কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন মার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের বেশ কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। আগুন লাগর সবগুলো ঘটনাই কাছাকাছি ধরনের। ভোররাতের আগুনে নির্জন মার্কেটগুলো পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। সর্বশেষে মোহাম্মদপুর এলাকার কৃষি মার্কেটেও ঘটেছে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ড। আগুনে সব হারানো ব্যবসায়ীরা নতুন করে জীবিকা চালানোর চেষ্টা শুরু করলেও ভয়-আতঙ্ক তাদের তাড়া করে ফিরছে।
গত ৪ এপ্রিল বাংলাদেশে পাইকারি কাপড়ের অন্যতম বড় আড়ত রাজধানী ঢাকার বঙ্গবাজারে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে হাজার হাজার ব্যবসায়ী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। একই মাসে, ১৫ এপ্রিল রাজধানীর ঢাকা নিউ সুপার মার্কেটে আরেকটি বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড ঘটে। নিউমার্কেট দোকান মালিক সমিতির হিসাবে, আগুনে মার্কেটের সাড়ে তিনশ কোটি টাকার মালামাল পুড়ে গেছে। পুড়ে যায় ২২৬টি দোকান।
শুক্রবার (২২ সেপ্টেম্বর) বঙ্গবাজার ও নিউ সুপার মার্কেট ঘুরে ব্যবসায়ীদের খোঁজ-খবর নেন বাংলা ট্রিবিউনের এ প্রতিবেদক। ভুক্তভোগী ব্যবসায়ীরা বলেন, বর্তমানে না আছে তাদের পর্যাপ্ত পুঁজি, না আছে আগের মতো ব্যবসা। বঙ্গবাজারে অস্থায়ীভাবে ছাউনি টানিয়ে ব্যবসায়ীরা যে যার মতো ব্যবসা করছেন। এই ছাউনির কোনও ভরসা নেই। যেকোনও সময় উচ্ছেদের আতঙ্ক আছে। আবার এরই মধ্যে রাজধানীর অন্যান্য মার্কেটে আগুন দেখে তারা আতঙ্কগ্রস্ত। নানারকম শঙ্কায় তাদের দিন কাটছে।
বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ী ফরহাদ খান। বঙ্গবাজারে কাঠের মার্কেটে নিউ খাঁন ফ্যাশন নামে দুটি দোকান ছিল তার। দোকানটিতে বাচ্চাদের শার্ট, গেঞ্জি বিক্রি করতের তিনি। অগ্নিকাণ্ডে তার দুটি দোকানই পুড়ে ছাই হয়ে যায়। সব হারিয়ে দিশেহারা ফরহাদ ভেবে পাচ্ছিলেন না কোথায় যাবেন, কী করবেন। মার্কেটের ধ্বংসস্তূপ সরানোর পর ছাউনি টাঙিয়ে সীমিত আকারে ব্যবসা করার সুযোগ মিলেছে। ফরহাদও চৌকি নিয়ে বসেন সেখানে।
বাংলা ট্রিবিউনকে ফরহাদ বলেন, গত ১৭ বছর ধরে ব্যবসা করছি বঙ্গবাজারে। আমার দুটি দোকানে ২৬ লাখ টাকার মালামাল ছিল। সব আগুনে পুড়েছে। এখন তো কিছুই নেই। ঋণ করে ব্যবসা করছি। একদিকে মার্কেটে আগের চার ভাগের এক ভাগও বিক্রি নেই। অস্থায়ীভাবে ছাউনি পেতে ব্যবসা করছি। যেকোনও সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে। হলে বিকল্প পথ কি হবে জানি না।
বঙ্গবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত আরেকজন ব্যবসায়ী সিফাত গার্মেন্টসের ব্যবস্থাপক মো. দীন ইসলাম। ওই ব্যবসায়ী কাঠের মার্কেটের নিচতলার একটি দোকানে বিক্রি করতেন মেয়েদের ওয়ান পিস ও টু পিস জাতীয় পোশাক। অগ্নিকাণ্ডের পর গোডাউনে বেঁচে যাওয়া কাপড় দিয়ে অস্থায়ীভাবে ব্যবসা শুরু করেন তিনি। এই ব্যবসায়ী বলেন, আমাদের কখন কী করবে আমরা জানি না। বসার সুযোগ দিয়েছে, বসছি। সবই তো গেলো। এভাবে তো ব্যবসা করা যায় না। কাস্টমার নাই। সিটি করপোরেশন কী করবে তারাই ভালো জানে। আমরা অস্থায়ীভাবে ব্যবসা করে যাচ্ছি। কত বছর ব্যবসা করছি। এ বছরই দেখলাম মার্কেটে মার্কেটে আগুন লাগতে। সোজা কথা আমরা অনিশ্চয়তায় মধ্যে আছি। না ভালো ব্যবসা হচ্ছে এখানে, না নতুন কোনও জায়গায় যেতে পারছি।
বঙ্গবাজারের জননী গার্মেন্টস নামে একটি দোকান ছিল মো. বোরহানের। বিক্রি করতেন মেয়েদের টি শার্ট। অগ্নিকাণ্ডে তার দোকানের ১০ লাখ টাকার মালামাল পুড়েছে জানিয়ে বোরহান বলেন, আগে কাপড়ের দোকানে কর্মচারী হিসেবে কাজ করতাম। পাঁচ বছর হলো নিজে ব্যবসা দিয়েছি। এরই মধ্যে আগুন লেগে সব শেষ। নিজের ক্যাশ টাকাই ছিল। এখন ধারদেনা করে ব্যবসা চলছে। মাথায় হাত দিয়ে এখন বসে থাকতে হয়। এই অবস্থার কখন উন্নতি হবে জানি না। অগ্নিকাণ্ডের পর শুনেছি ক্ষতিগ্রস্ত মালিকরা টাকা পাবে। কোথায়, আমরা তো কিছুই পেলাম না। শুনেছি প্রধানমন্ত্রীর পক্ষ থেকে একটি অনুদান আসবে, তারপর আমাদের দেবে।
জননী ফ্যাশনের পাশের দোকানের আরেক ব্যবসায়ী মো. ইউসুফ বলেন, শুনছি এ মাসে মার্কেট ভাঙবে, সে মাসে ভাঙবে। মালিকরা টাকা পাবে। যারা আমাদের মতো ভাড়া দোকান নিয়ে ব্যবসা করে আমাদের কি আসলে দোকান দেবে? এসব ভেবেই এখন আমাদের দুর্চিন্তায় সময় কাটছে।
এদিকে নিউ সুপার মার্কেটে গেলে দেখা যায়, অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া প্রতিটি দোকান নতুনভাবে তৈরি করা হয়েছে। আগের মতো ব্যবসা না থাকলেও বঙ্গবাজার থেকে অনেকটা ভালোই চলছে এখানে। ক্ষতিগ্রস্ত ব্যবসায়ীদের দাবি, মার্কেটে যাতায়াতের জন্য যে ব্রিজটি ছিল, অগ্নিকাণ্ডের পর সেটি ভেঙে ফেলায় ক্রেতা অর্ধেকের নিচে নেমে এসেছে। এছাড়া অগ্নিকাণ্ডে ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অনেক ব্যবসায়ী মার্কেট ছেড়ে চলে গেছেন।
নিউ সুপার মার্কেটের রেজোয়ান ক্লাব দোকানের মালক দিপু শেখ বলেন, আগুনে আমার ১২ থেকে ১৩ লাখ টাকার মালামাল পুড়েছে। অনুমতি পাওয়ার পর দোকানে নতুনভাবে কাজ করি। কোরবানির ঈদের পর দোকান চালু করেছি। নতুন করে পুঁজি সংগ্রহ করে ১৫ থেকে ২০ লাখ টাকার মালামাল কিনতে হয়েছে। এখন শর্ত মোতাবেক মাল বিক্রি করছি। মাল বিক্রি করে টাকা দেবো। নিউ সুপার মার্কেট এ এখন আর আগের মতো নেই। ক্রেতা কম থাকলে যেমন হয় আরকি। ব্যবসা কমে গেছে। সবাই ধারদেনার ওপরে ব্যবসা করছে। এছাড়া উপায় কী!
মার্কেটের তিন তলার আরেকজন ব্যবসায়ী রিফাত হোসেন। ‘জিমি স্কো’ নামে একটি শো রুমে ছেলেদের প্যান্ট বিক্রি করা হয়। তিনি বলেন, আমার দোকানের ৩০ লাখ টাকার মালামাল পুড়েছে এবং নগদ ৭৫ হাজার টাকা পুড়েছে। আমি দোকানভর্তি ছাই পেয়েছি। আর কিছু পাইনি। টানা সাত বছর বিদেশে ছিলাম। দেশে এসে উপার্জিত ওই জমানো টাকা দিয়ে অনেক আশা নিয়ে ব্যবসা শুরু করেছিলাম। আমার ব্যবসা আমার স্বপ্ন ছিল। আগুন আমার স্বপ্ন কয়েক ঘণ্টায় সব শেষ করে দিয়েছে। তারপরও নতুন করে ওঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি। আবার দোকান নিয়ে বসছি। আগের মতো ব্যবসা নেই। তিন ভাগের এক ভাগ মাল চলছে। সমিতি থেকে ১ হাজার টাকা ছাড়া আর কোনও সহযোগিতা পাইনি।
তিনি আরও বলেন, ঢাকায় যেভাবে একের পর এক মার্কেটে আগুন লাগছে, সবসময় তো ভয়ের মধ্যে থাকতে হয়। আমরা তো ভুক্তভোগী। যার যায় সেই বোঝে!