প্রধান ফটকে প্রবেশ করা মাত্রই চোখে পড়বে থানার খালি প্রাঙ্গণের দুই পাশে পার্কিং করা ডজন খানিক গাড়ি। এসব গাড়ির কোনটার সামনের গ্লাস ভাঙা, কোনটা আগুনে পোড়া, আবার কোনটার পুরো বডি ভাঙচুর করা। সেখান থেকে কয়েক পা বাড়িয়ে সামনে গেলেই ওপরে বারান্দার ছাদে কালো কুচকুচে কয়লার মতো চাপ। আর ভবনের নিচ তলায় ভেতরে গেলে দেখা মেলে পুড়ে যাওয়া অবশিষ্ট ধ্বংসস্তূপ। বলছিলাম ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের মোহাম্মদপুর থানার কথা। সেবা প্রার্থী ও থানার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের চলাচলে প্রতিদিনই প্রাণবন্ত থাকতো থানাটি। তবে বর্তমানে পুরো থানায় ভূতুড়ে পরিবেশ বিরাজ করছে।
শনিবার (১০ আগস্ট) বিকালে থানা ঘুরে দেখা যায়, পুড়ে যাওয়া বিভিন্ন সরঞ্জামের ধ্বংসস্তূপ পরিষ্কার করতে কাজ করছেন বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। তাদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন স্বেচ্ছাসেবী বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা। থানাটির নিরাপত্তার দায়িত্বে রয়েছেন একদল সেনা সদস্য। কোনও কার্যক্রম শুরু না হলেও সিভিলে থানায় কর্মরত পুলিশ সদস্যদের যাতায়াত করতে দেখা গেছে। প্রত্যেক পুলিশ সদস্যকে সেনাবাহিনী নির্ধারিত টেবিলে থাকা খাতায় সাইন করে প্রবেশ করতে হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক থানার একজন এসআই বলেন, ‘আমি সেদিন বিশ্রামে ছিলাম। রাতে ডিউটিতে আসি। এসেই আন্দোলনকারীদের মুখোমুখি হই। পরে বাধ্য হয় পেছনের দেয়াল টপকিয়ে পালিয়ে যাই।’
আরেকজন পুলিশ কনস্টেবল বলেন, ‘আন্দোলনকারীদের সামনে দাঁড়াতে না পেরে ইউনিফর্ম খুলে সিভিলে থানা থেকে বের হয়ে যাই।’
সেখানে পরিষ্কার-পরিচ্ছিন্নতার কাজে নিয়োজিত থাকা বাংলাদেশ ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী আরিফুল ইসলাম নাঈম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা স্কুল, কলেজ এবং ইউনিভার্সিটির সব মিলিয়ে ১০০ জনের মতো শিক্ষার্থী আজ সকাল ১০টা থেকে এখানে কাজ করছি। এছাড়া স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের কিছু সদস্য রয়েছেন। সবাই মিলে কাজ করছি। আমরা থানাটি সম্পূর্ণ পরিষ্কার হওয়া পর্যন্ত কাজ চালিয়ে যাবো।’
এদিকে দুপুর ১২টার দিকে মিরপুর মডেল থানায় সরেজমিন গেলে দেখা যায় এমনই এক দৃশ্য। থানাকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে পরিষ্কার করা হচ্ছে পুড়ে যাওয়া ধ্বংসস্তূপ। থানার নিরাপত্তায় পর্যাপ্ত সেনা মোতায়েন দেখা গেছে। থানা ভবনের বাইরে খালি জায়গায় অস্থায়ীভাবে টেবিল বসিয়ে কার্যক্রম চালাতে দেখা গেছে দায়িত্বরত পুলিশ সদস্যদের।
থানার ডিউটি অফিসার বলেন, ‘আজ সবাই কাজে আসছে। তবে যারা আহত হয়েছেন তারা কাজে যুক্ত হতে পারেননি। মূল ভবন অগ্নিসংযোগের কারণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়ায় সেখানে পরিষ্কার ও সংস্কার করা হচ্ছে। তাই তারা মূল ভবনের সামনে বসার স্থানের ছাউনির নিচে কার্যক্রম শুরু করেছে। সকাল থেকে অল্প কিছু অভিযোগ এসেছে। এসব অভিযোগের মধ্যে ৫ তারিখের (আগস্ট) পর জায়গা দখল, ভাঙচুর ইত্যাদি রয়েছে।’
এর আগে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর গত সোমবার (৫ আগস্ট) বিকাল থেকে রাজধানীর অনেক থানায় হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পুড়িয়ে দেওয়া হয় থানা-পুলিশের কাজে ব্যবহৃত গাড়ি। অনেক জায়গায় অস্ত্রসহ বিভিন্ন সরঞ্জাম ও নথি লুট হয়। জীবন বাঁচাতে আত্মগোপনে চলে যান পুলিশ সদস্যরা। এতে করে ভেঙে পড়ে দেশের বেশির ভাগ থানার কার্যক্রম। এরপর পুলিশি ব্যবস্থা প্রায় ভেঙে পড়ে। নিরাপত্তাহীনতায় পুলিশ ঘোষণা করে কর্ম বিরতির।
এরপর গতকাল শুক্রবার পাঁচ দিন পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) ২৯ থানায় সেবা কার্যক্রম শুরু হয়। শনিবার (১০ আগস্ট) পর্যন্ত মেট্রোপলিটনসহ সারা দেশে ৫৩৮ থানার কার্যক্রম শুরু হয়েছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দফতর।
ডিএমপির অধিকাংশ থানা হামলার শিকার হলেও বেশি ক্ষতিগ্রস্তের মধ্যে রয়েছে মোহাম্মদপুর থানা, মিরপুর থানা ও যাত্রাবাড়ী থানা।
এর আগে গত ৮ আগস্ট এ বিষয়ে পুলিশ সদর দফতর থেকে পাঠানো এক খুদে বার্তায় কর্মস্থলে যোগ দিতে সবাইকে পুলিশ সদস্যদের সহযোগিতা করার আহ্বান জানানো হয়েছে। এর আগে বুধবার (৭ আগস্ট) পুলিশের নতুন মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম সারা দেশে পুলিশ সদস্যদের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে নিজ নিজ কর্মস্থলে যোগ দেওয়ার আহ্বান জানান।