‘পুরো ঘটনাটাই পরিকল্পিত ছিল। আমাদের আটকে নিয়ে প্রায় দুই ঘণ্টা মারধর করা হয়। পুলিশ ও প্রশাসনকে আমরা বারবার অনুরোধ করার পরও সাহায্য পাইনি। ওদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের মেরে ফেলা। এজন্য সবার মাথায় কোপ দেওয়া হয়’।
কথাগুলো বলছিলেন, উত্তরা নওয়াব হাবিবুল্লাহ মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী আবির খান। গাজীপুরে সাবেক মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হকের বাড়িতে ভাঙচুরের সময় এলাকাবাসীর হামলায় আহত হন তিনি।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি ভবনের ছয় তলায় চিকিৎসাধীন আছেন আবিরসহ ঘটনায় আহত হওয়া পাঁচজন। এছাড়াও একজন আইসিইউতে ও একজন এইচডিইউতে ভর্তি রয়েছেন। হাসপাতাল সূত্র জানায়, চিকিৎসাধীনরা হলেন– ইয়াকুব আলী, গৌরব ঘোষ, শুভ শাহরিয়ার, আব্দুর রহমান ইমন, আবির খান, সাব্বির খান হিমেল। এছাড়াও এইচডিইউতে রয়েছেন কাজী অমর হামজা, আর আইসিইউতে রয়েছেন কাশেম।
সোমবার (১০ ফেব্রুয়ারি) বিকালে বাংলা ট্রিবিউনকে আবির আরও বলেন, 'আমরা ফোন পেয়ে ওখানে যাই। এরপর বুঝতে পারি আমাদের ট্র্যাপে ফেলা হয়েছে। প্রথমেই আমাদের ফোন, মানিব্যাগ নিয়ে নেয়। এখন অনেকটাই সুস্থ। তবে এখন মাথায় আরেকটি সেলাই দেওয়া লাগবে আমার। ওটা আগে খেয়াল করা হয়নি। চুল ফেলার পর কাটাটা দেখা গেছে।'
আবিরের মা পারভীন বলেন, 'খবর পেয়ে যাওয়ার পর দেখি ছেলের অবস্থা গুরুতর। শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। হাসপাতালে চিকিৎসার জিনিস ছিল না, বারবার বাইরে থেকে আনতে হচ্ছিল।'
আবিরের পাশের বেডে চিকিৎসাধীন আছেন তার চাচাতো ভাই সাব্বির খান হিমেল। সে বর্তমানে উত্তরা ইউনিভার্সিটির এলএলবি অনার্স দ্বিতীয় সেমিস্টারে অধ্যয়নরত। হিমেল বলেন, ‘আমরা ঘটনার আকস্মিকতায় কিছুই বুঝে উঠতে পারছিলাম না। একটু পর বুঝতে পারি আমাদের ট্র্যাপে ফেলা হয়েছে। পালানোর সুযোগ ছিল, কিন্তু চাচাতো ভাই রয়েছে, বন্ধুরা রয়েছে, ওদের রেখে পালাতে পারিনি। আমাকে প্রচুর আঘাত করা হয়। মাথায় কোপ দেওয়া হয়, পিঠে অনেকগুলো কোপ দেওয়া হয়েছে। বাম হাতটা ভেঙে গেছে। পায়েও অনেক আঘাত করেছে। বিপ্লবের পরে এমন একটা ঘটনার মুখোমুখি হতো হবে আমরা বুঝতে পারিনি।'
মর্নিং সান স্কুলের নবম শ্রেণির শিক্ষার্থী শুভ শাহরিয়ার। তার মাথায় ও চোখে গুরুতর আঘাত লেগেছে, চোয়াল ভেঙে গেছে। শুভর বাবা ফজলুল হক জানান, লালমনিরহাটে বাড়ি তাদের। গাজীপুরে একটি ফ্যাক্টরিতে কাজ করেন তিনি। ঘটনার দিন সন্ধ্যা সাড়ে সাতটায় প্রাইভেট পড়া শেষ করে শুভ তাকে ফোন করে। এরপর রাত সাড়ে আটটা থেকে শুভর ফোন বন্ধ পাচ্ছিলেন তিনি। অনেক খোঁজাখুঁজি করেও পাচ্ছিলেন না ছেলেকে। রাতে সাড়ে ১১টা নাগাদ ফোন পেয়ে হাসপাতালে ছুটে যান।
তিনি বলেন, 'আজ দুইদিন পর ছেলের ডান চোখটা খুলেছে। পুরো রক্ত জমে আছে। স্যুপ ছাড়া কিছু খেতে পারছে না। আমি লেখাপড়া জানি না, ছেলেকে লেখাপড়া শিখিয়ে বড় করতে চেয়েছিলাম। এখন কী হবে আল্লাহ জানেন।'
কথা বলতে বলতে চোখের পানি মুছে ফজলুল হক বলেন, 'মানুষ এভাবে মারতে পারে কীভাবে। ছেলেটা এভাবে পড়ে আছে মানতে পারছি না। এখানে সবার আত্মীয় আসছে। আমারতো ঢাকায় কেউ নেই। বাড়িতে মেয়ে আর স্ত্রী রয়েছে। তাদের নিয়ে চিন্তা আছে। সবার কাছে দোয়া চাই আমার ছেলের জন্য।'
চান্দুরা হাই স্কুলের শিক্ষার্থী ও এসএসসি পরীক্ষার্থী আব্দুর রহমান ইমন বলেন, 'আমাদের পুরো ষড়যন্ত্র করে মারা হয়েছে। ছেলে-বুড়ো সবাই একজোট ছিল। আমরা বারবার বলছিলাম, আমরা চোর-ডাকাত না, আমরা ছাত্র। এখানে ফোন পেয়ে এসেছি। কেউ আমাদের কথা শুনছিল না। অনেক সময় ধরে মারধর করে। আমাদের কোনও সাহায্য আসেনি। আমার মাথায় কোপ দিয়েছে আর বাম হাত ভেঙে দিয়েছে।'
ইমনের মা রাবেয়া বেগম বলেন, 'আল্লাহ ছেলের হায়াত রেখেছে হাজার শুকরিয়া। আমরা আর কিছু বলার নেই। এখন দ্রুত সুস্থ হয়ে যাক আল্লাহর কাছে দোয়া করছি।'
ঘটনার দিন স্পটে উপস্থিত ছিলেন নাবিল উল্লাহ। নর্দার্ন ইউনিভার্সিটিতে টেক্সটাইল ২য় সেমিস্টারে অধ্যয়নরত তিনি। ঘটনার দিনের কথা মনে করে নাবিল বলেন, আমি ঘটনাস্থলে পরে পৌঁছাই। গিয়ে দেখি বাড়িটা চারপাশ থেকে ঘেরাও করা। পরে আমি চলে আসার চেষ্টা করি। কিছুদূর আসতেই একজন আমার গলায় বটি ধরে আটকে দেয়। পরে কয়েকজন মিলে আমার মাথা ও শরীরে বাঁশ ও কাঠ দিয়ে মারধর করে। এ সময় মসজিদের মাইকে ঘোষণা হতে শুনি, জয় বাংলা, মোজ্জামেল এমপির বাড়িতে ডাকাত পড়েছে। কিছুক্ষণ পর একটা সিএনজিতে তুলে আমাকে আবার স্পটে নিয়ে আসে। তবে সিএনজি চালকের বুদ্ধিমত্তায় আমি বেঁচে যাই সেদিন।
তিনি আরও বলেন, 'তারা পরিকল্পিতভাবে এই ঘটনা ঘটিয়েছে। যারা হামলা করেছিল সবাই আওয়ামী লীগ পরিবারের। সবাই ইউনাইটেড ছিল। আমাকে মারার সময় বলছিল– তোরা মোজাম্মেল দাদার বাড়িতে এসেছিস, তোদের ফেরা হবে না।'
আরও পড়ুন:
- গাজীপুরে আহত ৭ জন ঢামেকে, একজনকে নেওয়া হচ্ছে আইসিইউতে
- গাজীপুরে হামলায় আহত একজনকে নেওয়া হয়েছে লাইফ সাপোর্টে
- সাবেক মন্ত্রী মোজাম্মেল হকের বাড়িতে ভাঙচুরের সময় ১৫ জনকে পিটিয়ে আহত
- গাজীপুরে হামলায় জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনা হবে: স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা
- গাজীপুরে মসজিদের মাইকে ঘোষণা দিয়ে পিটুনি, ফেসবুকে যা লিখলেন সারজিস আলম
- অপারেশন ডেভিল হান্ট: গাজীপুরে ৮৩ জন আটক
- গাজীপুরে মোজাম্মেল হকের বাড়িতে শিক্ষার্থীদের ওপর হামলার ঘটনায় মামলা, গ্রেফতার ৩৪