X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

‘ছিনতাই বলার দরকার নেই, দুর্ঘটনা বলো’

আমানুর রহমান রনি
০২ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ২৩:৩৩আপডেট : ০৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৮, ১৮:১১

হেলেনা বেগমের জাতীয় পরিচয়পত্র ধানমন্ডিতে ছিনতাইকারীর হ্যাঁচকা টানে গাড়ির চাকায় পিষ্ট হয়ে নিহত হেলেনা বেগমের (৩৫) মর্মান্তিক মৃত্যুর ঘটনাটি লুকিয়ে দুর্ঘটনা বলার জন্য তার স্বামীকে অনুরোধ করেছিল পুলিশ। তবে তিনি পুলিশের এমন অনৈতিক অনুরোধ শোনেননি। ন্যায়বিচারের আশায় পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা ও গণমাধ্যমের কাছে সেদিন সাহস করে সত্য ঘটনা প্রকাশ করেন তিনি।

শুক্রবার (২ ফেব্রুয়ারি) সন্ধ্যায় হেলেনা বেগমের স্বামী মনিরুল ইসলাম মন্টু বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে এ তথ্য জানান।

গত ২৬ জানুয়ারি ভোর সাড়ে ৫টার দিকে রাজধানীর ধানমন্ডি-৭ এর মাথায় মিরপুর সড়কে প্রাইভেটকারে থাকা ছিনতাইকারীরা হেলেনা বেগমের ব্যাগ ধরে টান দিলে তিনি রাস্তায় পড়ে যান। এভাবেই তাকে কিছুদূর টেনে নিয়ে যায় তারা। একপর্যায়ে গাড়ির চাকার নিচে মাথা পিষ্ট হয়ে মৃত্যু হয় তার। এসময় সঙ্গে ছিলেন তার স্বামী মনিরুল ইসলাম মন্টু। ঘটনার পর ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা গ্রিন লাইফ হাসপাতালে ছুটে যান। তারা নিহতের স্বামী মন্টুর কাছ থেকে ঘটনাটি জানার চেষ্টা করেন। পুলিশের রেসপন্সের বিষয়টিও জানতে চান। তবে এর আগেই ওই এলাকায় দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যরা মন্টুকে সত্য ঘটনাটি না বলতে অনুরোধ করেন।

মনিরুল ইসলাম মন্টু বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসার আগে ধানমন্ডি থানার এক এসআই আমাকে ঘটনা অন্যভাবে বলার জন্য অনুরোধ করেন। তিনি আমাকে বলেন, “আমাদের আপনি ফাঁসালে ফাঁসাতে পারেন, বাঁচাতেও পারেন। আপনি স্যারদের বলবেন, পুলিশ ৫ মিনিটের মধ্যেই ঘটনাস্থলে আসে। তা না হলে আমাদের অসুবিধা হবে।” তিনি এটা দুর্ঘটনা বলতে বলেন। তখন আমি তাকে প্রশ্ন করলাম, কেন আমি মিথ্যা বলবো? তখন তিনি চুপ হয়ে যান।’

ওই এসআইয়ের নাম জানতে চাইলে মন্টু বলেন, ‘তার নাম নয়ন। ঘটনার পর তার সঙ্গে কয়েকবার ফোনে কথা হয়েছে। তবে স্ত্রী হত্যার সঠিক বিচারের জন্য আমি তার কথা শুনিনি। ঊর্ধ্বতন পুলিশ কর্মকর্তাদের বিস্তারিত বলেছি।’

তিনি আরও বলেন, ‘ঘটনার দিন সকালেই গ্রিন লাইফ হাসপাতালে রমনা বিভাগের পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা আসেন। তারা বিস্তারিত শোনেন। রমনার ডিসি আমার কাছ থেকে ঘটনার বর্ণনা শোনেন। ঘটনার কতক্ষণ পর পুলিশ এসেছিল, তিনি তা জানতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে সব খুলে বলেছি। তখন আমার সামনেই ধানমন্ডি থানার পুলিশের সঙ্গে তিনি রাগারাগি করেন। তিনি তাদের কাছে জানতে চান, স্পটে যেতে কেন দেরি হলো? পুলিশ তখন তাকে ব্যাখ্যা দেয়।’

সেদিন ওই এলাকায় ধানমন্ডি থানার উপপরিদর্শক (এসআই) নয়ন কুমার চক্রবর্তীর নেতৃত্বে একটি টহল পুলিশের দল দায়িত্বে ছিল। ঘটনাস্থলে তারাই গিয়েছিলেন।

তবে মন্টুর অভিযোগ অস্বীকার করেন এসআই নয়ন কুমার চক্রবর্তী। তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা হেলেনা বেগমকে ভ্যানে তুলে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলাম। কিন্তু মন্টু তাতে রাজি হননি। তিনি গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নিতে চেয়েছিলেন। আমি তাকে কোনও কিছু বলতে বলিনি। তিনি এসব মিথ্যা বলছেন। আমরা কেন তাকে শেখাতে যাবো?’

ওই ঘটনায় করা মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘থানা পুলিশের পাশাপাশি অনেকেই তদন্ত করছে। ডিবি কাজ করছে। তবে এখনও কোনও গ্রেফতার নেই। তদন্ত চলছে।’

গ্রামের বাড়িতে স্ত্রীর লাশ দাফন করে ঢাকায় ফিরেছেন মনিরুল ইসলাম মন্টু। সেদিনের ঘটনা বর্ণনা করে শুক্রবার তিনি বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমরা স্মার্টকার্ড আনার জন্য বরিশালে গ্রামের বাড়িতে গিয়েছিলাম। আমরা ৭ নম্বর সড়কের মাথা থেকে হেঁটে মিরপুর সড়ক পার হচ্ছিলাম। আমার দুই হাতেই ব্যাগ ছিল। হেলেনা তার ডান হাত দিয়ে আমার বাম হাত ধরে ছিলেন। তার কনুইতে ভ্যানিটি ব্যাগটি ঝুলানো ছিল। আমরা এভাবেই রাস্তা পার হচ্ছিলাম। ওখান থেকে আমাদের বাসা খুব কাছে।’

তিনি বলেন, ‘আমরা দুজনে সড়কটির মাঝখানের আইল্যান্ডের কাছাকাছি চলে আসি। এসময় একটি প্রাইভেটকার পেছন থেকে এসে এটির চালক আমার স্ত্রীর ব্যাগটিতে টান দেয়। এতে হেলেনার হাত কনুইসহ গাড়ির ভেতরে চলে যায়। গাড়িটি দ্রুত চালাতে থাকে। হেলেনা গাড়িটির সঙ্গে ঝুলে ছিল। ছিনতাইকারী ব্যাগটি ধরেই ছিল, হাত থেকে ছাড়িয়ে নিতে পারছিল না। আমিও তাদের পেছনে দৌড়াতে থাকি। কিন্তু গাড়ির সঙ্গে পারছিলাম না। ৭ নম্বর সড়ক থেকে এআর সেন্টার পর্যন্ত চলে আসার পর গাড়ির গতি কমিয়ে হেলেনার হাত সোজা করে ব্যাগটি বের করে। এসময় সে সড়কের ওপর পড়ে যায়, প্রাইভেটকারটির পেছনের চাকা তার মাথার ওপর দিয়ে চলে যায়। একটা শব্দ শুনতে পেলাম। দৌড়ে কাছে গিয়ে তাকে ধরি। মানুষজনকে ডাকি কিন্তু কেউ আসে না।’

চিৎকার করেও এমন অবস্থায় কারও সহযোগিতা পাননি উল্লেখ করে মন্টু বলেন, ‘আমাকে সহযোগিতা করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। সড়কটিতে ভোরে অনেক ট্রাক চলছিল, তাই স্ত্রীকে টেনে রাস্তার একপাশে নিয়ে আসি। প্রায় ১৫/২০ মিনিট আমি চিৎকার করি। কিন্তু কেউ আসেনি।’

ঘটনার বেশকিছু সময় পর পুলিশ আসে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘আমি স্ত্রীকে হাসপাতালে নিতে চাইলেও পুলিশ এসে তাকে থানায় নিয়ে যেতে চায়। তারা আমাকে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে। আমরা স্বামী-স্ত্রী কিনা তা জানতে চায় একজন। তারা আমার সঙ্গে তর্ক করতে লাগলো। পরে আমি আমার ছেলেদের ফোন দেই। তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে কান্নাকাটি করে। এরপরও পুলিশ আমার স্ত্রীসহ আমাকে থানায় নিয়ে যেতে চায়। তখন আমি তাদের সঙ্গে রাগারাগি করি। তাদের জিজ্ঞেস করলাম, এতক্ষণ আপনারা কোথায় ছিলেন? আমার একজন মারা গেছে, আমি কিন্তু আরও তিনজন মারবো। এসব পুলিশ-টুলিশ মানি না। তখন তারা একটু নরম হয়।’

উত্তপ্ত বাক্য বিনিময়ের পর পুলিশ দুটি সবজির ভ্যান ডাকে। তার একটিতে হেলেনাকে তুলে ৬টা ৬ মিনিটের দিকে গ্রিন লাইফ হাসপাতালে নেওয়া হয়। এর মধ্যে আধঘণ্টা সময় সড়কেই নষ্ট হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মন্টু। গ্রিন লাইফে নেওয়ার পর সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক হেলেনাকে মৃত ঘোষণা করেন। তাদের পরামর্শে ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়।

হেলেনা বেগম ও মনিরুল ইসলাম মন্টু দম্পতির তিন ছেলে ও এক মেয়ে। বড় ছেলে মাহাদী হাসান (১৭), মেজ ছেলে ইমরান হোসাইন (১৩) এবং ছোট ছেলে রিফাতুল ইসলাম রানা (১০)। বড় ও মেজ ছেলে কেরানীগঞ্জের একটি মাদ্রাসায় পড়ালেখা করে। ছোট ছেলে কলাবাগানের একটি স্কুলে পড়ে। সন্তানদের মধ্যে স্বপ্না আক্তার (২২) সবার বড়। তিনি গ্রিন লাইফ হাসপাতালে পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরি করেন। তাদের গ্রামের বাড়ি বরিশাল বন্দর থানা এলাকায়।

গ্রিন লাইফ হাসপাতালের ইনফরমেশন ডেস্কের কর্মকর্তা মাইনুল ইসলাম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘নিহত হেলেনা বেগম আমাদের হাসপাতালের ১১ তলায় পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে চাকরি করতেন।’

মামলার তদন্ত সংশ্লিষ্ট ডিবির এক কর্মকর্তা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমরা চারটি সিসি ক্যামেরার ভিডিওফুটেজ সংগ্রহ করেছি। তবে সেটা থেকে গাড়ির মডেল পেলেও নম্বরটি চিহ্নিত করা যায়নি। এ বিষয়ে কাজ চলছে।’

/এএম/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
মাড় ফেলে ভাত রান্না হলে ‘১৫ ভাগ অপচয় হয়’
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
শরীরের তাপ কমায় এই ৮ খাবার
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
সর্বাধিক পঠিত
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
ভূমি ব্যবস্থাপনায় চলছে জরিপ, যেসব কাগজ প্রস্তুত রাখতে হবে
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
এমন আবহাওয়া আগে দেখেনি ময়মনসিংহের মানুষ
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
‘হিট অফিসার’: পদ কীভাবে নেতিবাচক হয়ে ওঠে
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
স্কুলে আসার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়লেন শিক্ষক
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ
প্রাথমিক বাদে সোমবার ৫ জেলার সব স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা বন্ধ