরিক্ত ফি নিলে ব্যবস্থা
টেস্ট পরীক্ষার নামে অতিরিক্ত ফি নিলে ব্যবস্থা
আবহাওয়ার খবর: ঢাকাসহ ৪ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলা বৃষ্টির আভাস
আবহাওয়ার খবর: ঢাকাসহ ৪ বিভাগে ঝড়ো হাওয়াসহ শিলা বৃষ্টির আভাস
বিলেতে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন নতুন আসা বাংলাদেশিরা: কমিউনিটিতে প্রতিক্রিয়া
বিলেতে নানা অপরাধে জড়িয়ে পড়ছেন নতুন আসা বাংলাদেশিরা: কমিউনিটিতে প্রতিক্রিয়া
হিটলারের চেয়েও ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হয়েছে নেতানিয়াহু: কাদের
হিটলারের চেয়েও ভয়ংকর রূপে আবির্ভূত হয়েছে নেতানিয়াহু: কাদের
সর্বাধিক পঠিত
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
শেখ হাসিনাকে নরেন্দ্র মোদির ‘ঈদের চিঠি’ ও ভারতে রেকর্ড পর্যটক
৪ দিনেই হল থেকে নামলো ঈদের তিন সিনেমা!
৪ দিনেই হল থেকে নামলো ঈদের তিন সিনেমা!
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
বিসিএস পরীক্ষা দেবেন বলে ক্যাম্পাসে করলেন ঈদ, অবশেষে লাশ হয়ে ফিরলেন বাড়ি
চাসিভ ইয়ার দখল করতে চায় রাশিয়া: ইউক্রেনীয় সেনাপ্রধান
চাসিভ ইয়ার দখল করতে চায় রাশিয়া: ইউক্রেনীয় সেনাপ্রধান
বাজারে ক্রেতা নেই: তবু ব্রয়লারের কেজি ২৩৫, গরু ৮০০
বাজারে ক্রেতা নেই: তবু ব্রয়লারের কেজি ২৩৫, গরু ৮০০