বাজার থেকে উঠিয়ে নেওয়া হচ্ছে পলিথিন। বিকল্প হিসেবে পাটের তৈরি ব্যাগ ব্যবহারে কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সেখানেও নানা সংকটের কথা আসছে। পলিথিন যেমন সহজলভ্য, পাটজাত পণ্য তেমন সহজলভ্য নয়। আবার ব্যবহারে জটিলতার কথাও বলছেন কেউ কেউ। এর বাইরে নতুন পণ্যে অভ্যস্ততার একটি বিষয় রয়েছে।
দেখা যায়, বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট সরকারের সময় (২০০১-২০০৬) পরিবেশমন্ত্রী শাজাহান সিরাজ বাজারগুলোকে পলিথিনমুক্ত করেছিলেন। গত ২০ বছরের ইতিহাস যাদের মনে আছে তারা নিশ্চয়ই জানেন শাজাহান সিরাজের সেই সাফল্যের কথা। দীর্ঘদিনের লড়াইয়ের পর তিনি যখন পলিথিন থেকে মুক্তির ঠিক কাছাকাছি পৌঁছে গিয়েছিলেন তখন তার সরকারের মেয়াদ শেষ হয়ে যায়। এরপর তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দুই বছরও বাজারে তেমন পলিথিন দেখা যায়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের শুরুর দিকেও পলিথিন ব্যবসায়ীরা বাজারে প্রবেশ করতে পারেনি। পরে ধীরে ধীরে বিগত সরকারের শিথিল নীতির কারণে পলিথিনে সয়লাব হয়ে ওঠে বাজার।
পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান দায়িত্ব নেওয়ার পর পলিথিন ব্যবহার বন্ধে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছেন। এর মধ্যে ১ অক্টোবর থেকে সুপার শপে পলিথিন নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সেই ধারাবাহিকতায় গতকাল (মঙ্গলবার) ধানমন্ডির মীনা বাজার পরিদর্শন করেন পরিবেশ উপদেষ্টা। একইভাবে ১ নভেম্বর থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে বাজারে পলিথিনের ব্যবহার।
তবে আশার কথা হচ্ছে, দেশের সুপার শপগুলোতে আগে থেকেই পলিথিন ব্যবহার করা হয় না। প্রধানত মীনাবাজার, আগোরা, স্বপ্ন, ইউনিমার্টের মতো সুপার শপগুলো আগে থেকেই নিষিদ্ধ হওয়ার কারণে পলিথিন ব্যবহার করে না। তবে রাজধানী ঢাকাসহ গ্রামগঞ্জের সব হাট-বাজারে দেদার পলিথিন ব্যবহার হচ্ছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এর প্রধান কারণ সহজলভ্যতা এবং ব্যবহারে সুবিধা। সাধারণত একটি চটের ব্যাগের দাম পড়ে ৫০ থেকে ৭০ টাকা। সেখানে ৫০ থেকে ৭০ পয়সার একটি পলিথিনে সমপরিমাণ পণ্য পরিবহন করা যায়। পলিথিন সিঙ্গেল ইউজ পণ্য। একবার ব্যবহার করেই মানুষ এটি ফেলে দেয়। এছাড়া দাম কম হওয়ায় বাজারে বিক্রেতাই পলিথিন সরবরাহ করে। অন্যদিকে বাজারে পাটের ব্যাগ ক্রেতাকে নিয়ে যেতে হয়। একটি ব্যাগ অন্তত ৮ থেকে ১০ বার ব্যবহার করা গেলেও এটি পরিবহন এবং সংরক্ষণের যে অভ্যস্ততা ৮০ বা ৯০-এর দশকে সাধারণ মানুষের মধ্যে ছিল, তা ফিরিয়ে আনাই সবচেয়ে কঠিন চ্যালেঞ্জ।
যদিও পলিথিনের বিকল্প হিসেবে পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়েছেন পরিবেশ উপদেষ্টা। এ জন্য পাট ও বস্ত্র মন্ত্রণালয় এবং বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারদের সঙ্গে টানা বেশ কয়েকটি সভাও করেছেন তিনি। এরপর চলতি সপ্তাহের শুরুতে পলিথিনের বিকল্প পণ্য নিয়ে একটি মেলা করে পরিবেশ অধিদফতর। এতে মূলত পাটজাত পণ্যের নানা ধরনের ব্যাগের প্রদর্শনী করা হয়। এ প্রদর্শনীতে অংশ নেয় গ্রিন আর্থ কটেজ।
প্রতিষ্ঠানটির সিইও ড. মো. তারেক হোসেইন বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, পলিথিনের বিকল্প পাটের ব্যাগ দিতে হলে প্রতিদিন ৫০ লাখের মতো জুট ব্যাগ প্রয়োজন। যার কাঁচামাল এই মুহূর্তে কারও হাতে নেই। আসলে আমরা তো আগে থেকে জানতাম না এত দ্রুত এই সিদ্ধান্ত কার্যকর করবে সরকার। এ জন্য আমরা কাঁচামাল আনার চেষ্টা শুরু করেছি। পাশাপাশি উৎপাদন বৃদ্ধির চেষ্টাও করছি।
গত ৯ সেপ্টেম্বর পরিবেশ উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান সচিবালয়ে মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে ঘোষণা দেন, ১ অক্টোবর থেকে সুপার শপে কোনও পলিথিন বা পলিপ্রপিলিনের ব্যাগ রাখা যাবে না এবং ক্রেতাদের দেওয়া যাবে না। বিকল্প হিসেবে সব সুপার শপে বা শপের সামনে পাট ও কাপড়ের ব্যাগ রাখা হবে ক্রেতাদের জন্য।
সেই সঙ্গে ১ নভেম্বর থেকে ঢাকার ১০টি কাঁচাবাজারে পলিথিন বন্ধে কার্যক্রম শুরু হবে। এদিন থেকে দেশব্যাপী পলিথিন উৎপাদনের বিরুদ্ধেও অভিযান পরিচালিত হবে।
মঙ্গলবার শুরু হওয়া অভিযানে অংশ নিয়ে রিজওয়ানা হাসান বলেন, ‘এই অভিযান শুধু পলিথিন শপিং ব্যাগের বিরুদ্ধে। ১ অক্টোবর থেকে কেউ বাজার করতে পলিথিন শপিং ব্যাগ আনতে পারবেন না বা বাজার থেকেও নিতে পারবেন না। পরবর্তীতে একবার ব্যবহার্য প্লাস্টিকও বন্ধ করা হবে। এ জন্য জনগণ, ব্যবসায়ী ও সংশ্লিষ্ট সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে।’
এ বিষয়ে জানতে চাইলে পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের উপসচিব ফয়সাল খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘একদিনে তো পলিথিন বাজার থেকে উঠিয়ে নেওয়া সম্ভব না। আমরা পলিথিনের বিকল্প বাজারের দিকে নজর দিচ্ছি। পাটজাত পণ্যের ব্যবহার বৃদ্ধির পাশাপাশি মানুষের মধ্যে সচেতনতা আসাও জরুরি। সরকারের একার পক্ষে এই কাজ করা সম্ভব না। সবাই মিলেই পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর এই পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করতে হবে।’
সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন, পলিথিন ব্যবহার বন্ধ করার বিষয়টি নির্ভর করে সরকারের কঠোরতার ওপর। সরকার যদি বিএনপির প্রয়াত পরিবেশমন্ত্রী শাজাহান সিরাজের মতো পলিথিন বন্ধে কঠোর হয় তাহলেই পলিথিন বন্ধ সম্ভব। অন্যথায় এটি প্রায় অসম্ভব। কারণ হিসেবে অনেকেই মনে করছেন, মানুষের হাতে বিকল্প সস্তা কোনও উপকরণ আপাতত নেই।