এবারও বিতর্ক এড়াতে পারলো না বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার। তালিকা ঘোষণার দুদিন পর শনিবার (২৫ জানুয়ারি) সন্ধ্যায় তা স্থগিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে জানানো হয়, তিন কর্মদিবসের মধ্যে নতুন তালিকা দেওয়া হবে। এদিকে ফেসবুকে ঝড় উঠেছে কমিটি নিয়েও। কেউ কেউ দাবি তুলেছেন, নতুন তালিকা দেওয়ার আগে পুরো কাঠামোর পরিবর্তন আনা জরুরি। তা না হলে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি হবে।
বৃহস্পতিবার (২৩ জানুয়ারি) বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদের অনুমোদনে মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আজমের সই করা বিজ্ঞপ্তিতে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কারের তালিকা ঘোষণা করা হয়। তালিকায় নাম থাকা ব্যক্তিরা হলেন—কবিতায় মাসুদ খান, কথাসাহিত্যে সেলিম মোরশেদ, নাটক ও নাট্যসাহিত্যে শুভাশিস সিনহা, প্রবন্ধ/গদ্যে সলিমুল্লাহ খান, শিশুসাহিত্যে ফারুক নওয়াজ, অনুবাদে জি এইচ হাবীব, গবেষণায় মুহম্মদ শাহজাহান মিয়া, বিজ্ঞানে রেজাউর রহমান, মুক্তিযুদ্ধে মোহাম্মদ হাননান ও ফোকলোরে সৈয়দ জামিল আহমেদ।
এদের মধ্যে কারও কারও রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে আপত্তি ওঠে সাহিত্য অঙ্গনে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন সুবিধাভোগীর কারও নাম এ ধরনের পুরস্কার তালিকায় থাকার অধিকার নেই বলেও দাবি ওঠে। তবে ফেসবুকে সবচেয়ে বেশি আলোচনা শুরু হয় পুরস্কার প্রদান পদ্ধতি ও কমিটির ‘যোগ্যতা ও স্বজনপ্রীতি’ নিয়ে। একইসঙ্গে এ ধরনের তালিকা প্রকাশের পর তা ‘চাপের মুখে’ স্থগিত করলে, সেই পুরস্কারপ্রাপ্তদের যে ‘অপমান’ করা হয়, সেটিরও প্রতিবাদ জানিয়েছেন অনেকে।
‘বাংলা একাডেমি কি আওয়ামী লীগারদের পুনর্বাসন-পুরস্কারকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে?’– এ প্রশ্ন তুলে গল্পকার ও ঔপন্যাসিক মাহবুব মোর্শেদ তার ফেসবুক অ্যাকাউন্টে লিখেছেন, ‘শেখ মুজিবকে নিয়ে বইয়ের পর বই লেখা ফারুক নওয়াজ ও মোহাম্মদ হাননান কীভাবে পুরস্কার পেলেন, সে প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে আমাদের। এ দুজন নিশ্চিতভাবেই আওয়ামী লীগার।’ সমালোচনা উঠেছে রেজাউর রহমানকে নিয়েও, যিনি প্রথম আলোর সম্পাদক মতিউর রহমানের ভাই। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক সাহিত্যিক বলেন, কীটতত্ত্ব নিয়ে তার (রেজাউর রহমানের) গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে, কেউ তেমন জানেন না। আমার মনে হয়, তার ক্ষেত্রে ক্যাটাগরিটা ঠিক হয়নি বলা যেতে পারে। এছাড়া সৈয়দ জামিল আহমেদকে ফোকলোরে না দিয়ে গবেষণায় দিলে সেটি আরও যথাযথ হতো।
ফারুক নেওয়াজের বিষয়টি নিয়েও সমালোচনা ওঠার কারণ হিসেবে তিনি বলেন, প্রতিবছর ফারুক নেওয়াজের নাম শর্ট লিস্টে যেতো এবং কমিটি বাতিল করে দিতো এই বলে যে জিয়াউর রহমানকে নিয়ে তার কবিতা আছে। সম্প্রতি কিছু দিন তিনি বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে কবিতা লিখেছেন এবং এই দোলাচলে তাকে নিয়ে একটু দৃষ্টিকটু হয়েছে। আর আকিমুন রহমান ও মালেকা বেগমের নাম শর্ট লিস্টে থাকলেও কমিটি চূড়ান্ত তালিকায় কোনও নারীকে অন্তর্ভুক্ত না করারও সমালোচনা উঠেছে।
এই পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে রবিবার (২৬ জানুয়ারি) এক সংবাদ সম্মেলনে বাংলা একাডেমির পুরস্কার প্রদানের প্রক্রিয়াটা নিয়ে সমালোচনা করেছেন সংস্কৃতি উপদেষ্টা মোস্তফা সরওয়ার ফারুকী। তিনি বলেন, ‘এটার মধ্যে ওপেননেস নাই। এটা এক ধরনের কোটারির মধ্যে ফেলে…। কয়েকজন ফেলো আছে, তারা নমিনেট করবে। এখন এই ফেলোরা কোন সময়ে নিয়োগ হয়েছে। গত ১৫ বছরে কারা ফেলো হয়েছে, তারা কোন মতাদর্শে বিশ্বাস করে, তারা কোন লেখা পছন্দ করে। ওটার ওপরে ভিত্তি করে যদি নির্বাচন কমিটিকে চারটা পচা টমেটো দেওয়া হয়…, আমি বলছি না যাদের নাম এসেছে তারা খারাপ। কোনও একটি বিশেষ ক্যাটাগরিতে যদি এরকম দুই-তিনটা অপশন দেওয়া হয়, নির্বাচক কমিটির কিছু করার থাকে না। ফরমুলাটাই এরকম। যদি এই ৩০ ফেলো বলে হিটলারের বইকে শ্রেষ্ঠ বই বলা উচিত, তাহলে নির্বাচক কমিটি এর থেকে বের হতে পারবে না।’
কিন্তু নির্বাচন কমিটির অবস্থান নিয়ে আপত্তি তোলা ব্যক্তিরা বলছেন, কয়েকজন তাদের ক্ষমতা খাটিয়ে তালিকা করেছেন। এর মধ্যে কবি সাজ্জাদ শরিফকে নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দেখা গেছে বেশি। কমিটিতে কারা ছিলেন জানতে চাইলে সূত্র জানায়, এটা গোপনে রাখা হয়। মোট সাত জনের মধ্যে মহাপরিচালক, গভর্নিং বডির একজন এবং বাকি পাঁচ জন থাকেন। এবারে সেই পাঁচ জনের মধ্যে ছিলেন সাজ্জাদ শরিফ, ফিরোজ আহমেদ, আফসানা বেগম, মোরশেদ শফিউল হাসান, খলিকুজ্জামান ইলিয়াস। তিনি আরও বলেন, এই কমিটির মধ্যে অনেকের অন্যের কাজ মূল্যায়নের যোগ্যতা আছে কিনা, সেটি নিয়ে প্রশ্ন তোলা যায়।
ঘোষিত তালিকাটি ইতোমধ্যে সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়েছে উল্লেখ করে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক অধ্যাপক মোহাম্মদ আযম বলেন, ‘তালিকাটি পর্যালোচনা করা হচ্ছে। গত গণহত্যা ও জনবিরোধী রাজনীতির সঙ্গে যদি কারও সরাসরি সম্পৃক্ততার প্রমাণ পাওয়া যায়, যদি এ ধরনের সরাসরি সাক্ষ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে নিশ্চয়ই বাতিল করা হবে। তার পরিবর্তে কী ধরনের ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সেটি যে কমিটি কাজ করছে, সেই কমিটি দেখবে।’
যে কমিটির তালিকা বাতিল হলো রিভিউ তালিকাও সেই কমিটির দেওয়ার এখতিয়ার আছে কিনা—প্রশ্নে কবি কাজল শাহনেওয়াজ বলেন, ‘এই তালিকা করার জন্য যে প্রক্রিয়া ব্যবহার করা হয়, সেটাই ত্রুটিপূর্ণ। সেক্ষেত্রে আগের লোকেরা, আগের কাঠামোতেই যদি এই তালিকা করে, সেটি রিপিটেশন ছাড়া কিছু হবে না। ফলে আগে দরকার কাঠামোটাকে রিভাইজ করা এবং সেখানে কমিটিতে যারা আছেন, তাদের বিষয়েও খোঁজ-খবর নিতে হবে। যেহেতু তাদের সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা উঠেছে। যে ইস্যুগুলো সামনে আসছে, সেগুলো যেন আবার না উত্থাপিত হয়, সেটি খেয়াল করা জরুরি।’