X
সোমবার, ৩০ জুন ২০২৫
১৬ আষাঢ় ১৪৩২

আমন মৌসুমে ইউরিয়া সরবরাহ ব্যাহতের শঙ্কা!

শফিকুল ইসলাম
০৭ মে ২০২৫, ২১:০২আপডেট : ১৪ মে ২০২৫, ১৭:৩৮

আগামী আমন মৌসুমের চাষাবাদ নির্বিঘ্ন করতে ইউরিয়া সার আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক দরপত্রও আহ্বান করা হয়েছে। অভিযোগ রয়েছে যে, গত বছরের বোরো মৌসুমে সারের সরবরাহ সঠিকভাবে না হওয়ায় দেশের বিভিন্ন জায়গায় সংকট দেখা দিয়েছিল। ইউরিয়া সার সরবরাহে অব্যবস্থাপনা, অনিয়ম এবং কিছু দুর্নীতি এর জন্য দায়ী বলে মনে করেন ভুক্তভোগীরা। সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।

সংশ্লিষ্টরা মনে করেন, ইউরিয়া সার সরবরাহ চেইনে অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে বিসিআইসি, বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে আগামী মৌসুমেও কৃষকরা সঠিক সময়ে পর্যাপ্ত ইউরিয়া সার পাবেন কিনা তা নিয়ে শঙ্কা রয়েছে। 

জানা গেছে, জিটুজি (এ২এ) ভিত্তিতে মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত (ইউএই) এবং কাতার থেকে আমদানিকৃত ইউরিয়া গ্রানুলার (বড়দানা) সার সরবরাহ করা হয় বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশনের (বিসিআইসি) মাধ্যমে। এই সার আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বান করে বাংলাদেশ শিপিং করপোরেশন, যেখানে সর্বনিম্ন দরদাতাকে কার্যাদেশ দেওয়া হয়ে থাকে।

সুত্র জানিয়েছে, বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসি) সম্প্রতি প্রায় ৩০ হাজার মেট্রিক টন ইউরিয়া সার আমদানির জন্য আন্তর্জাতিক দরপত্র আহ্বান করেছে। সাধারণত এমন টেন্ডারে জাহাজ ভাড়া, ট্রাক ভাড়া, লাইটার ভাড়া, লজিস্টিক সাপোর্ট, অপারেশনাল খরচ এবং নির্ধারিত মুনাফা যোগ করে প্রতি মেট্রিক টন ইউরিয়ার জন্য আনুমানিক ৫০ থেকে ৫২ মার্কিন ডলার পর্যন্ত খরচ ধরা হয়ে থাকে। তবে এবারের টেন্ডারে দেখা গেছে, অস্বাভাবিক প্রবণতা। বিসিআইসি’র সাধারণ বাজেট কাঠামোর তুলনায় ৬ থেকে ৮ ডলার কমে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান দরপত্র জমা দিচ্ছে। সংশ্লিষ্ট মহলে বিষয়টি আলোচনার জন্ম দিয়েছে এবং অনেকেই এটিকে ‘মূল্যযুদ্ধ’ বা প্রাইস ওয়ার হিসেবে দেখছেন।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এমন কম দরপ্রদান যদি প্রকৃত খরচ কাঠামোর নিচে হয়, তবে তা ভবিষ্যতে পরিষেবা বা ডেলিভারিতে ঘাটতির কারণ হতে পারে। একজন জাহাজ পরিবহন বিশ্লেষক জানান, বাজেট যদি ৫০ ডলার হয়, আর কেউ ৪৪ ডলারে কাজ করতে চায়, তাহলে সেখানে হয়তো গুণমান, নিরাপত্তা কিংবা সময়সীমা বিপন্ন হতে পারে।

সাধারণত বিসিআইসির প্রতি শিপমেন্টে গড়ে প্রতি মেট্রিক টনে ৫০-৫২ মার্কিন ডলার খরচ ধরে থাকে। কিন্তু সম্প্রতি দেখা যাচ্ছে, কিছু শিপিং এজেন্ট ৪২-৪৪ ডলারে টেন্ডার নিচ্ছে। প্রথম দর্শনে বিষয়টি সরকারের ব্যয় সাশ্রয় মনে হলেও এর অন্তরালে লুকিয়ে আছে ভয়াবহ দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা এবং সারের চোরাচালান, যার খেসারত দিতে হচ্ছে দেশের কৃষক সমাজ এবং মুনাফা ভোগ করছে এক শ্রেণির ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান।

সূত্র জানিয়েছে, বর্তমানে চারটি প্রতিষ্ঠান বিসিআইসির ইউরিয়া সরবরাহ কার্যক্রম পরিচালনা করছে। এগুলো হচ্ছে, বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড, তাইবা সাইফুল্লাহ জিএল, সামিট অ্যাসোসিয়েট ও ইন্টারওশান। সেখানে বঙ্গ ট্রেডার্স লিমিটেড এবং তাইবা সাইফুল্লাহ জিএল তাদের বরাদ্দকৃত সার যথাসময়ে বিসিআইসি গুদামে বুঝিয়ে দিলেও সামিট অ্যাসোসিয়েট ও ইন্টারওশান পুরোপুরি বুঝিয়ে দিতে ব্যর্থ হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তারা সাব-কন্ট্রাক্টের মাধ্যমে তৃতীয়পক্ষকে দায়িত্ব দিয়ে সারের নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। আইন অনুযায়ী পরিবহন ঠিকাদার সরবরাহ কার্যক্রমে সাব-কন্ট্রাক্ট দেওয়ার সুযোগ নেই। একইভাবে ইন্টারওশানের বিরুদ্ধেও অভিযোগ রয়েছে—তারা বরাদ্দকৃত সারের পুরোটা সরবরাহ না করে বিভিন্ন গুদামে বরাদ্দের বিপরীতে অর্থের বিনিময়ে সমন্বয় করছে এবং কিছু অংশ বাজারে বিক্রি করে দিচ্ছে। অথচ বিসিআইসির অনেক কর্মকর্তা বিষয়টি জানা সত্ত্বেও রহস্যজনকভাবে নিশ্চুপ রয়েছেন। এ ছাড়াও সামিট অ্যাসোসিয়েটের এমভি সেভেন গেস-৪ জাহাজের তলা ফেটে নদীতে সার নষ্ট হওয়ায়  ৪৭ মেট্রিক টন সার কম পাওয়া গেছে। অথচ শিপিং এজেন্ট এমএম শিপিং দাবি করছে ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ক্ষতিপূরণ। সারের বাজারমূল‍্য বেশি দেখিয়ে এই অস্বাভাবিক ক্ষতিপূরণ দাবির পেছনে দুর্নীতির গন্ধ স্পষ্ট।

বিশেষজ্ঞদের মতে, এই দুর্নীতি এবং অব্যবস্থাপনার ফলে কৃষকের কাছে সার সঠিক সময়ে পৌঁছায় না, সারের ঘাটতি তৈরি হয়, যার ফলে খোলা বাজারে সারের দাম বেড়ে যায়। কৃষক বাধ্য হয়ে বেশি দামে সার কিনতে বাধ্য হন।

অভিযোগ রয়েছে, সামিট অ্যাসোসিয়েটের সঙ্গে রাজনৈতিক প্রভাবশালী পরিবারের সম্পর্ক আছে। প্রতিষ্ঠানের শুরুর দিকে এর শেয়ারহোল্ডার ছিলেন দেলোয়ার হোসেন, যিনি তৎকালীন সরকারের ক্ষমতাসীন দলের প্রভাবশালী এক নেতার নিকটাত্মীয় ছিলেন। বর্তমানে এই প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান মো. ওয়াহিদুর জামান জাকির, যার নেতৃত্বে পূর্বের দুর্নীতির ধারা অব্যাহত রয়েছে।

কৃষি বিশেষজ্ঞ এম এ, খায়ের জানিয়েছেন, আমদানি করা সারের সরবরাহে যদি স্বচ্ছতা নিশ্চিত না করা হয়, তাহলে কৃষি উৎপাদন ব্যাহত হবে। এই দুর্নীতির দায় শুধু কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের নয়, সংশ্লিষ্ট সরকারি কর্মকর্তাদেরও। সংশ্লিষ্ট সূত্র বলছে, এই দুর্নীতি বন্ধে শক্ত পদক্ষেপ না নিলে রাষ্ট্র আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে এবং কৃষি খাতে এর প্রভাব ভয়াবহ আকার ধারণ করবে।

ইউরিয়া সারের সরবরাহ চেইনে এই অব্যবস্থাপনা এবং দুর্নীতি বন্ধ করতে হলে বিসিআইসি, বাংলাদেশ শিপিং কর্পোরেশন, এবং সংশ্লিষ্ট সরকারি সংস্থাগুলোর মধ্যে জবাবদিহি ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে।

নভো ট্রান্সপোর্ট এর স্বত্বাধিকারী সারোয়ার হোসেন সৌরভ বলেন, আমাদের ৭১৪০ বস্তা মাল চুরি হয়ে যায়। যার মধ্যে ৩ হাজার ১৫ বস্তা উদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছি। বাকিটা উদ্ধারের চেষ্টা চলছে। এ বিষয়ে থানায় মামলা দায়ের করা হয়েছে।

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বাংলাদেশ কেমিক্যাল ইন্ডাস্ট্রিজ করপোরেশন (বিসিআইসির) বিসিআইসির চেয়ারম্যান মো. নুরুজ্জামান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘বিষয়টি আমার জানা নেই। খোঁজ নিয়ে জানাতে পারবো। অপরাধী হলে অবশ্যই শাস্তি পাবে।’

/এপিএইচ/এমওএফ/
সম্পর্কিত
৩০ হাজার টন সার আমদানির সিদ্ধান্ত
৭০ হাজার টন সার আমদানির সিদ্ধান্ত
দুটি সার গুদাম নির্মাণের সিদ্ধান্ত
সর্বশেষ খবর
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ জুন, ২০২৫)
টিভিতে আজকের খেলা (৩০ জুন, ২০২৫)
‘পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিপর্যয়ের শিকার নারীরা’
‘পরিবেশ বিপর্যয়ের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ বিপর্যয়ের শিকার নারীরা’
ভারতবিরোধী কনটেন্ট করায় ক্রিয়েটরের বাড়িতে হামলার অভিযোগ
ভারতবিরোধী কনটেন্ট করায় ক্রিয়েটরের বাড়িতে হামলার অভিযোগ
ঢাকায় চিকিৎসায় এসে একই পরিবারের ৩ জনের রহস্যজনক মৃত্যু
ঢাকায় চিকিৎসায় এসে একই পরিবারের ৩ জনের রহস্যজনক মৃত্যু
সর্বাধিক পঠিত
‘সবাইকে ম্যানেজ করা আছে, দুদক কিংবা কেউ কিছুই করতে পারবে না’
মৃত ব্যক্তি ও প্রবাসীর নামে সরকারি অর্থ আত্মসাৎ উপপরিচালকের‘সবাইকে ম্যানেজ করা আছে, দুদক কিংবা কেউ কিছুই করতে পারবে না’
ঘরে ঢুকে নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা, যুবককে পিটিয়ে হত্যা এলাকাবাসীর
ঘরে ঢুকে নারীকে ধর্ষণের চেষ্টা, যুবককে পিটিয়ে হত্যা এলাকাবাসীর
মুরাদনগরে ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় ৩ জন গ্রেফতার
মুরাদনগরে ধর্ষণ ও ভিডিও ছড়ানোর ঘটনায় ৩ জন গ্রেফতার
এনবিআরের শীর্ষ ৬ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক
এনবিআরের শীর্ষ ৬ কর্মকর্তার দুর্নীতি অনুসন্ধান করছে দুদক
এনবিআরের সব চাকরি ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা
এনবিআরের সব চাকরি ‘অত্যাবশ্যকীয় সার্ভিস’ ঘোষণা