X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

টাঙ্গাইল শাড়ি নিয়ে ভারতের তাঁতিরা কী বলছেন?

উদিসা ইসলাম
০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২২:০০আপডেট : ০৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ২২:১৭

দেশভাগের পর টাঙ্গাইল থেকে আমার ঠাকুরদা আসছেন এখানে। সে সময় অনেক সনাতন ধর্মের তাঁতি ভারতের পশ্চিমবঙ্গে চলে আসেন। আমার বাবার বয়স তখন ৯ বছর। এখানে এসেই তিনি তাঁত ধরেছিলেন। নদীয়া জেলার ফুলিয়া-শান্তিপুর অঞ্চলে আমার স্বজনদের বাস। টাঙ্গাইল থেকে যারা এসেছিলেন, তারা যে তাঁত বুনতেন—সেটাই এখানেও ‘টাঙ্গাইল’ নাম হয়ে গেছে। টাঙ্গাইলে হয় যে শাড়ি সেটার জন্য না, সেখানকার তাঁতিরা পশ্চিমবঙ্গে এসে সেটাকে ধরে রেখেছে বলে এর নাম টাঙ্গাইল। তবে এখন আর সেই টাঙ্গাইলের তাঁতও খুব বেশি না, এখন তাঁতের চেয়ে পাওয়ার লুমে আগ্রহ বেশি। টাঙ্গাইলের শাড়ি কখনোই আমাদের না। ওটা বাংলাদেশের। আমরা নামটা ব্যবহার করি।

কথাগুলো বলছিলেন বাংলাদেশ থেকে যাওয়া পশ্চিমবঙ্গের ফুলিয়ায় বসবাসরত তাঁতি দীপক বসাক। তার জন্মও পশ্চিমবঙ্গে।

টাঙ্গাইল শাড়ির জিআই (জিওগ্রাফিক্যাল আইডেনটিটি) ভারত নিয়ে নেওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়ার পর বাংলাদেশের মানুষের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। এরপরই কথা হয় সেই তাঁতিদের সঙ্গে, যারা কিনা এই শাড়িগুলো বুনেন এবং পশ্চিম বাংলাসহ বিভিন্ন অঞ্চলে ‘টাঙ্গাইলের শাড়ি’ হিসেবে বিক্রি হয়। কী হলো বিষয়টা প্রশ্ন করা হলে নাম প্রকাশ না করার শর্তে সেখানকার (ফুলিয়ার) আরেক তাঁতি বলেন, কিছু শব্দগত ব্যবহারের ভুল হয়েছে বলে আমার মনে হয়। এই তাঁত আমার বাপঠাকুরদার। বংশ পরম্পরায় আমরা এই শাড়িটা বুনি। এই শাড়ির বৈশিষ্ট্য হলো—এটা তাঁতে হয় এবং পলিশ করা থাকে। এটা এই বাংলায় বোনা টাঙ্গাইল।’

ফুলিয়ায় বোনা টাঙ্গাইল শাড়ি, ছবি: সাভেরিজ ক্লোদিং লাইনের সৌজন্যে মনিকা বসাকের বাবা বাংলাদেশ থেকে পশ্চিমবঙ্গে গেছেন। এখন ব্যবসাটা মেয়ে সামলান। তিনি বলেন, এখানে কলোনিতে যখন চলে আসতে হলো, তারা প্রত্যেকে তাদের পেশাকেই আঁকড়ে ধরেছিল। মাঝে খুব খারাপ অবস্থা ছিল, পরবর্তীকালে তাদের বেশ সহায়তা দেওয়া হয় এবং আবার শাড়ির ফ্যাশন বেড়ে যায়।

মনিকা বসাক বলেন, ‘এটা অবশ্যই বাংলাদেশের জিনিস। আমরা এখানে নামটা ব্যবহার করি। কারণ, আমাদের বাপ-ঠাকুরদারা ওখান থেকেই তাঁতটা এখানে এনেছেন।’

জানা যায়, টাঙ্গাইল শাড়িকে নিজেদের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) হিসেবে অন্তর্ভুক্তির জন্য ২০২০ সালে আবেদন করে পশ্চিমবঙ্গের তন্তুবায়ী সমবায় সমিতি। পর্যবেক্ষণের নানা ধাপ পেরিয়ে গত ২ জানুয়ারি এর স্বীকৃতি দেয় ভারতের শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীন পেটেন্ট, ডিজাইন অ্যান্ড ট্রেড মার্কস বিভাগ। তাতে টাঙ্গাইল শাড়িকে পশ্চিমবঙ্গের নদীয়া ও পূর্ব বর্ধমানের পণ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এটা নিয়ে কিছুই জানেন না খোদ তাঁতিরা, যারা মূলত বাংলাদেশের টাঙ্গাইল থেকে গিয়ে নদীয়া ও শান্তিপুরে এই কাজটিকে ধরে রেখেছেন। আবার শাড়িটির ভৌগোলিক নির্দেশক চিহ্ন হিসেবে বলা হয়েছে—এর নাম ‘‌বাংলার টাঙ্গাইল শাড়ি’। যারা শাড়ি নিয়ে কাজ করেন তারা বলছেন, শান্তিপুর ডিজাইন ও ঢাকাই টাঙ্গাইলের সংমিশ্রণে এক ধরনের সংকর শাড়িকে ‘টাঙ্গাইল’ নাম দিয়ে জিআই প্রতিষ্ঠা করতে চাওয়াটা এক ধরনের অসততা।

ফুলিয়ায় বোনা টাঙ্গাইল শাড়ি, ছবি: সাভেরিজ ক্লোদিং লাইনের সৌজন্যে উল্লেখ্য, বসাক পরিবার ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর পরই ভারতে যাওয়া শুরু করে। পরিবারটির সদস্যরা জীবিকা নির্বাহও করেন আগের পেশার মাধ্যমেই। কিন্তু তারা যে ধরনের শাড়ি পূর্ব বাংলায় গড়তেন, সেটির চাহিদা ভারতে ছিল না। এ বিষয়ে ফুলিয়ার তাঁতিদের মধ্যে আরেকজন নাম প্রকাশ না করে টেলিফোনে বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেখেন, এখানে বাংলাদেশের শাড়ির চাহিদা বলতে জামদানি। ঢাকাই শাড়ি। টাঙ্গাইলের এই সুতি যখন এখানে দেওয়া হলো, তখন এর প্রসার বাড়তে থাকে। যদিও আসলেই শুরুতে এর কোনও চাহিদা ছিল না। এটা আমাদের জিনিস নয়, কিন্তু আপনি সেটি বলতেও পারবেন না।’

ফুলিয়ার তাঁতিরা বলছেন, এখন টাঙ্গাইল শাড়ি বানাতে তারা আগ্রহ পান না। কিন্তু বাজারে টাঙ্গাইলের শাড়ির চাহিদা বেড়ে যাওয়ায়—অনেক বড় বড় শাড়ির দোকান সরাসরি বাংলাদেশ থেকে বোনা শাড়ি নিয়ে আসে। সেসবের অনেকটাই ফুলিয়া বলে বিক্রি করা হয়।

ফুলিয়ায় বোনা টাঙ্গাইল শাড়ি, ছবি: সাভেরিজ ক্লোদিং লাইনের সৌজন্যে এ বিষয়ে জানতে চাইলে বাংলাদেশে ‘টাঙ্গাইল শাড়ি ব্যবসায়ী সমিতি’র সাধারণ সম্পাদক নীল কমল বসাক বলেন, ‘এটা একদম সত্য কথা। আমরা খুব ভালোভাবে মার্কেটিং করতে পেরেছি এবং রফতানি হচ্ছে টাঙ্গাইলে বোনা শাড়ি। কিন্তু এখন যখন জিআই নিয়ে যাচ্ছে—আমি তো এটা অন্য কোথাও এক্সপোর্ট করতে গেলে টাঙ্গাইল শাড়ি লিখতে পারবো না। আমি নিজের সন্তানকে আমার নামেই রাখতে চাই। যারা কিনা এখান থেকে বোনা শাড়ি নিয়ে যাচ্ছে, তারা নাকি সেটার জিওগ্রাফিক্যাল আইডেনটিটি দাবি করছে, এটা কোনোভাবে হতে দেওয়া যায়?’

তিনি বলেন, ‘টাঙ্গাইল শাড়ি টাঙ্গাইলেরই। কোন তাঁতি কোন পরিস্থিতিতে কোন দেশে আশ্রয় নিলেন, সেটা এখানে বড় বিষয় না। এখানে আমাদের তাঁত বোর্ডের কিছু উদাসীনতার কারণে এই ঘটনা ঘটেছে। এর আগে জামদানি নিয়ে যখন ভারত এমন করলো, আমরা তখনই টাঙ্গাইল শাড়ির ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার বিষয়টি উপস্থাপন করেছিলাম। গত তিন বছরে সেটা হয়নি বলে ভারত এটাকে নিজেদের দাবি করতে পারলো। তবে এখনও অসুবিধা নেই। রিভিউ করার সুযোগ আছে। সেটা দায়িত্বশীলরা যত গুরুত্ব দিয়ে দ্রুত করবেন, ততই ভালো।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
পাচার হওয়া বোনকে নিতে এসে কলকাতায় অসহায় দশায় চট্টগ্রামের তরুণ
হেলিকপ্টারের সিটে বসতে গিয়ে পড়ে গেলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়
কেমন চলছে ভারতের লোকসভার দ্বিতীয় দফার ভোট?
সর্বশেষ খবর
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
যশোরে তীব্র গরমে মরে যাচ্ছে মাছের পোনা, ক্ষতি ‌‘২০ কোটি টাকা’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
থেমে যেতে পারে ব্যাংকের একীভূত প্রক্রিয়া
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ