X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১
একান্ত সাক্ষাৎকারে শাম্মী আহমেদ

‘শুধু নারী নয়, মানুষ হিসেবে দেখতে হবে’

মাহফুজ সাদি
০৮ মার্চ ২০২৩, ২২:০৮আপডেট : ০৯ মার্চ ২০২৩, ১৪:২০

শাম্মী আহমেদ আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক। তিনি ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা ছিলেন। তার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।

নারী দিবস উপলক্ষে বাংলা ট্রিবিউনের মুখোমুখি হন শাম্মী আহমেদ।

বাংলা ট্রিবিউন: পরিবারে নারীর অবস্থান কেমন দেখেছেন?

শাম্মী আহমেদ: বাংলাদেশের মতো পুরুষশাসিত সমাজে নারীর পথ চলাটা মসৃণ নয়, বরং অনেক ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা রয়েছে। পরিবার থেকেই নারী ও পুরুষ কিংবা ছেলে-মেয়েদের বৈষম্যটা শুরু হয়, আমাদের মতো শিক্ষিত পরিবারেও ছোটবেলায় সেটাই দেখেছি। কিছু কাজ আলাদা করে দেওয়া হয়েছে। সেটি হলো— পুরুষ বাইরে যাবে, সবকিছু করবে। নারীরা ঘরে থাকবে, কোনও কিছুতে তার কর্তৃত্ব থাকবে না। ছোটবেলায় দেখেছি নারীরা বাজারে যাবে, মেয়েরা সন্ধ্যার পরেও বাইরে থাকবে—এটা অসম্ভব ব্যাপার মনে করা হতো। এই যে পুরুষ কী কী করতে পারবে আর নারী কী কী করতে পারবে এবং পারবে না— সমাজের এই নিয়মটিই আমার কাছে মনে হয় সবচেয়ে বড় বাধা। ‘শুধু নারী নয়, মানুষ হিসেবে দেখতে হবে’

উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করা মানুষ বেশি এমন পরিবার থেকে এসেও এই বাধাগুলোর সম্মুখীন হয়েছি আমরা। আমার মা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করা এবং সোশ্যাল ওয়েলফেয়ার অফিসার্স একাডেমির প্রিন্সিপাল হিসেবে অবসর নিয়েছেন। আমার বাবা মহিউদ্দিন আহমেদ বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। আমার দাদা কলকাতা মেডিক্যাল কলেজ থেকে পাশ করা ডাক্তার ছিলেন। নানা বরিশাল জিলা স্কুলের হেডমাস্টার ছিলেন। এমন একটা পরিবার থেকে আসার পরও আমার মনে হয়, সমাজের বাধাগুলো, সমাজ স্বীকৃত নিয়গুলোর কারণে মায়েরা অনেক সময় ইনসিকিউরিটি ফিল করেন। ছোটবেলায় খেলতে যেতাম। সন্ধ্যা হলেই মা-নানীরা বলতো—এখন আর বাইরে থাকা যাবে না, ঘরে আসো। অনেক সময় দেখতাম আমার ভাই বা চাচাতো ভাইরা একসঙ্গে খেললেও তাদের ক্ষেত্রে আমার মতো বাধা থাকতো না। কেন এমন বাধা আসতো, তা সে সময় বুঝতাম না। তবে বাবা সবসময় এ ক্ষেত্রে সাপোর্ট দিতো। এই সামাজিক প্রতিবন্ধকতা, সেটি নারীদের পিছিয়ে থাকার বড় কারণ। ‘শুধু নারী নয়, মানুষ হিসেবে দেখতে হবে’

বাংলা ট্রিবিউন: সমাজে নারী-পুরুষের বৈষম্যকে কীভাবে দেখছেন?

শাম্মী আহমেদ: নারী-পুরুষের বৈষম্য তো সব ক্ষেত্রেই রয়েছে, সৃষ্টির আদিকাল থেকে এটি চলে আসছে। বিভিন্ন ধরনের বৈষম্য রয়েছে। শ্রেণিগত বৈষম্য, অর্থনৈতিক বৈষম্য। এই বৈষম্য দূর করা, কমিয়ে আনা যায়। কিন্তু একেবারে মুছে ফেলা সম্ভব নয়। সবচেয়ে চিন্তার বিষয় আমার কাছে মনে হয়—নারী ও পুরুষের অধিকারের, অর্থনৈতিক কর্তৃত্বের বৈষম্য। এটি আইন করে দূর করা সম্ভব নয়। সামাজিক সচেতনতা দরকার। সমাজের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে, যার শুরুটা করতে হবে পরিবার থেকেই।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে রাষ্ট্র নারীদের এখন অনেক স্বাধীনতা দিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিশ্বে রোল মডেল। আমরা রাজনৈতিক স্বাধীনতাও পেয়েছি। একটা সময় মেয়েরা খুব একটা রাজনীতিতে আসতো না। তেমন একটা সময় আমি রাজনীতিতে এসেছি। কিন্তু নারীরা রাজনীতিতে আদিকাল থেকেই জড়িত, সেটি আমরা বঙ্গবন্ধুর আত্মজীবনীতেও দেখেছি—বঙ্গমাতা ফজিলাতুন্নেছা বঙ্গবন্ধুর জীবনে কী ভূমিকা রেখেছেন। আমার বাবার রাজনীতির ক্ষেত্রেও মা নেপথ্যের শক্তি হিসেবে কাজ করতেন। একজন নারীর যে এই বহুমাত্রিক গুণ সেটার স্বীকৃতিটাও সমাজে সেভাবে নেই।

দেশে নারীর ক্ষমতায়ন ও অধিকার প্রতিষ্ঠায় প্রাতিষ্ঠানিক পরিবর্তন আসলেও সামগ্রিকভাবে নারীর বিষয়টি সমাজে সেভাবে এগোয়নি। এখনও ধর্ষণের শিকার একজন নারীকে সমাজে ঘৃণার দৃষ্টিতে দেখা হয়। এনজিওগুলোর দিকে তাকালে আমরা দেখতে পাই, নারী যে উপার্জন করে, তার নিয়ন্ত্রক কিন্তু এখনও পুরুষ। তিনি স্বামী বা বাবা কিংবা ছেলে। ফলে আপাতত দৃষ্টিতে নারীর অর্থনৈতিক মুক্তি হয়েছে মনে হলেও বাস্তবে কিন্তু সেভাবে হয়নি। এটা দূর করতেও সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। ‘শুধু নারী নয়, মানুষ হিসেবে দেখতে হবে’

নারীর উন্নয়ন বা নারীর অধিকার আদায় বলতে আমি ‘নারী মুক্তি’ বোঝাচ্ছি না। নারীর স্বাধীনতা বলতে কিন্তু উচ্ছৃঙ্খলতা বুঝায় না। নারীর স্বাধীনতা বলতে তার অর্থনৈতিক মুক্তি, নিজের নিয়ন্ত্রণ নিজের কাছে থাকা বুঝি। এ ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে। কেননা যেকোনও অবস্থানেই হোক না কেন একজন নারীকে একজন পুরুষের চেয়ে তিন-চার গুণ পরিশ্রম করতে হয়।

এ ছাড়া নারী একটা ভালো অবস্থানে গেলে পুরুষকে সাপোর্ট দেওয়ার মতো বিষয়গুলো সামনে নিয়ে আসা হয়। বাবা-মা মেয়েকে বিয়ে দিতে গেলে একটা ওয়েল স্টাবলিস্ট ছেলের কাছে বিয়ে দেন। পুরুষের উপার্জনকে বড় করে দেখা হয়, নারীর উপার্জনকে সেভাবে দেখা হয় না। নিম্ন-মধ্যবিত্ত পরিবারের দিকে তাকালে দেখা যায়, নারীর উপার্জনেই হয়তো একটি সংসার চলে। গার্মেন্টসে চাকরি করা নারীর ক্ষেত্রে দেখা যায়—তার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে চেষ্টা করে বাবা, ভাই, স্বামী কিংবা ছেলে।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি আওয়ামী লীগের মতো একটি বৃহৎ রাজনৈতিক দলের আন্তর্জাতিক সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন। আপনার আজকের শাম্মী আহমেদ হয়ে ওঠার গল্পটা কেমন ছিল?

শাম্মী আহমেদ: আমি অনেক বড় নেতা হয়ে গেছি—বিষয়টা মোটেই তেমন নয়। আমি আওয়ামী লীগের একজন কর্মী হিসেবেই পরিচয় দিতে বেশি পছন্দ করি। রাজনৈতিক পরিবারে জন্মগ্রহণ করায় ছোটবেলা থেকেই রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হয়েছি। বাবার রাজনৈতিক জীবনের নানা ঘটনাপ্রবাহ দেখতে দেখতেই বড় হয়েছি। রাজনৈতিক পরিবেশে বড় হওয়ায় প্রতিকূলতাটা আমি কাছ থেকে দেখেছি। রাজনীতির ক্ষেত্রে একজন নারীর প্রতিকূলতা পুরুষের থেকে একেবারেই ভিন্নতর। আমি ইন্টারমিডিয়েটে পড়ার সময় বরিশালে নারীদের মিছিল বের হয়, তখন আমার নানী বলেছেন- এই মেয়ের তো আর বিয়ে হবে না। আমাদের মতো উচ্চশিক্ষিত পরিবারেও এমন কথা চলে আসছে নারী অভিভাবকদের থেকেই। এখান থেকেই স্ট্রাগলটা শুরু হলো…

চাকরী জীবনেও ইন্টারন্যাশনাল রেডক্রস ও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটির প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা হিসেবে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি, আমার যোগ্যতার মূল্যায়ন সেভাবে হচ্ছে না। কারণ মূল্যায়নটাও করেন একজন পুরুষ। নারীরাও অনেক সময় নারীদের সঠিকভাবে মূল্যায়ন করে না। কিছুটা জেলাসি… । তবে জেলাসিটা কিন্তু পুরুষের ক্ষেত্রেও থাকে। আমরা নারীরা ঠিক ঐক্যবদ্ধ হতে পারি না অনেক সময়। এ ক্ষেত্রে অনেকগুলো বাধা কাজ করে, সেগুলোও পুরুষের সৃষ্টি। একজন নারীর পেছনে আরেকজন নারীকে লাগিয়ে দিতে দেখেছি একজন পুরুষকে। নারী-পুরুষের সেলারি বৈষম্য থাকে। একই পদের একজন পুরুষকে যে বেতন দেওয়া হয়, একজন নারীকে সেটা দেওয়া হয় না। আমাদের নারী ক্রিকেটার, নারী ফুটবলার আর পুরুষ ক্রিকেটার, পুরুষ ফুটবলারদের বেতন ও অন্যান্য সুযোগ-সুবিধার দিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট হয়ে যায়। কেন এই বৈষম্য? নীতি নির্ধারকরা কেন এটি করে রেখেছেন?

রাজনীতির ক্ষেত্রে নারী হিসেবে অনেক সুবিধা পেয়েছি, আবার অসুবিধাও আছে। নেত্রী নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাস করেন বলেই আমাকে এই পদে নিয়ে এসেছেন। প্রথম ধাক্কাটাই ছিল— কে সে, কোত্থেকে এসেছে, সে তো মহিউদ্দিন সাহেবের মেয়ে। বাবার জোরে এই পদে এসেছে। দলের অনেক নারী নেত্রীকেও খোঁচা মেরে বলতে শুনেছি- আমরা তো বাবার নামে আসিনি। একবার একজনকে জবাব দিয়েছিলাম- আমি মহিউদ্দিন আহমেদের মেয়ে তাই আওয়ামী লীগের আন্তর্জাতিক বিষয়ক সম্পাদক হয়েছি। শেখ হাসিনা বঙ্গবন্ধুর মেয়ে তাই তিনি আওয়ামী লীগের সভাপতি। কিন্তু আমি তো বাবার জোরে এখানে আসিনি, বাবার জোরে চাকরিটা পাইনি। সেটি এডেড ভ্যালু হতে পারে কিন্তু আমার নিজেরও তো যোগ্যতা আছে। এই যোগ্যতা, দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রমের মূল্যায়নটা অনেক ক্ষেত্রেই করা হয় না। তবে ক্রমান্নয়ে পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে, এটি আশার কথা।

আমি মনে করি, নারী-পুরুষের অনেক ভেদাভেদ করি আমরা। এ কারণেও নারীরা অনেক পিছিয়ে আছে। একজন নারী যেমন পুরুষ ছাড়া চলতে পারবে না, তেমনই একজন পুরুষও নারী ছাড়া চলতে পারবে না। কেবল নারী দিবসে নয়, সামগ্রিকভাবে নারীকে এগিয়ে আসতে হবে। কবে আমরা একজন নারীকে নারী হিসেবে নয়, একজন মানুষ হিসেবে দেখতে পারবো—আমি সেই দিনটির অপেক্ষা করছি।

বাংলা ট্রিবিউন: আমাদেরকে সময় দেওয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

শাম্মী আহমেদ: আপনাকেও ধন্যবাদ।

/এমএস/
সম্পর্কিত
পাচার হওয়া বোনকে নিতে এসে কলকাতায় অসহায় দশায় চট্টগ্রামের তরুণ
ভারত থেকে বাংলাদেশে পণ্য খালাস করে গেলেন যে নারী ট্রাকচালক
আইসিটি খাতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধি অপরিহার্য: শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী
সর্বশেষ খবর
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ