ভাঙা গ্লাসের দৃশ্য দেখলে এখনও ভাঙচুরের ঘটনা মনে পড়ে। ডিউটিতে এলে আগের মতো আনন্দ পাই না। মানুষ আগের মতো মূল্যায়ন করে না। অন্যরকম একটা উৎকণ্ঠা কাজ করে। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের দায়ভার আমাদের নিতে হচ্ছে। আমরা সর্বোচ্চটুকু দিয়ে চেষ্টা করছি পুলিশের ওপর আবার সাধারণ মানুষের আস্থা ফিরিয়ে আনতে। কারণ আমরা চাকরি করি মানুষের সেবা করার জন্য। মানুষের সঙ্গে যদি দূরত্ব না ঘোচে তাহলে আমাদের কাজ করা কঠিন হয়ে যাবে। বাংলা ট্রিবিউনকে এভাবেই কথাগুলো বলেছিলেন লালবাগ থানার কনস্টেবল ইছমত আলী।
থানা ভাঙচুর এবং কর্মস্থলে পুলিশের আতঙ্কের বিষয়ে তিনি বলেন, যখন শেখ হাসিনা সরকারের পদত্যাগের ঘোষণা এলো, তখন আমরা শুনতে পেলাম ঢাকার বেশ কিছু থানায় হামলা হয়েছে, পুলিশকে মারা হচ্ছে। পুলিশের ওপর হামলার খবর শুনে আমরা কর্তব্যরত পুলিশ সদস্যরা বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। থানার ভেতর সবাই সতর্ক অবস্থান নিই। সারা বিকাল অন্যরকম এক আতঙ্কে কেটেছে আমাদের। সন্ধ্যার পর খবর পাই থানার সামনে লোকজন জড়ো হচ্ছে। আনুমানিক রাত ৮টায় হাজার খানেক মানুষ থানায় ঢুকে ভাঙচুর চালায়।
সরেজমিন দেখা যায়, গত ৫ আগস্ট সরকারের পটপরিবর্তনের পর বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার ভাঙচুর করা লালবাগ থানার সংস্কার কাজ এখনও হয়নি। থানার ভাঙা কাঁচের দেয়ালে এখনও ক্ষত স্পষ্ট। নাম ফলক এখনও ছেঁড়া। দরজাটা পর্যন্ত সংস্কার হয়নি। ডিউটিরত পুলিশ সদস্যদের মাঝে আতঙ্ক বিরাজ করছে।
লালবাগ থানায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়ে ইসমত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, সেদিন থানার সামনে রাখা ৪টি গাড়ি ভাঙচুর ও একটিতে অগ্নিসংযোগ করা হয়। থানার দরজা, জানালা গ্লাস সহকারে যা ছিল, অধিকাংশ জিনিসপত্র ভেঙে ফেলা হয়েছে। এ সময় আমরা তাড়াহুড়ো করে নিরাপদে থানার বাইরে চলে যাই। উত্তেজিত ছাত্র-জনতা থানার ভেতরে ভাঙচুর চালায় এবং অস্ত্র লুট করে নিয়ে যায়।
পরবর্তীতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার নির্দেশে আমরা আবার কাজে যোগদান করি। যোগদানের পরে শুনেছি যেসব অস্ত্র ওই দিন রাতে লুট হয়েছিল তার কিছু ফেরত এসেছে। একটা বিষয় পরিষ্কার করা দরকার। সেটা হচ্ছে, সেদিন সাধারণ মানুষ সবাই ক্ষুব্ধ থাকলেও আমাদের ওপর কোনও হামলা করেনি। বরং অনেকে আমাদের নিরাপদে সরে যেতে সাহায্য করেছে।
শারীরিকভাবে কোনও আঘাতের শিকার না হলেও এখনও সেদিনের ভয় ও আতঙ্ক অনেকের মধ্যে কাজ করছে বলে জানান ইসমত আলী। কার্যক্রম শুরুর পর থানার সবাই যোগদান করেছেন কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে কারা পরবর্তীতে চাকরিতে যোগদান করেননি তা বলতে পারবো না। বিষয়টি ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বলতে পারবেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক লালবাগ থানার এক পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, গত ৫ আগস্ট আমার চাকরি জীবনের সবচেয়ে ভীতিকর রাত ছিল। সেদিনের ট্রমা এখনও কাটেনি। আগে রাস্তায় বের হলে মানুষকে পরামর্শ দিলে শুনতো। কিন্তু এখন অনেকে আইন অমান্য করে উল্টো পুলিশকে শাসায়। আমরা ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশ অনুযায়ী সর্বোচ্চ সহনীয় আচরণ করি। আমরা তো ব্যক্তি শেখ হাসিনার চাকরি করিনি। গত ১৫ বছর আমরা একটা সরকারের চাকরি করেছি। আমাদের প্রতি জনগণের বিদ্বেষ রাখা উচিত নয়। পুলিশ-জনগণ একে অপরের বন্ধু, সহায়ক।
লালবাগ থানার ডিউটি অফিসার অমা সরকার বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমি সেদিন ডিউটিতে ছিলাম না। তাই সেদিন এখানে কী ঘটেছে বলতে পারবো না। তবে থানায় যে ভাঙচুর করা হয়েছে তা তো এখনও দৃশ্যমান। থানার প্রায় প্রতিটি জানালার ও বাইরের গ্লাস ভাঙা। এর চেয়ে বেশি কিছু বলতে পারবো না। আরও বিস্তারিত জানতে হলে থানার দায়িত্বরত ঊর্ধ্বতন ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা ও ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তার (তদন্ত) সঙ্গে কথা বলুন।
লালবাগ থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) কাশৈনু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, থানার সার্বিক অবস্থা এখন স্থিতিশীল। আগস্টের ৫ তারিখ থানা ভাঙচুরের ঘটনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়। যে গাড়িগুলো ভাঙচুর করা হয়েছে তা মেরামত করা হয়েছে। সংস্কার কাজ চলমান আছে।
পুলিশের ভয়ভীতি প্রসঙ্গে এই কর্মকর্তা বলেন, সবার ভেতর একটা ট্রমা কাজ করছে, এটা স্বাভাবিক। কারণ সাধারণ মানুষ এর আগে কখনও এত ক্ষুব্ধ হয়ে পুলিশের ওপর হামলা বা ভাঙচুর করেনি। সাধারণ মানুষের সঙ্গে পুলিশের যে দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে, আমি মনে করি কাজের মাধ্যমে তা ঘুচে যাবে।
ওসি কাশৈনু আরও বলেন, থানায় নতুন বদলি সব পুলিশ সদস্য এখনও কাজে যোগদান করেননি। মানুষের আস্থা তৈরি করতে পুলিশ সদস্যরা নিরলস পরিশ্রম করে যাচ্ছেন বলেও জানান তিনি।
ছবি: প্রতিবেদক