বিদ্যমান শ্রম আইন সংশোধনের কাজ কত দূর, এ প্রশ্ন সবার। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে শেখ হাসিনার সরকার এবং এরপরে মুহাম্মদ ইউনূসের সরকার বিদ্যমান শ্রম আইন সংশোধনের উদ্যোগের কথা জানালেও এখনও পর্যন্ত তা বাস্তবায়ন হয়নি।
সাবেক আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ২০২৪ সালের মে মাসে এবং অন্তর্বর্তী সরকারের শ্রম মন্ত্রণালয়ের সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান একই বছরের নভেম্বরে প্রকাশ্যে পৃথক দুটি অনুষ্ঠানে শ্রম আইন সংশোধনের অঙ্গীকার করেছিলেন। শ্রম মন্ত্রণালয় সূত্রে এসব তথ্য জানা গেছে।
মন্ত্রণালয় জানা যায়, গত বছরের ২৮ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পরিচালনা পর্ষদের অধিবেশনে এবং চলতি বছরের ১০ থেকে ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গভর্নিং বডির বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে বিদ্যমান শ্রম আইনের সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল সরকার।
সূত্র জানায়, বাংলাদেশের বিদ্যমান শ্রম আইন সংশোধন দীর্ঘদিনের প্রতীক্ষিত বিষয়। গত বছরের ডিসেম্বরে রাষ্ট্রপতি কয়েকটি মূল ধারায় আরও সংশোধনীর প্রয়োজনীয়তার কথা উল্লেখ করে বিলে সই না করে ‘বাংলাদেশ শ্রম (সংশোধন) বিল-২০২৩’ ফেরত পাঠিয়েছিলেন।
এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বরে শ্রমিকদের উত্থাপিত ১৮ দফা দাবি মেটাতে ও আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সামঞ্জস্য করতে ২০২৫ সালের মার্চের মধ্যে শ্রম আইন সংশোধনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল বাংলাদেশ। শ্রম ও কর্মসংস্থান সচিব এএইচএম শফিকুজ্জামান গত ৯ নভেম্বর রাজধানীতে অনুষ্ঠিত একটি অনুষ্ঠানে জানিয়েছিলেন— গত ২৮ অক্টোবর থেকে ৭ নভেম্বর জেনেভায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) পরিচালনা পর্ষদের ৩৫২তম অধিবেশনে বাংলাদেশ এই প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করে। এএইচএম শফিকুজ্জামান জানান, শিল্প খাতে শ্রমিক অসন্তোষের সময় সেপ্টেম্বরে আমরা শ্রমিকদের ১৮ দফা দাবি মানার কথা জানিয়েছিলাম। তা পূরণের জন্য ইতোমধ্যে কাজ শুরু করেছি। দাবির অনেকগুলোই বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তবে যেগুলো বাস্তবায়ন করা যায়নি, সেগুলো এখনও আলোর মুখ দেখেনি।
জানা গেছে, বাংলাদেশের পক্ষে প্রস্তাবিত শ্রম অধ্যাদেশে ১০১টি ধারা ও উপধারা সংশোধনের কথা বলা হয়েছিল। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় ১০ থেকে ২০ মার্চ অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) গভর্নিং বডির বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এ তথ্য তুলে ধরা হয়। অপরদিকে সাবেক সরকারের আমলে শ্রম আইনে সব কারখানায় ১৫ শতাংশ শ্রমিকের সম্মতিতে ট্রেড ইউনিয়ন গঠনের বিধান রেখে ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন’ সংশোধনের প্রস্তাব করা হয়েছিল। অর্থাৎ ১৫ শতাংশ শ্রমিক রাজি হলেই তারা তাদের কারখানায় একটি ট্রেড ইউনিয়ন গঠন করতে পারবে— আইএলও’র এ পরামর্শ মেনে নিয়ে তা সংশোধিত শ্রম আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছিল। বিদ্যমান শ্রম আইনের এসবের কিছুই সুরাহা না হওয়ার মধ্য দিয়েই এ বছর পালিত হচ্ছে মহান মে দিবস-২০২৫।
দিনটি গোটা বিশ্বে ‘মে ডে’ বা শ্রম দিবস বা আন্তর্জাতিক শ্রমিক দিবস হিসেবে পালিত হয়ে আসছে। ১৮৮৬ সালের ১ মে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো শহরে শ্রমের মর্যাদা, শ্রমের মূল্য এবং দৈনিক আট ঘণ্টা কাজের দাবিতে আন্দোলনরত শ্রমিকরা যে আত্মাহূতি দিয়েছিলেন, তাদের সে আত্মত্যাগের সম্মানে বাংলাদেশসহ সারা বিশ্বে দিবসটি শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিন হিসেবে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালন করা হয়। বিশ্বজুড়ে শ্রমিকদের ঐতিহাসিক সংগ্রাম ও অর্জনের কথা মনে করিয়ে দিতে বাংলাদেশেও মে দিবসে বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করা হয়। মে দিবসে এবারের প্রতিপাদ্য ‘শ্রমিক-মালিক এক হয়ে, গড়ব এ দেশ নতুন করে’। দিবসটি উপলক্ষে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বাণী দিয়েছেন। বাণীতে তিনি বলেন, ‘দেশকে নতুন করে গড়ে তুলতে হলে ঐক্য, পারস্পরিক শ্রদ্ধা এবং আস্থার পরিবেশ সুদৃঢ় করতে হবে। শ্রমিক-মালিক সুসম্পর্কের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতি এগিয়ে নিতে মে দিবসের গুরুত্ব অপরিসীম।’
মহান মে দিবস উলক্ষে শ্রম উপদেষ্টা মো. সাখাওয়াত হোসেন বলেছেন, একসময় স্লোগান ছিল— ‘দুনিয়ার মজদুর, এক হও’। এখন তা বদলে গেছে। এখনকার নতুন স্লোগান হচ্ছে ‘দুনিয়ার মালিক-শ্রমিক, এক হও’। এখনকার ভালো মালিকেরা শ্রমিকদের নিজের সন্তানের মতো মনে করেন।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, আইএলও’র একটি পরামর্শ হচ্ছে— থ্রেশহোল্ড (ট্রেড ইউনিয়ন গঠনে শ্রমিকদের সম্মতির হার) কমিয়ে আনা। সরকার আগে থেকেই এই থ্রেশহোল্ড ২০ শতাংশ থেকে ১৫ শতাংশে নামিয়ে এনেছিল। কিন্তু সেটা যে কারখানায় ৩ হাজার বা তার চেয়ে বেশি শ্রমিক আছে, তাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হওয়ার কথা। কিন্তু এখন সব কারখানার জন্যই ১৫ শতাংশ থ্রেশহোল্ড রাখার কথা বিবেচনা করা হচ্ছে বলে জানা গেছে। আরও জানা গেছে, আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার পরিচালনা পর্ষদে বাংলাদেশের শ্রমিক অধিকার নিয়ে কয়েকটি দেশ ২০১৯ সালে নালিশ করেছিল। সেই নালিশের পর বহুবার আইএলও’র পরিচালনা পর্ষদকে বাংলাদেশ জানিয়েছে যে, দেশে শ্রমিকদের অধিকার কেবল রক্ষাই হয়নি, শ্রমিকদের অধিকার আরও সুদৃঢ় হয়েছে। সুতরাং, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আইএলও-তে অহেতুক যে নালিশ করা হয়েছে, সেটা শেষ হওয়া উচিত।
শ্রম মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানিয়েছে, বিদ্যমান শ্রম আইন সংশোধন ও বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট— এই দুটি দাবি এখনও বাস্তবায়ন করা হয়নি। শ্রমিক ইউনিয়ন নেতারা প্রতি বছর পাঁচ শতাংশের বেশি ইনক্রিমেন্টের দাবি করেছেন। সেটিসহ বর্তমানে ট্রেড ইউনিয়ন বিধি ও ডকুমেন্টেশনের প্রয়োজনীয়তা সহজ করাসহ আইনের সম্ভাব্য সংশোধনী নিয়ে কাজ করছে একটি ত্রিপক্ষীয় কমিটি।
জানা গেছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), আইএলও, বিদেশি ব্যবসায়ী ও ক্রেতা প্রতিষ্ঠান, উত্তর আমেরিকার পোশাক ব্যবসায়ী এবং মার্কিন সরকার বাংলাদেশকে শ্রম আইন সংশোধন, ট্রেড ইউনিয়ন আইন সহজ করা, ইউনিয়ন নিবন্ধন সহজ করাসহ ইউনিয়ন গঠনে প্রয়োজনীয় শ্রমিক সীমা কমানোর আহ্বান জানিয়েছে।
বাংলাদেশে বর্তমানে পোশাক কারখানায় ইউনিয়ন গঠনের জন্য ২০ শতাংশ শ্রমিকের ঐকমত্য ও স্বাক্ষর প্রয়োজন। ইউনিয়ন নেতারা ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এই সীমা ৫ থেকে ১০ শতাংশে নামিয়েং আনার কথা বলেছেন। একইসঙ্গে দেশের রফতানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল (ইপিজেড) ও ইপিজেডের বাইরের শ্রমিকসহ সব শ্রমিকের জন্য একটি অভিন্ন শ্রম আইন প্রণয়নে সরকারের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তারা।
উল্লেখ্য, আইএলও পরিচালনা পর্ষদ মূলত আইএলও’র নির্বাহী সংস্থা। তারা বছরে তিনবার অধিবেশনে বসে, যথাক্রমে মার্চ, জুন ও নভেম্বরে। সেখানে আইএলও’র নীতিমালা নিয়ে সিদ্ধান্ত হয়, আন্তর্জাতিক শ্রম সম্মেলনের এজেন্ডা নির্ধারণ করে, সম্মেলনে উপস্থাপনের জন্য খসড়া কর্মসূচি ও বাজেট গ্রহণ এবং মহাপরিচালক নির্বাচন করে।