যেকোনও নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যকে ‘দুর্ঘটনা’ বলার চেষ্টা করা হয়। শ্রমিক অধিকার আন্দোলনে যুক্ত ব্যক্তিরা বলছেন, শ্রমিককে কাজে নিয়োগের সময় যেসব নিরাপত্তা দেওয়ার কথা, সেটা না দেওয়ার কারণে যে মৃত্যু ঘটে, সেটাকে কোনোভাবেই ‘দুর্ঘটনা’ বলার সুযোগ নেই। বরং এ ধরনের মৃত্যু হত্যাকাণ্ডের শামিল। এমনকি এসব হত্যাকাণ্ড কোথাও নথিভুক্তও হয় না। বিচ্ছিন্নভাবে মৃত্যুর ঘটনা ঘটায় এদের প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ নিয়েও কোনও আলোচনা নেই।
সেপ্টেম্বরের শুরুতে বরগুনার বেতাগীতে একটি নির্মাণাধীন বাড়ির সেপটিক ট্যাংকের বিষাক্ত গ্যাসে এক নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যু হয়েছে। সেখানে নির্মাণাধীন ভবনে কাজ করছিলেন দুই জন শ্রমিক। দুপুর ১২টার দিকে ভবনের সিঁড়ির গোড়ায় সেপটিক ট্যাংকে কাজ করার জন্য প্রথমে জামাল হাওলাদার নামে এক শ্রমিক নামেন। ট্যাংকের ভেতরে ঢুকতেই বিষাক্ত গ্যাসে অজ্ঞান হয়ে পড়েন তিনি। এরপর ফায়ার সার্ভিসের একটি দল ঘটনাস্থলে পৌঁছে জামালকে উদ্ধার করে অজ্ঞান অবস্থায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে আসলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
অধিকারকর্মীদের অধিযোগ, প্রতিনিয়ত দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন নির্মাণ শ্রমিকরা। রাজধানীসহ দেশজুড়ে গড়ে উঠছে বিপুলসংখ্যক বহুতল ভবন। এ সব ভবন নির্মাণে শ্রমিকদের দুর্ঘটনা এড়াতে যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে না। কর্মক্ষেত্রে শ্রমিকদের কোনও ধরনের জীবন রক্ষাকারী সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয় না। তারা বলছেন— এই যে সেপটিক ট্যাংকে শ্রমিক মারা গেলো, কাজ করার সময় তার নিরাপত্তার জন্য যা যা করণীয়, তা করা হয়েছিল কিনা, সেটা তদন্ত হওয়া জরুরি। সেটা হয় না বলেই এটাকে শ্রেফ দুর্ঘটনা বলে চালিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়।
চরম ঝুঁকি নিয়ে কাজ করা নির্মাণ শ্রমিকদের নিরাপত্তার বিষয়টি বরাবরই উপেক্ষিত হচ্ছে। ফলে বাড়ছে প্রাণহানির সংখ্যা। গত ১০ বছরে এ খাতে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ১০২ জন শ্রমিক। শুধু নির্মাণ শ্রমিকই নয়, কর্মক্ষেত্রে যথাযথ নিরাপত্তার অভাবে গত বছর পরিবহন, নির্মাণ ও কৃষি— এই তিন খাতে নিহত হয়েছেন ১ হাজার ৫৩ জন। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের (বিলস) এক পরিসংখ্যানে এ তথ্য পাওয়া গেছে।
গত পাঁচ বছরে নির্মাণ শ্রমিকের মৃত্যুর হিসাব বলছে, ২০২২ সালে ১১৮ জন শ্রমিক নিহত হয়, ২০২১ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৫৪, এর আগের বছর ২০২০ সালে করোনা মহামারির কারণে এ সেক্টরে নিহতের সংখ্যা কিছুটা কম ছিল, ৮৪ জন। তবে ২০১৯ সালে মারা যান ১৩৪ এবং ২০১৮ সালে এ সংখ্যা ছিল ১৬১ জন।
মালিকদের অবহেলা, শ্রমিকদের সচেতনতার অভাব, শ্রম আইনের সঠিক বাস্তবায়ন না হওয়া এবং এ আইনের দুর্বলতার কারণে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত মৃত্যুর ঘটনা ঘটছে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন। কোনও নিয়মকেই গুরুত্ব না দেওয়ায় নির্মাণ শ্রমিকদের পাশাপাশি আশপাশের মানুষ ও ভবনের নিচে পথচারীরাও নিরাপত্তাহীনতায় থাকেন। জাতীয় বিল্ডিং কোডে কর্মকালীন একজন শ্রমিকের কী কী নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নিতে হবে, তার বিস্তারিত উল্লেখ থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই তা মানা হয় না। ২০১৪ সালের ‘জাতীয় ভবন নির্মাণ বিধিমালা’ অনুযায়ী, কাজের সময় শ্রমিকের মাথায় হেলমেট পরা বাধ্যতামূলক করা হয়। যারা কংক্রিটের কাজে যুক্ত, তাদের হাতে গ্লাভস ও চোখের জন্য ক্ষতিকর কাজে চশমা পরিধান করতে হবে। ওয়েল্ডার ও গ্যাস কাটার ব্যবহারের সময় রক্ষামূলক সরঞ্জাম যেমন- গ্লাভস, নিরাপত্তা বুট, অ্যাপ্রন ব্যবহার করতে হবে। ভবনের ওপরে কাজ করার সময় শ্রমিকদের নিরাপত্তায় বেল্ট ব্যবহারও বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। তবে এর কোনোটিই বাস্তবে দেখা যায় না।
নিরাপত্তার জিনিস না থাকায় যদি দুর্ঘটনাকবলিত হয়ে শ্রমিকের মৃত্যু ঘটে— তবে তার দায় কার, জানতে চাইলে ইমারত নির্মাণ শ্রমিক ইউনিয়ন বাংলাদেশের (ইনসাব) সাধারণ সম্পাদক আবদুর রাজ্জাক বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘এ দায় প্রথমত মালিকের।’ সেই মালিক তার শ্রমিকের নাম-ঠিকানা আদৌ জানে কিনা, প্রশ্নে তিনি বলেন, ‘আমরা দীর্ঘদিন যাবত বলে আসছি— শ্রমিককে নিয়োগ দিলে রেজিস্টার খাতা থাকতে হবে। কিন্তু এখনও সেটা নিশ্চিত করা যায়নি।’
আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘এখনও এ ধরনের মুত্যুকে সেই অর্থে আমরা হয়তো হত্যাকাণ্ড দাবি করি না। কিন্তু এটা নিছক দুর্ঘটনা নয়।’
এই প্রক্রিয়ায় যে দুর্ঘটনার মধ্য দিয়ে নিহতের ঘটনা ঘটে, সেটাকে হত্যাকাণ্ড হিসেবে চিহ্নিত করে অধিকার ও উন্নয়নকর্মী গওহার নঈম ওয়ারা বলেন, ‘মালিক শ্রেণী ধরেই নিচ্ছে, এরা দুর্ঘটনায় মরে যাবে। সে কারণে নিয়োগ দেওয়ার সময় এদের কোনও নাম- ঠিকানা রাখা হয় না। ভবন নির্মাণের সময় শ্রমিক নিয়োগের যে পদ্ধতি, তাতে কার মাধ্যমে শ্রমিক নিয়োগ হয়েছে, চাইলেও আপনি সেটা খুঁজে বের করতে পারবেন না। তার মানে আপনার উদ্দেশ্যই ভালো না।’ তিনি মনে করেন, রাজধানীতে পাড়ায় পাড়ায় স্বেচ্ছাসেবকদের মাধ্যমে ‘সিভিল ডিফেন্স কমিটি’ হওয়া এখন সময়ের দাবি।
গওহার নঈম ওয়ারা আরও বলেন, ‘এই শ্রমিকদের যথাযথ ক্ষতিপূরণ দেওয়ার ব্যবস্থা ও মালিকদের আরও সতর্ক হয়ে শ্রমিককে নিরাপত্তা দিতে বাধ্য করা দরকার।’