সৌদি আরব, কাতারসহ উপসাগরীয় সহায়তা পরিষদের (জিসিসি) ছয়টি রাষ্ট্রে কম বেতনের অভিবাসী শ্রমিকরা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে ক্রমবর্ধমান ঝুঁকির মধ্যে আছেন। এই ঝুঁকিগুলো কর্মক্ষেত্র থেকে তৈরি হয়। অন্যদিকে কম আয়ের অভিবাসী কর্মীদের জন্য জিসিসি রাষ্ট্রগুলোতে স্বাস্থ্যসেবার সহজপ্রাপ্তি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ তাদের কাজের ফলে একাধিক প্রতিকূল স্বাস্থ্য পরিস্থিতি তৈরি হতে পারে। জিসিসিভুক্ত দেশগুলোর স্বাস্থ্য পরিষেবায় সাধারণত এই জনসংখ্যার নির্দিষ্ট চাহিদার জন্য তৈরি করা হয় না। অভিবাসী কর্মীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তির ক্ষেত্রে ‘বৈষম্যের স্পষ্ট প্রমাণের সঙ্গে নথিভুক্তকরণ’ এবং ‘ক্রয়ক্ষমতার অভাব’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বাধা হিসেবে রয়েছে।
বুধবার (৭ জুন) রাজধানীর হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালে রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্ট রিসার্চ ইউনিট (রামরু) আয়োজিত উপসাগরীয় অঞ্চলে প্রবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি বিষয়ে আয়োজিত এক কর্মশালায় গবেষণার এসব তথ্য তুলে ধরেন রামরুর নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক সি আর আবরার।
প্রতিবেদনে বলা হয়, স্বল্প বেতনের অভিবাসী কর্মীদের অ-জরুরি স্বাস্থ্যসেবার সহজপ্রাপ্তি না থাকায় তা তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে এবং এটি প্রতিরোধযোগ্য এবং ‘ব্যাখ্যাতীত’ মৃত্যুর উচ্চহারের ক্ষেত্রে একটি উল্লেখযোগ্য কারণ হতে পারে। এ অঞ্চল ধীরে-ধীরে বাধ্যতামূলক ব্যক্তিগত স্বাস্থ্যবীমা ব্যবস্থায় স্থানান্তরিত হওয়ার ফলে স্বল্প বেতনের অভিবাসী কর্মীদের স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি উন্নত হওয়ার বদলে তা আরও সীমিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি।
রামরু পরিচালিত গবেষণার দ্বিতীয় এই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১ হাজার ১০১ জন স্বল্প বেতনের কুয়েতি অভিবাসীর মধ্যে ২০২২ সালের মে থেকে জুলাই মাসে পরিচালিত এক সমীক্ষার প্রতিবেদনে দেখা যায়, প্রয়োজনীয় নথিপত্রের অভাবে উপসাগরীয় দেশগুলোর সরকারি হাসপাতাল এবং প্রাইভেট ক্লিনিকগুলোতে সেবা নিতে অক্ষম স্বল্প বেতনের অভিবাসীরা। স্বল্প বেতনের অভিবাসী শ্রমিকেরা যে স্বাস্থ্যসেবার প্রতিবন্ধকতাগুলোর মুখোমুখি হয় তার মধ্যে খরচ একটি উল্লেখযোগ্য বাধা।
এছাড়া, কাগজপত্রের অভাব স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রে অনেক পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে। অনেক কর্মী নথিভুক্ত (বৈধ) নয় এবং তাদের আবাস ও কাজের পারমিট নেই, কারণ তাদের পারমিটের মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে, অথবা তারা পর্যটক ভিজিটর ভিসায় উপসাগরীয় অঞ্চলে এসেছেন। অনেকেই কর্মসংস্থানের জন্য বৈধ পদ্ধতিতে এসেছেন কিন্তু তাদের নিয়োগকর্তারা তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র পুনর্নবায়ন করেননি কিংবা সৌদি আরব এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের সকল বিদেশি কর্মীদের ক্ষেত্রে প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবীমা প্রদান করেননি। এই কারণগুলোর যে কোনো একটির অর্থ হতে পারে যে, অভিবাসী শ্রমিকেরা ভর্তুকিযুক্ত সাধারণ স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণ করতে পারেন না, এবং তাদের বেতনে থেকে বোঝা যায় ভর্তুকিযুক্ত সেবা প্রায়শই তাদের পক্ষে বহন করা সম্ভব হয় না।
এছাড়া সমীক্ষার তথ্য বলছে, নিয়োগকর্তারা নিজ খরচে অভিবাসী কর্মীদের চিকিৎসা করায় না, অভিবাসী কর্মীদের নিজ দেশের সম্পদ বিক্রি করতে হয় চিকিৎসা ব্যয় মেটাতে, নারী অভিবাসী কর্মীরা মৌখিক, শারীরিক এবং যৌন নির্যাতনের ঝুঁকিতে থাকে এবং স্বাস্থ্য সেবা না মিললে নিজ উদ্যোগে ওষুধ সেবন করতে হয়, যেখানে কোন কোন ক্ষেত্রে মেয়াদহীন ওষুধ সেবন করা লাগে।
অধ্যাপক সি আর আবরার গবেষণার তথ্য জিসিসি রাষ্ট্রগুলোর কাছে কিছু সুপারিশ তুলে ধরেন। এর মধ্যে আছে অল্প বেতনের অভিবাসীকর্মীদের কাগজপত্র থাকা না থাকা নির্বিশেষে তাদের জন্য সমস্ত প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যসেবা বিনামূল্যে প্রদান করা, কাগজপত্রবিহীন কর্মীদের অথবা অন্তঃসত্ত্বা নারী কর্মীকে চিকিৎসা দেওয়ার আগে চিকিৎসকদের যদি কর্তৃপক্ষকে জানানোর কোন বিধান থাকে তা বাতিল করা, গৃহকর্মীদের জন্য প্রতিনিয়ত এবং বাধ্যতামূলক স্বাস্থ্যপরীক্ষা ব্যবস্থা প্রণয়ন করা, স্বাস্থ্য সেবা নিতে কর্মীদের বাধা প্রদানকারী নিয়োগকর্তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া।
গবেষণায় কর্মীর উৎস দেশগুলোর ক্ষেত্রে পরামর্শ হিসেব বলা হয়, অভিবাসীকর্মীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি উন্নত করতে জিসিসি রাষ্ট্রগুলোর সরকারদের প্রকাশ্যে চাপ দেওয়া এবং বিদ্যমান বাধাগুলো তুলে ধরা ও সেগুলো অপসারণের আহ্বান জানানো। দ্বিপাক্ষিক পর্যায়ে এবং জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের মতামতসহ, জিসিসি রাষ্ট্রগুলোর সাথে সমস্ত দ্বিপাক্ষিক চুক্তি এবং সমঝোতা স্মারকে স্বচ্ছ এবং সুস্পষ্ট স্বাস্থ্যসেবার বিধান অন্তর্ভুক্ত করার উপর জোর দেওয়া। এগুলোর জন্য অর্থপূর্ণ এবং নিয়মিত রিভিউ প্রক্রিয়া চালু ও তা সক্রিয় করা।
কর্মশালায় অভিবাসন ও উন্নয়ন সংক্রান্ত সংসদীয় ককাসের সভাপতি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী বলেন, ‘গন্তব্য দেশে কর্মী মৃত্যুর পর সুরতহাল করা হয় না, আবার দেশে লাশ ফিরে আসার পরও করা হয় না। এখানে হবে না, ওখানেও হবে না তাহলে প্রকৃত চিত্র পাওয়া যাবে না। বিদেশগামী কর্মীর মেডিক্যাল টেস্ট অভিবাসন খরচ আরও বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে আমাদের যেসব সরকারি হাসপাতাল আছে, সেখানে বিনামূল্যে পরীক্ষার ব্যবস্থা করা দরকার। বিদেশ যাওয়ার আগে পরীক্ষা আর চার বছর পর যখন ফিরে আসবে তখন আরেকটি পরীক্ষা করলে বোঝা যাবে কাজ করতে গিয়ে কর্মীর কী কী শারীরিক ক্ষতি হয়েছে।’
জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের সার্বক্ষণিক সদস্য ও সাবেক সচিব সেলিম রেজা বলেন, ‘আমাদের কর্মীরা যত টাকা খরচ করে বিদেশ যায়, পৃথিবীর কোনও দেশ থেকে এতো টাকা লাগে না। কর্মী বিদেশ যাওয়ার আগে প্রাক-বহির্গমন প্রশিক্ষণে স্বাস্থ্য বিষয়ে কোনও ধারণা দেওয়া হতো না। এখন প্রশ্ন হচ্ছে- আমরা কি এভাবেই প্রশিক্ষণ ছাড়া অদক্ষ কর্মী পাঠাতে থাকবো? এগুলো পরিবর্তন হওয়া দরকার।’
কর্মশালায় অভিবাসন ও উন্নয়ন সংক্রান্ত সংসদীয় ককাসের মহাসচিব মাহজাবিন খালেদ, সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেলসহ অভিবাসন খাতের স্টেকহোল্ডাররা কর্মশালায় উপস্থিত ছিলেন।