সাম্প্রতিক সময়ে নগর এলাকার মাঠ-পার্ক উন্নয়নে গৃহীত উদ্যোগসমূহ অত্যন্ত প্রশংসনীয়। কিন্তু উন্নয়নকৃত মাঠগুলোতে প্রবেশগম্যতা ও অন্তর্ভুক্তিতার অভাবে শিশুরা খেলাধূলার সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বানিজ্যিককরণ ও দখলের কারণে পার্কের মূল যে লক্ষ্য তা উপভোগ করতে পারছেন না রাজধানীবাসি। এছাড়া হাটা দূরত্বে এলাকাগুলোতে পার্ক ও মাঠ না থাকায় মানসিক ও শারীরিক বিকাশের ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
এ অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য একটি নীতিমালা প্রয়োজন, যার মাধ্যমে মাঠ-পার্কের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা করা সম্ভব হবে। প্রত্যেক ওয়ার্ড কাউন্সিল যদি পাঁচ বছরে একটি করেও মাঠ উদ্ধার ও তৈরি করেন তা হলেও ১২৯ টি মাঠ হবে।
মঙ্গলবার (৬ ফেব্রুয়ারি) জাতীয় প্রেসক্লাবের তফাজ্জাল হোসেন মানিক মিয়া হলে “দেশের নগর এলাকার খেলার মাঠের পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা: চ্যালেঞ্জ ও করণীয়” শীর্ষক মত বিনিময় সভায় বক্তারা এ কথা বলেন। ইনস্টিটিউট ফর প্লানিং এন্ড ডেভেলপমেন্ট (আইপিডি) ও ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের যৌথ উদ্যোগে এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়েছে।
সভায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন আইপিডি-এর পরিচালক ও নগরবিদ ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বর্তমানে মাঠগুলোতে খেলার সুযোগ সংকীর্ণ হয়ে আসছে। বিদ্যালয়গুলোতেও খেলার মাঠ নেই বললেই চলে। শুধুমাত্র ঢাকা নয়, ঢাকার বাইরে বিভিন্ন জেলা ও বিভাগীয় শহরগুলোতেও মাঠের স্বল্পতা রয়েছে।
পর্যাপ্ত পরিমাণ খেলার মাঠ না থাকার প্রভা তুলে ধরে তিনি বলেন, খেলার মাঠ না থাকায় কিশোর গ্যাং ও মাদকের প্রকোপ বাড়ছে। তাছাড়া বিভিন্ন মাঠ উন্নয়ন করা হলেও শর্তাবলী জুড়ে দেওয়ায় প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রবেশের সুযোগ হারিয়ে গেছে।
আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, এলাকায় ওয়ার্ডভিত্তিক মেয়েদের খেলার সুযোগ রেখে পরিকল্পনামাফিক খেলার মাঠ তৈরি এবং এলাকাভিত্তিক চাহিদা বিবেচনায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। এজন্য খেলার মাঠ-পার্কের জন্য গণপরিসরে পরিকল্পনা ও ব্যবস্থাপনা নীতিমালা গ্রহণ করা আবশ্যক।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আকতার মাহমুদ বলেন, গবেষণা অনুযায়ী, ঢাকায় ২৩৫টি খেলার মাঠ থাকলেও এর মধ্যে ১৪১টি প্রাতিষ্ঠানিক মাঠ। বিদ্যমান মাঠগুলোতে শিশু-কিশোরদের অবাধ প্রবেশ নেই।
খেলার মাঠের স্বল্পতা বিবেচনায়, ঢাকা শহরের চারপাশে ১০০ কিলোমিটার নদীর পাড় ও জলাশয়গুলোকে সামাজিকীকরণ করে ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাপনাও উন্নত করা সম্ভব।
বুয়েটের স্থাপত্য বিভাগের অধ্যাপক ড. শায়ের গফুর বলেন, খেলার মাঠ রক্ষায় রাজনৈতিক সদিচ্ছা অত্যন্ত জরুরি। খেলার মাঠ সংকুচিত হয়ে যাওয়ার পিছনে ক্ষমতার অপব্যবহার দায়ী। নগরে বড় প্রকল্প বাস্তবায়নে যদি কোটি কোটি টাকা বরাদ্দ দেয়া যায় তাহলে এই নাগরিক চাহিদা পূরণে বরাদ্দ দেয়া অসম্ভব কেন?
আইপিডি’র নির্বাহী পরিচালক ড. মোহাম্মদ আরিফুল ইসলাম বলেন, ২০২১ সালের পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ১০৭৪০ টি স্কুলে কোন খেলার মাঠ নেই। তাহলে শিক্ষার্থীদের সামাজিকীকরণের সুযোগ তৈরি ও মানসিক বিকাশ কিভাবে হবে? বর্তমান অবস্থা বিবেচনায় মাঠ ছাড়া কোন স্কুলের অনুমোদন না দেওয়া। কতটুকু দূরে দূরে মাঠ তৈরির চাহিদা রয়েছে সেই অনুযায়ী পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়ন প্রয়োজন।
সভায় সভাপতির বক্তব্যে ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের পরিচালক গাউস পিয়ারী বলেন, আমাদের নগর পরিকল্পনায় শিশু, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি বা নারীদের চাহিদার প্রয়োজনীয়তা বিবেচনায় নেওয়া হয় না। আমরা শিশুদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশকে গুরুত্ব দিচ্ছি না। বরং খেলার মাঠগুলোকে বাণিজ্যিকীকরণ করছি। মাঠের দখলরোধে সরকারের কঠোর অবস্থান জরুরি। সকল অংশীদারদের সমন্বয়ের মাধ্যমে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক শহর গড়ে তুলতে হবে।
ওয়ার্ক ফর এ বেটার বাংলাদেশ ট্রাস্টের সিনিয়র প্রজেক্ট ম্যানেজার জিয়াউর রহমানের সঞ্চালনায় সভায় আরও বক্তব্য রাখেন, সমাজকর্মী ও তেঁতুলতলা মাঠ রক্ষা আন্দোলনের সমন্বয়ক সৈয়দা রত্না, ইনস্টিটিউট অব ওয়েলবীইং বাংলাদেশ-এর পলিসি অফিসার তালুকদার রিফাত পাশা, ঢাকা আইডিয়াল ক্যাডেট স্কুল এর প্রতিষ্ঠাতা এম এ মান্নান মনির, শিশুদের মুক্ত বায়ুসেবন সংস্থার সদস্য মো. সেলিম, ডিডিপি’র সভাপতি জাকির হোসেন, রায়েরবাজার উচ্চ বিদ্যালয়ের সহকারি শিক্ষক তাহাজ্জোত হোসেন ও ধানমন্ডি কচিকন্ঠ হাই স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা এইচএম নুরুল ইসলাম প্রমুখ।
