X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

প্র্যাঙ্কের নামে জনসাধারণকে নব্য ইউটিউবারদের হেনস্তা!

রশিদ আল রুহানী
২০ জুলাই ২০১৭, ১৮:৫৫আপডেট : ২১ জুলাই ২০১৭, ০৪:৪৭

ভূতের সাজে ভয় দেখানো হচ্ছে

“আমি একদিন চন্দ্রিমা উদ্যানে গিয়েছি আমার বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে দেখা করতে। ও আসেনি, তাই কিছুক্ষণ অপেক্ষা করছিলাম। এরই মধ্যে একটি ছেলে এসে আমাকে বলে, আপু আপনার সঙ্গে কথা বলতে চাই। আমি বলি- বলুন? এটা বলার সঙ্গে সঙ্গেই সে পেছন থেকে একটি সাপ বের করে আমার সামনে ধরে। তখন আমি হঠাৎ দেখেই ভেবেছিলাম, সেটা হয়তো সত্যিই সাপ। আমি ভয়ে দৌড় দেই। দৌড়াতে গিয়ে আমি ইটের সঙ্গে বাধা পেয়ে রাস্তার ওপর পড়েও যাই। পড়ে গিয়ে প্রচুর ব্যথা পাই। এসময় আমার এমন দৌড় দেখে চারদিকের মানুষগুলো অনেক জোরে জোরে হাসছিল। এক পর্যায়ে ওই ছেলেসহ আরও কয়েকজন এসে আমাকে বলে, ‘আপু আমরা প্র্যাঙ্ক (কৌতুক) করেছি।’ কিন্তু আমি তখনও ভয়ে কাঁতরাতে থাকি। মনে হচ্ছিলো, আমি ওদের সবগুলোকে ধরে ইচ্ছামতো মার দেই। কারণ, ওরা আমার দুর্বলতা নিয়ে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করলো। আমি ওইদিন রীতিমত হেনস্থার শিকার হলাম।’’

ঠিক এভাবেই ওই দিনের কথা বাংলা ট্রিবিউনের কাছে বর্ণনা করছিলেন রোজিনা (ছদ্মনাম)। তিনি বলেন, ‘ওই দিন আমি বাসায় আসার পরে মনে হয়েছে ছেলেগুলো যদি আমাকে নিয়ে করা ভিডিওটি ইউটিউবে প্রকাশ করে এবং সেটা যদি আমার পরিচত আত্মীয়-স্বজন দেখে তখন আমার মান সম্মান কোথায় গিয়ে ঠেকবে? আমাকে নিয়ে আমার বন্ধু-বান্ধবও মজা করা শুরু করবে। তাছাড়া আমি যে চন্দ্রিমা উদ্যাগে গিয়েছি সেটাও তো কেউ জানে না। ইউটিউবে প্রকাশের কারণেই তো তারা দেখবে।’

জানা যায়, ইউটিউবে ভিডিও আপলোড করে অর্থ আয় করা যায়। আর আয় করতে হলে মৌলিক ভিডিও হতে হবে; যা ইউটিউবের প্রথম শর্ত। এছাড়া যে চ্যানেলে যত বেশি ভিউজ ও সাবস্ক্রাইবার; ওই চ্যানেলের তত বেশি আয়। এ কারণে বাংলাদেশের কোনও কোনও নব্য ইউটিউবার রাস্তাঘাটে মানুষের দুর্বলতাকে অথবা সরল মানসিকতাকে কাজে লাগিয়ে মজা করে এবং সেই দৃশ্যটি গোপনে ভিডিও করে, পরে তা ইউটিউবে আপলোড করে। ওই ভিডিওটি এমনভাবে উপস্থাপন করা হয় যা মানুষের হাসির খোরাক জোগায়। এইসব ভিডিও বানানোর জন্য বেশিরভাগ সময় ইউটিউবাররা পার্ক অথবা শপিং কমপ্লেক্সকেই বেছে নেয়।

এমন বেশ কয়েকটি ইউটিউব চ্যানেল ঘুরে বেশ কয়েকটি ভিডিও দেখা গেছে। যেখানে মানুষের সঙ্গে অতিমাত্রায় ভয়ংকর আচরণ করা হয়েছে।

একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, নিরিবিলি পার্কে রাস্তার পাশে সন্ধ্যার পরিএক লোক মুখোশ পরে গাছের আড়ালে লুকিয়ে আছে। যখনই কেউ ওই রাস্তা দিয়ে আসছে তখন হঠাৎ মুখোশ পরিহিত লোকটি রাস্তায় চলাচলরত মানুষের সামনে গিয়ে চিৎকার করে ভয় দেখাচ্ছে। ভয় পেয়ে লোকগুলো দৌড়ে পালাচ্ছে। কোনও মেয়েকে কোনও একটি ছেলে গিয়ে হঠাৎ বলছে, ‘আপনাকে চুমু খেতে চাই। আপনি কি রাজি?’ আবার একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, পাগল সেজে একটি তরুণ এক স্কুলছাত্রীকে দৌড়ানি দিচ্ছে। আবার, অন্য একটি ভিডিওতে দেখা গেছে, একটি মেয়ের মোবাইল নিয়ে দৌড়ে পালাচ্ছে একজন তরুণ।

সাধারণ মানুষকে এমন হেনস্থার সমালোচনা চলছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে। ফেসবুকের “The tech doctor- প্রযুক্তির ডাক্তার” নামে একটি গ্রুপে “প্র্যাঙ্কের নামে হয়রানি করা হচ্ছে” এই বিষয়টি সামনে আনা হয়েছে। ওই পোস্টে “jony the notyboy,  Adda khana Prodution” সহ বেশ কয়েকটি চ্যানেলের ভিডিও নিয়ে সমালোচনা করা হচ্ছে। যারা প্র্যাঙ্ক বানাতে গিয়ে মানুষকে হেনস্তা করছে তাদেরকে সঠিকভাবে সামাজিকতা মেনে ভিডিও বানানোর পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে। এই গ্রুপটিও ইউটিউবারদের একটি গ্রুপ যারা ইউটিউবের ইতিবাচক বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করে।

অপরিচিত কেউ রাস্তাঘাটে কারও সঙ্গে যদি মাত্রাতিরিক্ত মজা করে অথবা ভয় দেখায় তাহলে প্রতিক্রিয়া কী হতে পারে এমন প্রশ্নে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. কামাল উদ্দিন জানান, এতে ভয় পেয়ে ওই ব্যক্তির মানসিক বিকৃতিসহ নানা ধরনের মানসিক সমস্যা হতে পারে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “যদি কোনও দুর্বল চিত্তের মানুষকে ভয় দেখানো হয় তার মানসিক বিকারগ্রস্ত হয়ে যাওয়ার সম্ভবনা থাকে। আবার যাদের হার্ট দুর্বল তাদের মৃত্যু পর্যন্তও হতে পারে।’’

বিষয়টি নিয়ে কথা হয় দেশের প্রথম ইউটিউবার হিসেবে পরিচিত সালমান মুক্তাদিরের সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, “এখন বেশিরভাগ ইউটিউবার ডেসপারেট হয়ে যাচ্ছেন, কারণ তারা চাইছেন কত দ্রুত ও সহজে জনপ্রিয় হওয়া যায়। এটা করতে গিয়ে তারা ভুলে যাচ্ছেন তার যে কাজটি করছেন সমাজে তার ভ্যালু (মূল্য) থাকতে হবে। মূলত আমাদের এমন কোনও কনটেন্ট নিয়েই কাজ করা উচিত সমাজে যেটার ভ্যালু আছে। অবশ্যই সোসাইটিকে প্রাধান্য দিতে হবে।’

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একজনের প্রতিবাদ

কিভাবে এর সমাধান সম্ভব জানতে চাইলে তিনি বলেন, এখন যারা ইউটিউবের জন্য কাজ করছেন তারা বেশিরভাগই বয়সে ছোট অথবা তারা উচিত-অনুচিত অনেক কিছুই বোঝেন না। ফলে নীতি নির্ধারণী যারা আছেন তাদের মাধ্যমে যদি ওদেরকে নিয়ে কোনও সেমিনার অথবা ওয়ার্কশপের আয়োজন করা যায় তাহলে একটা ভালো ফল পাওয়া যাবে।

কথা হয় ইউটিউবে লেখাপড়াসহ সাধারণ জ্ঞান শেখানোর চ্যানেল টেন মিনিট স্কুলের প্রতিষ্ঠাতা ও ইউটিউবার আয়মান সাদিকের সঙ্গে। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘ইউটিউব এমন একটি প্লাটফর্ম যেখানে প্রতিটি মানুষ তার নিজের প্রতিভাকে খুব সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতে পারে। এখানে আমি ইতিবাচক ও নেতিবাচক যা কিছুই আপলোড করবো না কেন সেটা পৃথিবীর সবখান থেকেই দেখা যায়। ফলে, অন্য দেশের নাগরিকের কাছেও কিন্তু আমাদের দেশকে প্রেজেন্ট করে। ভালো কিছু কনটেন্ট দিলে দেশেকে যেমন ভালোভাবে প্রেজেন্ট করা হবে তেমনি খারাপ কনটেন্ট দিলে দেশের খারাপটাই প্রেজেন্ট হবে। শুধু তাই নয়, এসব ভিডিও সবার আগে নিজেদের মানসিকতাকেই প্রেজেন্ট করে। সুতরাং আমি সবসময় নতুন ইউটিউবারদেরকে ইতিবাচক কনটেন্ট নিয়ে কাজ করতেই উৎসাহিত করি।’

তিনি উদাহরণ দিতে গিয়ে বলেন, ‘অনেক ইউটিউব চ্যানেল আছে যেখানে রান্না শেখানো হচ্ছে। এগুলোও কিন্তু অনেক জনপ্রিয়। আমাদের মায়েরাও কিন্তু এটা করতে পারেন। অর্থাৎ, এমন কোনও কনটেন্ট নিয়ে কাজ করা উচিত যা সবাইকে একটি মেসেজ দিবে যেটা দেখে সচেতন হতে পারি অথবা নিজেদের জ্ঞানকে সমৃদ্ধ করতে পারি।’

 ইউটিউবে ছবি অথবা ভিডিও প্রকাশের বিষয়ে জানতে চাইলে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ তানভীর হোসেই জোহা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘হাসি-ঠাট্টা-তামাশা হতেই পারে কিন্তু কপিরাইট আইন অনুযায়ী সোশ্যাল মিডিয়া অথবা টিভিতে কারও ছবি অথবা ভিডিও প্রকাশ করতে হলে প্রথমত তার অনুমতি লাগে। না হলে সেটা আইনী অপরাধ হবে। কিন্তু এই আইনটি মানার মত কালচার এখনও খুব বেশি আমাদের দেশে তৈরি হয়নি।’

তিনি বলেন, ‘এখন সবার হাতে হাতে স্মার্টফোন, যে কেউ যখন তখন ভিডিও রেকর্ড করতে পারে। সেই ভিডিওটি যদি খুব বেশি রগরগে হয় তাহলে সেটা ভাইরাল করতে সহজ। আর এই সুযোগটাই অনেকে ইউটিউবার নেয়। ভিউ বাড়ানোর জন্য, বেশি বেশি অর্থ আয় করার জন্য তারা যা খুশি করছে। কিন্তু দেশেই অনেকেই আছেন যারা সুস্থ ধারার ইউটিউবিং করছেন। তারাও তো অনেক জনপ্রিয়।’

ইউটিউবের ক্ষেত্রেও অনলাইন মিডিয়ার মতো নীতিমালা হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘এই ধরনের অস্বস্তিকর বিষয়গুলো থেকে বের হতে হলে বর্তমানে যেমন অনলাইন গণমাধ্যমের যেমন একটি নীতিমালা তৈর হচ্ছে তেমনি ইউটিউবের নিয়ন্ত্রণের জন্যও একটি নীতিমালা অবশ্যই করার সময় এসেছে। আর এই নীতিমালা তথ্য কমিশন চাইলে করতেই পারেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

এদিকে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ইউটিউবের একটি কমিউনিটি গাইডলাইন রয়েছে। ওই গাইডলাইনে ৭ ধরনের ভিডিও আপলোড করার বিষয়ে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া রয়েছে। এগুলো হচ্ছে যৌনতা, বিপদজনক ও ভয়ানক কোনও দৃশ্য, হত্যা অথবা মারামারি, কোনও জাতীয়তাবাদের ওপর আঘাত করে এমন কিছু এবং কপিরাইট ভিডিও। এই ৭ ধরনের ভিডিও আপলোড করা হলে সেই চ্যানেলটি বন্ধ করে দেওয়া হয়। তবে, কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার অথবা মজা করতে গিয়ে শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করে এমনকি কেউ কাউকে হত্যা পর্যন্ত করে তাহলে ইউটিউবের কোনও দায় আছে কিনা জানতে চেয়ে ইউটিউবে মেইল করা হলে তারা কোনও উত্তর দেয়নি।

তবে একই বিষয়ে কাউন্টার টেরোরিজম এ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের সাইবার ক্রাইমের উপকমিশনার (ডিসি) আলিমুজ্জামানের কাছে জানতে চাইলে বাংলা ট্রিবিউনকে তিনি বলেন,‘ফান (মজা বা কৌতুক) করার নামে কেউ কাউকে যদি শারীরিক ও মানসিকভাবে হেনস্তা করে এবং ভিকটিম যদি আমাদের কাছে অভিযোগ করে তাহলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো। এছাড়া কারও অনুমতি ছাড়া ভিডিও প্রকাশ করাও তো অপরাধ।‘

/আরএআর/এমএ/টিএন/

সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ