X
মঙ্গলবার, ২১ মে ২০২৪
৭ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস

ঝুঁকিপূর্ণ শ্রমে জড়াচ্ছে ছিন্নমূল শিশুরা, আনা যাচ্ছে না মূলধারায়

সাদ্দিফ অভি
১২ জুন ২০২৩, ১৩:০২আপডেট : ১২ জুন ২০২৩, ১৩:১৮

জন্মের পর থেকেই মায়ের সঙ্গে সড়কেই বসবাস করতো ৯ বছর বয়সী মনসুর। ছোট বোনের জন্মের পর তার পরিবারের দায়িত্ব এসে পড়ে কাঁধে। বিভিন্ন সময় মায়ের সঙ্গে বস্তিতে বাসা ভাড়া নিয়ে থাকতো সে। কিন্তু ভাড়া দিতে না পারলে অনেক সময় বের করে দেওয়া হতো বলে জানায় এই শিশু। যে বয়সে স্কুলে যাওয়ার কথা, খেলাধুলায় মেতে থাকার কথা; বাধ্য হয়েই সে বয়সে পথে-ঘাটে ফেরি করে বেড়াতে হচ্ছে তাকে। প্রতিদিন তার যা আয় হয়, তাই দিয়ে চলে সংসার।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো এবং ইউনিসেফের যৌথ সমীক্ষা ‘পথ শিশু জরিপ-২০২২’ অনুযায়ী, ৯০ শতাংশ ছিন্নমূল শিশুশ্রমে জড়িত। ছেলেদের মধ্যে ৯২ শতাংশ এবং মেয়েদের মধ্যে ৮৪ শতাংশ বিভিন্ন কাজে জড়িত। সমীক্ষার তথ্য বলছে, প্রতি ৫ জনে একজন ছিন্নমূল শিশু ভাঙারি সামগ্রী সংগ্রহ করে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করে। এরপর সবচেয়ে বেশি জড়িত ভিক্ষাবৃত্তিতে। এছাড়া ১৫ শতাংশ শিশু দোকান, রেস্তোরাঁ, চায়ের দোকানে কাজ করে এবং ৯ শতাংশ শিশু পথেঘাটে ফেরি করে বেড়ায়।

আজ বিশ্ব শিশুশ্রম প্রতিরোধ দিবস। ‘সবার জন্য সামাজিক ন্যায়বিচার, শিশুশ্রম বন্ধ করি’ প্রতিপাদ্যকে সামনে রেখে বিশ্বজুড়ে দিবসটি পালিত হচ্ছে। দিবসটি পালন উপলক্ষে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) এবং ইউনিসেফসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক এবং দেশীয় বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। কর্মসূচি পালনে এসব সংস্থার সাথে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সমন্বয় করবে। গত বছরের মার্চে কাজে যোগদানের সর্বনিম্ন বয়স সংক্রান্ত আইএলও কনভেনশন ১৩৮ অনুসমর্থন করেছে বাংলাদেশ। এই কনভেনশন অনুসারে ১৪ বছরের নিচে কাউকে কাজে নিয়োগ দেওয়া যাবে না।  

জরিপের তথ্য বলছে, ছিন্নমূল শিশুরা কুলির কাজ, পরিবহন শ্রমিকের কাজ, গাড়ি মেরামত, কলকারখানা, গৃহকর্মী, পানি বিক্রি, ফুল বিক্রি, নির্মাণ কাজ, গাড়ি ধোয়া, ময়লা সংগ্রহ এবং টয়লেট পরিষ্কারসহ নানা কাজে নিয়োজিত আছে। এছাড়া দারিদ্রের কারণে নানা ধরনের অপরাধেও জড়িয়ে যাচ্ছে ছিন্নমূল শিশুরা।

জরিপে আরও জানা যায়, অর্ধেকের বেশি শিশু এই বয়সে কাজ করাটা পছন্দ না করলেও পরিবার চালাতে করতে হচ্ছে বাধ্য হয়েই। দেশের মোট ছিন্নমূল শিশুর ৩৭ দশমিক ৮ শতাংশ দরিদ্রতার কারণে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পথেই আশ্রয় নিয়েছে। ১৫ দশমিক ৪ শতাংশ বাবা-মা শহরে আসার কারণে এবং ১২ দশমিক ১ শতাংশ কাজের সন্ধানে বাড়ি ছেড়ে শহরে এসে পথেই ঠাঁই পেয়েছে। জরিপ থেকে জানা যায়, রাস্তায় থাকা শিশুদের সেবা প্রদান করে এমন সংস্থাগুলোর মাধ্যমে তারা যে সহায়তা পেতে পারে, সে সম্পর্কে বেশির ভাগ শিশুই অবগত ছিল না।

ফাইল ছবি

এসব ছিন্নমূল শিশু আবার বাড়িতে ফিরতে চায় কি না, জরিপে এমন প্রশ্নের উত্তরে ৬৪ শতাংশই বলেছে, তারা আবার বাড়ি ফিরে যেতে চায় না। কেন বাড়ি ফিরতে চায় না এমন প্রশ্নের উত্তরে ৩৬ দশমিক ৩ শতাংশ ছিন্নমূল শিশু বলেছে, পরিবারে শান্তি না থাকায় তারা বাড়ি ফিরতে চায় না। আবার অন্যদিকে শিশুদের ৭৯ শতাংশের বেশি স্বাধীনতা না থাকার কারণে পুনর্বাসন কেন্দ্রে থাকতে চায় না বলেও জানিয়েছে।

বিশ্ব শিশু শ্রম দিবস উপলক্ষ্যে দেওয়া এক বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘সরকার দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম তথা শিশুদের শিক্ষা, নিরাপত্তা ও সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।’

তিনি বলেন, ‘শিশুদের জন্য নিরাপত্তা, খাদ্য ও পুষ্টি, আশ্রয় ও সুরক্ষা এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের মতো মৌলিক বিষয় সম্পর্কিত নানাবিধ কর্মসূচিসহ শিশুশ্রম বন্ধ করার লক্ষ্যে সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর আওতায় টেকসই উন্নয়ন নীতি বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। শিশুশ্রম-নিরসনে শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় বিভাগীয়, জেলা ও উপজেলা কমিটিগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধিতে কাজ করছে।’

বিশেষজ্ঞদের মতে, শিশুশ্রম বন্ধে অনেকে কাজ করলেও সমন্বয়হীনতার কারণে ছিন্নমূল শিশুদের মূলধারায় নিয়ে আসা যাচ্ছে না। দেশের মোট জনসংখ্যার ৪০ শতাংশ শিশু এরমধ্যে ১৫ শতাংশ হচ্ছে সুবিধাবঞ্চিত শিশু। বাংলাদেশ শিশু আইন ’১৩ এর ৮৯ অনুচ্ছেদে ১৬টি ক্যাটাগরিতে সুবিধাবঞ্চিত শিশুর কথা বলেছে। বিশ্ব শিশু অধিকার সপ্তাহ ২০১৫ এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে ছিন্নমূল শিশু পুনর্বাসনের বিষয়ে সুস্পষ্ট নির্দেশনা প্রদান করেন। 

তিনি বলেন, ‘আমাদের শিশুরা কেন রাস্তায় ঘুরবে? একটা শিশুও রাস্তায় ঘুরবে না। একটা শিশুও এভাবে মানবেতর জীবন যাপন করবে না।’ এই লক্ষ্যে সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসহ সবাইকে একযোগে ছিন্নমূল শিশুদের পুনর্বাসনের জন্য কাজ করার জন্য পরামর্শ দেন তিনি। এই নির্দেশনার ওপর ভিত্তি করে মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয় ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে একটি জরিপ চালায়। পরে ২০১৬ সাল থেকে ছিন্নমূল শিশু পুনর্বাসনের লক্ষ্যে কার্যক্রম হাতে নেওয়া হয়।

ছন্নমূল শিশু (ফাইল ছবি)

ইউনিসেফের চাইল্ড প্রোটেকশন অফিসার ফাতেমা খায়রুন্নাহার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বাংলাদেশে চাইল্ড পলিসি আছে। কিন্তু ছিন্নমূল শিশুদের জন্য কোনও সুনির্দিষ্ট কর্মপরিকল্পনা নেই। মহিলা ও শিশু মন্ত্রণালয়, সমাজসেবা অধিদফতরের কিছু কার্যক্রম আছে ঝুঁকিতে থাকা এসব শিশুদের জন্য। কিছু শেল্টার হোম আছে। কিন্তু সারা দেশে এগুলো বড় বড় শহরের মধ্যে সীমাবদ্ধ। কিছু কিছু কার্যক্রম থাকলেও জাতীয় পর্যায়ে কোনও কৌশল নেই ছিন্নমূল শিশুদের জন্য।’

তিনি আরও বলেন, ‘সারা দেশে অনেকেই ছিন্নমূল শিশুদের নিয়ে কাজ করছে কিন্তু এর মধ্যে সমন্বয় নেই। আর এখানে চাইল্ড প্রোটেকশন সিস্টেম ততটা মজবুত না, যাতে প্রতিরোধ এবং রেসপন্স দুটো জায়গায় কাজ করা যায়, সেখানেও ঘাটতি আছে।’

স্ট্রিট চিলড্রেন অ্যাক্টিভিস্টস্ নেটওয়ার্কের (স্ক্যান) মতে, সরকারের সহযোগী প্রতিষ্ঠান হিসেবে বেসরকারি সংস্থাগুলো সুবিধাবঞ্চিত ও ছিন্নমূল শিশুদের অধিকার প্রতিষ্ঠা, তাদের শারীরিক, মানসিক ও নৈতিক বিকাশ, একাডেমিক শিক্ষার ব্যবস্থা, ভরণ-পোষণ এবং ভবিষ্যত জীবনে স্বাবলম্বী করে মূলধারায় ফিরিয়ে আনতে প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ।

স্ক্যানের সভাপতি জাহাঙ্গীর নাকির বলেন, ‘শিশুদের নিয়ে সরকারি কিংবা বেসরকারি কোনও কাজই পারফেক্ট না। অর্থাৎ যেভাবে হওয়া দরকার সেভাবে হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে শিশুদের নিয়ে কাজ করার মধ্যে সমন্বয়হীনতা তো আছেই। আমরা অনেক দিন থেকে বলে আসছি যে, একটি আলাদা শিশু অধিদফতর করার জন্য। বাজেটে একাধিকবার প্রস্তাব করা হলেও পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন আজও হয়নি। দেশের ৪০ শতাংশ জনসংখ্যা শিশু আর তাদের জন্য দফতর থাকবে না এটা হতে পারে না।’

তিনি আরও বলেন, ‘যেসব কাজ করা হচ্ছে এগুলো অত্যন্ত স্বল্পমেয়াদি কাজ। দীর্ঘমেয়াদি কাজের মধ্যে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তার জন্য বেশি করে শেল্টার হোম করতে হবে। আবার শুধু শেল্টারহোম করলে হবে না তার জন্য পরিচালনার একটি গাইডলাইন থাকতে হবে। কারণ সম্প্রতি জরিপে জানা গেছে,৭৯ শতাংশ ছিন্নমূল শিশু শেল্টার হোমে থাকতে চায় না। কারণ সেখানের নিয়ম কানুন তারা মানতে চায় না। তাহলে তাদের উপযোগী করে পুনর্বাসনের কাজ করতে হবে।’

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, ছিন্নমূল শিশুদের সংখ্যা বিগত দিনগুলোর চেয়ে বেড়েছে। প্রকৃত সংখ্যা না জেনে বাস্তবভিত্তিক পরিকল্পনা তৈরি করা কষ্টদায়ক হবে।

/ইউএস/
সম্পর্কিত
নাটবল্টুর সঙ্গেই কাটছে শৈশব-কৈশোর
১০ বছরের শিশুও জানে ‘দিনে কাজ ১২ ঘণ্টার’
প্রাতিষ্ঠানিক কল-কারখানায় কোনও শিশুশ্রম নেই: প্রতিমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
পরীর মনে ‘সুপ্তি’র মায়া
পরীর মনে ‘সুপ্তি’র মায়া
রাজধানীতে চাঁদা আদায়ের সময় গ্রেফতার ১৩  
রাজধানীতে চাঁদা আদায়ের সময় গ্রেফতার ১৩  
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি
টিপু-প্রীতি হত্যা মামলায় সাক্ষ্যগ্রহণ হয়নি
ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২৮ জুন
ইরানে প্রেসিডেন্ট নির্বাচন ২৮ জুন
সর্বাধিক পঠিত
ঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে
প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশ, জানালেন ওবায়দুল কাদেরঢাকায় ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চলবে
ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নিহত হলেন যারা
ইরানের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে নিহত হলেন যারা
পাউবোর দুই প্রকৌশলীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
পাউবোর দুই প্রকৌশলীসহ তিনজনের বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
সাবেক সেনাপ্রধান আজিজ আহমেদের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা
‘বাংলাদেশ দলে খেলতে না পারলে আমি মরে যাবো না’
‘বাংলাদেশ দলে খেলতে না পারলে আমি মরে যাবো না’