X
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪
২৬ বৈশাখ ১৪৩১

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে বিচারাধীন যত মামলা

মহিউদ্দিন খান রিফাত
০১ অক্টোবর ২০২৩, ০৭:০০আপডেট : ০১ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:১৬

শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে বর্তমানে ১৬৮টি মামলা বিচারাধীন। এরমধ্যে ফৌজদারি আদালতে একটি, দুর্নীতি দমন কমিশনে একটি এবং বাকি ১৬৬টি মামলা ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে বিচারাধীন। তবে শ্রমিকদের দাবিকৃত পাওনা ইতোমধ্যে পরিশোধ করায় বর্তমানে ১০৬টি মামলাই নিষ্পত্তির পথে। বাংলা ট্রিবিউনকে এ তথ্য নিশ্চিত করেছেন ড. ইউনূসের আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন।

ড. ইউনূসসহ অন্য বিবাদীদের বিরুদ্ধে শ্রম আদালতে বিচারাধীন মামলাগুলোর মধ্যে গ্রামীণ টেলিকম সংশ্লিষ্ট মামলা ৬৪টি। এছাড়া গ্রামীণ কল্যাণের ৬৯টি, গ্রামীণ কমিউনিকেশনের ২৫টি ও গ্রামীণ ফিশারিজের নামে ৮টি।

জানা যায়, শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে গ্রামীণ টেলিকম ও গ্রামীণ কল্যাণের কর্মচারীরা (বর্তমান ও সাবেক) অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে আলাদাভাবে এসব মামলা করেন। এসব মামলায় শ্রমিকরা তাদের পাওনা টাকা পরিশোধের দাবি করেছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলাটি এখনও তদন্তাধীন।

ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন জানান, গত বছর শ্রমিকদের ৪৩৭ কোটি টাকা পরিশোধের পর বর্তমানে ১৬৮টি মামলার মধ্যে ১০৬টি মামলা নিষ্পত্তির পথে রয়েছে।

প্রায় সব মামলাই প্রাথমিক পর্যায়ে

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সব মামলাই এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে জানান তার আইনজীবী ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল মামুন। তিনি বলেন, ২০২১ সালের ৯ সেপ্টেম্বর শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে ড. ইউনূসসহ চার জনের বিরুদ্ধে মামলা করেন কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের পরিদর্শক আরিফুজ্জামান। ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে এটিই ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা। 

এ মামলায় অন্য তিন জন বিবাদী হলেন—গ্রামীণ টেলিকমের সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আশরাফুল হাসান, পরিচালক নুরজাহান বেগম ও শাহজাহান।

মামলার অভিযোগ থেকে জানা যায়, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান অধিদফতরের কর্মকর্তারা ড. ইউনূসের গ্রামীণ টেলিকম পরিদর্শনে গেলে শ্রম আইন লঙ্ঘনের বিষয়টি দেখতে পান। তারা জানতে পারেন ওই প্রতিষ্ঠানে ১০৬ জন শ্রমিক-কর্মচারীকে স্থায়ী করার কথা থাকলেও তা করা হয়নি। শ্রমিকদের অংশগ্রহণে ‘তহবিল ও কল্যাণ তহবিল’ গঠন করা হয়নি। এছাড়া প্রতিষ্ঠানের লভ্যাংশের ৫ শতাংশ শ্রমিকদের দেওয়ার কথা থাকলেও তা দেওয়া হয়নি।

এ মামলায় চলতি বছরের ২২ আগস্ট ড. ইউনূসসহ চার জনের বিরুদ্ধে সাক্ষ্যগ্রহণ শুরু হয়েছে। কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের পরিদর্শক তরিকুল ইসলাম সেদিন সাক্ষ্য দেন।

ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল  মামুনের দাবি—শ্রম আইনের ১৯ অধ্যায়ে কোন কোন অপরাধ ফৌজদারি অপরাধ হবে, তার তালিকা রয়েছে। তবে এই মামলায় দেওয়ানি ও প্রশাসনিক অপরাধকে ফৌজদারি হিসেবে গণ্য করে অভিযোগ গঠন করা হয়েছে। এসব অপরাধকে ফৌজদারি হিসেবে চিহ্নিত করা সঠিক হয়নি। ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে সব মামলাই এখনও প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে।

কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলাগুলো চলমান। কেউ আইনের ঊর্ধ্বে নয়। দোষী হলে তার বিচার হবেই।’

দুদকের মামলা

গত ৩০ মে ড. ইউনূসকে প্রধান আসামি করে আরও ১২ জনের নামে মামলা দায়ের করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। মামলায় গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক-কর্মচারী কল্যাণ তহবিলের ২৫ কোটি ২২ লাখ ৬ হাজার ৭৮০ টাকা আত্মসাতের অভিযোগ আনা হয়। এ মামলাটি তদন্ত পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন ড. ইউনূসের আইনজীবী আবদুল্লাহ আল-মামুন।

সর্বশেষ আগস্টে দায়ের করা হয় ১৮টি মামলা

গত ২৮ আগস্ট ঢাকার তৃতীয় শ্রম আদালতে গ্রামীণ টেলিকমের ১৮ জন কর্মচারী ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে ১৮টি মামলা করেন। এদের মধ্যে ১৭ জন  চার-পাঁচ বছর আগে অবসরে গেছেন এবং একজন বর্তমানে কর্মরত। দেখা গেছে, সবাই আলাদা আলাদা মামলা করলেও সবগুলোর ধরন একই। অর্থাৎ মামলার অভিযোগে বলা হয়—শ্রমিকদের পাওনা পরিশোধ করা হয়নি।  

ব্যারিস্টার আবদুল্লাহ আল-মামুন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘শ্রমিকদের দিয়ে একের পর এক মামলা করানো হচ্ছে। সবশেষ গত ২৮ আগস্ট ১৮ জন শ্রমিক মামলা করেছেন।’

ব্যারিস্টার মামুন আরও  বলেন, ‘এরমধ্যে গ্রামীণ ব্যাংক এক চিঠিতে জানিয়েছে—গ্রামীণ টেলিকমিউনিকেশন্সের সঙ্গে চুক্তি আর নবায়ন করবে না। চুক্তি নবায়ন না করলে প্রতিষ্ঠানের কোনও কাজ থাকবে না। শ্রমিক ছাঁটাই করতে হবে। তখন শ্রমিকরা আরও মামলা করবে।’

অন্য আইনজীবীর অভিমত

এ প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কোনও অপরাধের কারণে মামলা হয়েছে বলে মনে হয় না। এটার সঙ্গে রাজনীতি আছে এবং কোনও উদ্দেশ্য আছে বলে আমার মনে হয়। কয়েক দিন আগে সরকারের একজন অ্যাটর্নি জেনারেলও কিন্তু একই কথা বলেছেন। একজন লোকের বিরুদ্ধে ১৬৮টি মামলা থাকলে তো সে এক মাসেও হাজিরা দিয়ে শেষ করতে পারবে না।’

তিনি বলেন, ‘ড. ইউনুসের বিরুদ্ধে কেন ১৬৮টি মামলা হলো—স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন আসবেই, বিশ্বব্যাপী আসবে। শুধু যে আমরা বলছি তা না, জাতিসংঘ বলেন, মানবাধিকার সংগঠন বলেন, বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানরা এই প্রশ্ন করছেন।’

আন্তর্জাতিক উদ্বেগ

‘অধ্যাপক ইউনূস প্রায় এক দশক ধরে হয়রানি ও ভয়ভীতির মুখোমুখি’ উল্লেখ করে গত ৫ সেপ্টেম্বর বিবৃতি দিয়েছেন জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনার ভলকার তুর্ক। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘অধ্যাপক ইউনূস প্রায় এক দশক ধরে হয়রানি ও ভয়ভীতির মুখোমুখি। তিনি বর্তমানে দুটি বিচারের মুখোমুখি হচ্ছেন, যেগুলোতে তার কারাদণ্ড হতে পারে। একটি শ্রম আইন লঙ্ঘনের অভিযোগ এবং দ্বিতীয়টি দুর্নীতির অভিযোগ।’

ভলকার তুর্ক আরও বলেন, ‘আমরা উদ্বিগ্ন যে তার বিরুদ্ধে মানহানিকর প্রচারণা অনেক সময়ই সরকারের উচ্চ পর্যায় থেকে আসছে এবং এতে তার আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার ঝুঁকি আছে।’

শান্তিতে নোবেল বিজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের বিরুদ্ধে বাংলাদেশে দায়ের করা মামলা নিয়ে আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহলের এসব বিবৃতি অব্যাহত আছে। এর আগে গত ২৮ আগস্ট বিশ্বের ১৬০ জন সুপরিচিত ব্যক্তি ও নেতা অধ্যাপক ইউনূসের পক্ষে একটি খোলা চিঠি দিয়েছেন। এরমধ্যে বিশ্বের ১০০ জন নোবেল বিজয়ীসহ ১৬০ বিশিষ্টজন ড. ইউনূসের পক্ষে বিবৃতি দেন। তারা মামলার কার্যক্রম স্থগিতের আহ্বান জানান।

চিঠিতে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে মামলায় যেসব অভিযোগ আনা হয়েছে, সেগুলো বাংলাদেশের ভেতরে নিরপেক্ষ বিচারক ও দেশের বাইরের আইন বিশেষজ্ঞদের সমন্বয়ে গঠিত প্যানেলের মাধ্যমে পর্যালোচনার আহ্বান জানানো হয়েছে।

এর আগে গত মে মাসে বিশ্বের ৪০ জন রাজনীতিবিদ, কূটনীতিক, ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে একই ধরনের খোলা চিঠি দিয়েছিলেন।

আইনমন্ত্রী যা বলেন

ড. ইউনূস প্রসঙ্গে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘ড. ইউনূসকে হয়রানির অভিযোগ মোটেও সঠিক নয়। একটি বিচারাধীন বিষয় নিয়ে আমি কথা বলতে চাই না। তবু এইটুকু বলছি, এই মামলা হয়রানিমূলক নয়। যাদের বিরুদ্ধে অন্যায় করেছে, তারা আদালতে প্রতিকার চেয়েছে। এটা বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তাদের অধিকার। সংবিধানে এই অধিকার তাদের দেওয়া আছে। তিনি (ড. ইউনূস) অপরাধ করেছেন কী করেননি, সেটা আদালত বিচার করবেন।’

/ইউএস/এফএস/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
অনলাইন জুয়ার প্রচার ও অর্থপাচারের মহোৎসবে উদ্বেগ টিআইবির
শিশু অপহরণের দায়ে বৃদ্ধের ১৪ বছরের কারাদণ্ড
অবন্তিকার আত্মহত্যা: জবি সাবেক সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম জামিনে মুক্ত
সর্বশেষ খবর
হবিগঞ্জে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত বেড়ে ৪
হবিগঞ্জে দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত বেড়ে ৪
শরণার্থী আবেদন করা ব্যক্তিকে ইউরোপে ঢোকার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে: ইইউ
শরণার্থী আবেদন করা ব্যক্তিকে ইউরোপে ঢোকার আগেই ব্যবস্থা নিতে হবে: ইইউ
হিন্দুত্ববাদের মন্ত্রে দক্ষিণ ভারত জয় করতে পারবেন মোদি?
হিন্দুত্ববাদের মন্ত্রে দক্ষিণ ভারত জয় করতে পারবেন মোদি?
রাশিয়াকে ঠেকাতে আরও অস্ত্র চাইলেন জেলেনস্কি
রাশিয়াকে ঠেকাতে আরও অস্ত্র চাইলেন জেলেনস্কি
সর্বাধিক পঠিত
আর্জেন্টাইন ক্লাবকে জামাল ভূঁইয়ার ২ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ ফিফার
আর্জেন্টাইন ক্লাবকে জামাল ভূঁইয়ার ২ কোটি টাকা পরিশোধের নির্দেশ ফিফার
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা: আজিজ মোহাম্মদসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন
চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যা: আজিজ মোহাম্মদসহ ৩ জনের যাবজ্জীবন
চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় আহত পাইলটের মৃত্যু
চট্টগ্রামে প্রশিক্ষণ যুদ্ধবিমান দুর্ঘটনায় আহত পাইলটের মৃত্যু
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
কিশোরগঞ্জের তিন উপজেলায় বিজয়ী হলেন যারা
চেয়ারম্যান হলেন ৯ এমপির স্বজন, হেরেছেন দুজন
চেয়ারম্যান হলেন ৯ এমপির স্বজন, হেরেছেন দুজন