সকাল আটটা। রোকেয়া সরণিতে একটি অ্যাম্বুলেন্স যাচ্ছে আগারগাঁওয়ের দিকে। নিয়মানুযায়ী সাইরেন বাজছে না। তালতলায় দাঁড়িয়ে দুই জন যাত্রী নামিয়ে চলে গেলো। দ্রুত চলে যেতেই কথা হয় যাত্রী নঈমের সঙ্গে, তিনি শিক্ষার্থী। অ্যাম্বুলেন্সে করে কোথা থেকে এলেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘পল্লবী থেকে আসলাম। গাড়িটা এদিকেই আসছিল।’ তাড়াতাড়ি নামিয়ে দেবে বলে চালক প্রস্তাব দিলে তিনি সেটা গ্রহণ করেন। ভাড়া দিতে হয়েছে ১০০ টাকা। ‘আমরা মোট ৫ জন ছিলাম’, জানান নাঈম।
রাজধানী ঢাকাজুড়েই এখন দেখা যাচ্ছে— অ্যাম্বুলেন্সে যাত্রী পরিবহন। রোগী আনতে যাচ্ছে বা রোগী নামিয়ে ফেরার পথে কয়েকজন যাত্রী তুলে নিলেই ৫শ থেকে এক হাজার টাকা লাভ। অ্যাম্বুলেন্স মালিক সমিতি বলছে, কোনোরকম যাত্রী পরিবহন নিষিদ্ধ করা আছে। কিন্তু ব্যক্তি মালিকানার অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে এটা হয়। আর চালকরা বলছেন, ঢাকার ভেতরে অ্যাম্বুলেন্সে রোগী বা মরদেহ নিয়ে এখানে-সেখানে গেলে বাড়তি টাকা তেমন পাওয়া যায় না। ফলে এ ধরনের কিছু অন্যায় কাজ তাদের করা লাগে।
অ্যাম্বুলেন্সের চালক ও মালিকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, একদিকে রাস্তায় বেশি ভাড়া নেওয়া ও যাত্রী পরিবহনের মতো কাণ্ড ঘটানো, আরেকদিকে হাসপাতালে ফ্রি গ্যারেজ সুবিধাসহ হাজারো দাবি নিয়ে রোগীদের জিম্মি করার মতো কাজগুলো ঘটছে অহরহ। তবে মালিক সমিতির দাবি, বারবার নীতিমালা করতে বলার পরেও কেবল আশ্বাসই মিলেছে।
কথায় কথায় ধর্মঘট
কেবল রাজধানী নয়, জেলা শহরগুলোতেও সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় চলছে না সরকারি হাসপাতালের অ্যাম্বুলেন্স। নির্ধারিত ভাড়ার কয়েকগুণ বেশি টাকা রোগীর স্বজনদের কাছ থেকে নিচ্ছেন অ্যাম্বুলেন্স চালকরা। অতিরিক্ত ভাড়া আদায়ের বিষয়টি প্রকাশ্যে হলেও স্বাস্থ্য বিভাগের শীর্ষ কর্মকর্তারা দেখেও না দেখার ভান করছেন। আর বেসরকারি অ্যাম্বুলেন্সে চলে স্বেচ্ছাচারিতা।
২৫০ শয্যার হবিগঞ্জ জেলা সদর হাসপাতালের ভেতরে অ্যাম্বুলেন্স রেখে ব্যবসা করতে না দেওয়ায় চলতি বছরেই জেলা পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন সেখানে অনির্দিষ্টকালের জন্য পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দেয়। ওই ধর্মঘটে জেলার সঙ্গে ঢাকা ও সিলেটসহ সারা দেশের পরিবহন যোগাযোগ বন্ধ থাকে। মানুষ ভোগান্তিতে পড়ে। এছাড়া কিছু দিন আগে বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতি ছয় দফা দাবিতে ধর্মঘটের ডাক দেয়। অবিলম্বে অ্যাম্বুলেন্সের জন্য জাতীয় নীতিমালা প্রণয়ন, দেশের প্রত্যেকটি হাসপাতালে অ্যাম্বুলেন্সের পার্কিং সুবিধা চায় তারা। পরবর্তীকালে সরকারের হস্তক্ষেপে তাদের দাবি পূরণের আশ্বাস দিলে ধর্মঘট কর্মসূচি বাতিল করা হয়।
কথায় কথায় ধর্মঘট ডেকে রোগীদের জিম্মি করে দাবি আদায় একদমই অমানবিক উল্লেখ করে জনস্বাস্থ্যবিদ হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালের চেয়ারম্যান ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, ‘প্রতিটা জিনিসের পদ্ধতি আছে। অ্যাম্বুলেন্স-সেবা চালু করার সময়েই তার একটা পরিচালনা পদ্ধতি থাকতে হবে এবং সেটা সবাইকে জানতে হবে। সেটা এতদিনেও না হওয়ার কারণে ভুক্তভোগী হচ্ছে রোগীরা। তাদের আমরা সেবাটা দিতে পারছি না।’
মাদকের রাজ্যে অ্যাম্বুলেন্স-সেবা
২ অক্টোবর রংপুরে রোগীবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্স থেকে ১৫ কেজি গাঁজা উদ্ধার করে পুলিশ। এ ঘটনায় জড়িত থাকার অভিযোগে দুজনকে গ্রেফতা করা হয়। উদ্ধার করা গাঁজার আনুমানিক দাম প্রায় দেড় লাখ টাকা। বরিশালের গত জুন মাসের একটি ঘটনা। একটি ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্স আটক করা হয়, ভেতরে একটি মরদেহ। ফ্রিজিং অ্যাম্বুলেন্সের এটা চিরাচরিত চিত্র। কিন্তু আটক করার পর জানা যায়, দেখে মরদেহ মনে হলেও আসলে অ্যাম্বুলেন্সের ভেতরে সেটা বিশেষ কায়দায় রাখা মাদকের চালান। মাদকপাচারের এই অভিনব কায়দা বেছে নিয়েছে মাদকপাচারকারী চক্র। গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে এই চক্রের দুই সদস্যকে আটক করে বরিশাল জেলা গোয়েন্দা পুলিশ।
এই অরাজকতা কীভাবে বন্ধ করা যাবে, প্রশ্নে বাংলাদেশ অ্যাম্বুলেন্স মালিক কল্যাণ সমিতির সভাপতি মো. গোলাম মোস্তফা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা অ্যাম্বুলেন্স পরিচালনার নীতিমালা চাই। বারবার বলেও কোনও সুরাহা করতে পারিনি। সর্বশেষ যোগাযোগ কো হলে বিআরটিএ থেকে আমাদের কিছু সমস্যা সমাধানের জন্য ২২ অক্টোবরের পরে বসার দিন দেবে বলে জানানো হয়েছে। কিন্তু পরিচালনার পূর্ণাঙ্গ নীতিমালা দরকার। তা না হলে এসব চলতেই থাকবে।’ রাজধানীর রাস্তায় অফিস সময়ে অ্যাম্বুলেন্সগুলোতে যাত্রী পরিবহনের বিষয়টি মেনে নিয়ে তিনি বলেন, ‘এরকম হয়। আমাদের দিক থেকে কড়া নির্দেশ দেওয়া আছে, যাতে কোনও যাত্রী পরিবহন না করা হয়। কেউ শোনে, কেউ শোনে না।’