ঢাকার গণপরিবহনে শৃঙ্খলা ফেরানোর কোনও চেষ্টাই সফল ও কার্যকর হচ্ছে না। যার অন্যতম একটি উদাহরণ হতে পারে ‘ই-টিকিটিং’ ব্যবস্থা। ঢাকঢোল পিটিয়ে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে পরীক্ষামূলক চালু করা হয় এই ব্যবস্থা—যা পর্যায়ক্রমে বেশিরভাগ বাসে চালু করার পরিকল্পনার কথা জানানো হয়। কিন্তু বছর ঘুরতে না ঘুরতেই বাসে ই-টিকিটিং নানা কারণে হ্রাস পেতে থাকে। দুই বছরের মাথায় (২০২৪ সালের অক্টোবর) এসে অস্তিত্বহীন হয়ে পড়ে আধুনিক ও প্রযুক্তিগত এই ব্যবস্থাটি। এরইমধ্যে সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতৃত্বও বদলে গেছে। নতুন নেতৃত্ব বলছে—বাসে ভাড়ার নৈরাজ্য ঠেকাতে ই-টিকিটিং ভালো ব্যবস্থা হওয়া সত্ত্বেও আগের নেতারা নানান ধান্দাবাজির কারণে তা কার্যকর করতে পারেননি। এখন শৃঙ্খলা আনতে ফের এই ব্যবস্থা চালুর চেষ্টা করছেন তারা।
ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর দেশ পরিচালনার দায়িত্ব নেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এরপর থেকে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতারা গাঢাকা দিয়েছেন। বিশেষ করে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে গত দেড় দশক ধরে এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। সূত্র বলছে, তিনি বর্তমানে বিদেশে অবস্থান করছেন। এদিকে, সমিতির নেতৃত্বে এসেছেন গত ১৫ বছরে পরিবহন মালিক সমিতির কোণঠাসা থাকা নেতারা। তারা এই খাতে পরিবর্তন আনার কথা বলছেন।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির একাধিক গুরুত্বপূর্ণ নেতা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থায় মৌলিক পরিবর্তন আনার ব্যাপারে চিন্তাভাবনা করছেন তারা। এর মধ্যে বেশ কিছু পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে, পরিকল্পনাধীন আছে আরও কিছু পদক্ষেপ। তার মধ্যে একটি হলো ই-টিকিটিং। এটি নিয়ে বাস মালিকদের সঙ্গে অনানুষ্ঠানিকভাবে আলোচনা করেছেন তারা। ই-টিকিটিং সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
তারা জানিয়েছেন, সোমবার (১৪ অক্টোবর) ঢাকার কয়েকটি রুটের বাস মালিকদের সঙ্গে নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের। এর মধ্যে ই-টিকিটিংয়ের বিষয়টিও ছিল। সভায় এর পক্ষে-বিপক্ষে মত এসেছে। তবে ভাড়ার ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা আনতে অনেকেই ই-টিকিটিংয়ের পক্ষে কথা বলেছেন। এ নিয়ে আগামীতে আরও আলোচনা হবে এবং সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে জানান নেতারা।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল আলম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ই-টিকিটিং ভালো ব্যবস্থা। বাস কাউন্টার, সিরিয়াল, গাড়ির রোটেশনের ক্ষেত্রে এটা ভালো। কিন্তু এটা করলে প্রপারলি করতে হবে। আগে ই-টিকিটিংয়ের মাধ্যমে কিছু টাকা প্রতিদিন উঠানো হতো। সারা শহর থেকে এটা কালেকশন করা হতো। অথচ সব রুটে এটি ছিল না। আমরা তেমনটা চাই না। আমরা পরীক্ষামূলক শুরু করবো এবং সেজন্য কাজ করতেছি।’
সাইফুল আলম বলেন, ‘যেসব বাস নির্দিষ্ট স্টপেজে সুশৃঙ্খলভাবে চলে, সেগুলো দিয়ে শুরু করার কথা ভাবছি আমরা। জনমতও এটার পক্ষে। আমরা কার্যকরভাবে জনস্বার্থে ই-টিকিটিং পরীক্ষামূলক চালু করতে চাই। অভিযোগ পেয়েছি, গত সরকারের আমলে ই-টিকিটিংয়ের নামে একটা বড় অঙ্কের টাকা তুলে নিয়ে ভাগবাটোয়ারা করা হতো। বর্তমানে আমরা তেমন কিছু হতে দেবো না। এ ধরনের অনিয়মের বিরুদ্ধে আমরা প্রকাশ্য অবস্থান নিয়েছি। এটা অব্যাহত থাকবে।’
জানতে চাইলে শফিকুল ইসলাম নামে একজন যাত্রী বলেন, ভাড়া নিয়ে বিশৃঙ্খলা চলে আসছে। ই-টিকিটিং চালুর ফলে সেটার একটা সমাধান হবে বলে আমরা আশা করেছিলাম। ভেবেছিলাম, বাসে উঠে আর ভাড়া নিয়ে তর্কে জড়াতে হবে না। কিন্তু এটি চালুর পর কিছু দিন যেতে না যেতেই তা হোঁচট খেলো। ই-টিকিটের নামে যাত্রীদের কাছ থেকে বেশি ভাড়া নেওয়া হতো। কখনও কাউন্টারে আবার কখনও বাসের ভেতরে পজ মেশিনে এই টিকিট দেওয়া হতো। ভাংতি টাকার ক্ষেত্রে বেশি সমস্যা হতো। সারা রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে যাত্রী ওঠানো হলেও নির্দিষ্ট স্টপেজ থেকেই ভাড়া আদায় করা হতো। একই রুটে চলাচল করা বিভিন্ন কোম্পানির বাসের স্টপেজও ভিন্ন ভিন্ন ভাড়ার বৈষম্য থাকে ই-টিকিটে। বাসচালক-সহকারীরা টিকিট দিতেই আগ্রহ দেখান না, চেয়ে নিতে হয় যাত্রীদের। শেষ পর্যন্ত ই-টিকিটিং হারিয়ে গেছে।
তবে একাধিক বাসচালক ও সহকারীর সঙ্গে ই-টিকিটিং নিয়ে কথা হয়। তারা এই ব্যবস্থার বিপক্ষে মত দিয়েছেন। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলছেন, ই-টিকিটিং কাউন্টারে হলে ভালো। না হলে বাসের মধ্যে পজ মেশিন কাঁধে বহন করতে হয়। ভিড়ের মধ্যে মেশিনে ভাড়া কাটতে ঝামেলা হয়। ভাংতি টাকা নিয়ে যাত্রীদের সঙ্গে কথা কাটাকাটির ঘটনা ঘটে। পজ মেশিনের ভাড়া দিতে হয় কোম্পানিকে। আবার মেশিনেও সমস্যা দেখা দেয়। সব মিলিয়ে হাতে হাতে ভাড়া কাটাই বেশি ভালো।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, ঢাকায় ৬০টি কোম্পানির ৩ হাজার ৩১৪টি বাস চলাচল করে। এছাড়া পার্শ্ববর্তী বিভিন্ন শহর থেকেও ঢাকায় প্রবেশ করে আরও ৩৭টি কোম্পানির ২ হাজার ৩৩৬টি বাস। সব মিলিয়ে ঢাকা শহরে মোট ৯৭ কোম্পানির ৫ হাজার ৬৫০ বাস চলাচল করে। এর মধ্যে প্রথম ধাপে মিরপুরকেন্দ্রিক ৩০টি বাস কোম্পানি ই-টিকিটিং চালু করেছিল। দ্বিতীয় ধাপের ১৫টি মিলিয়ে মোট ৪৫টি কোম্পানি ই-টিকিট ব্যবস্থা চালু করে।
ই-টিকিটিং ব্যবস্থা চালুর পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হওয়ায় বাস মালিক ও শ্রমিকদের এক বৈঠকে ২০২২ সালের ২০ অক্টোবর সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়—বিআরটিএ’র চার্ট অনুযায়ী ই-টিকিটের ভাড়া নিশ্চিত করা, স্টপেজের বদলে প্রতিটি গাড়িতে টিকিট দেওয়ার জন্য পজ মেশিন থাকা, টিকিট কাটার পজ মেশিনের প্রোগ্রামিং পরিবর্তন করে গন্তব্য শুরু ও শেষ হওয়ার ভিত্তিতে ভাড়া কাটার ব্যবস্থা করা, স্টপেজ ছাড়া মাঝপথে বাস থামানো এবং যাত্রী তোলা নিষিদ্ধ করা এবং আরও গাড়ি এর আওতায় নিয়ে আসার।
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ বাসে ই-টিকিটিং চালু নিয়ে বেশি আগ্রহ দেখিয়েছিলেন। তিনি বিদেশে অবস্থান করায় এ বিষয়ে তার বক্তব্য জানা সম্ভব হয়নি।