গত ২ ডিসেম্বর বেলা আড়াইটার দিকে ছেলেকে গোসল করানোর জন্য গরম পানি করেছিলাম । তবে যখন গরম পানির হাঁড়ি নিয়ে বাথরুমের দিকে যাচ্ছিলাম, তখনই ছেলেটা হঠাৎ দৌড়ে আসে, ওর সঙ্গে আমার ধাক্কা লাগে। এতে গরম পানি ছলকে পড়ে ঝলসে যায় আমার ছোট্ট ছেলের দেহের অনেকটা অংশ। এরপর প্রথমে রাজশাহী মেডিক্যাল কলেজ (রামেক) হাসপাতালে প্রাথমিক চিকিৎসা নিয়ে সাড়ে সাত বছরের ছেলে মো. আরিয়ান আল আমিনকে শেখ হাসিনা বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইনস্টিটিউটে নিয়ে আসি বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের শিক্ষক আমেনা খাতুন।
আমেনা খাতুন জানান, গরম পানিতে আরিয়ানের গলা থেকে বুক, পেট হয়ে নাভির নিচ থেকে বাম পায়ের থাই পর্যন্ত পুড়ে যায়। সেই সঙ্গে পুড়েছে বাম হাত, ডান হাতের কনুইয়ের উপরের কিছুটা অংশ। কোনওরকমে মুখ আর পেটের নিচের অংশটা ঠিক রয়েছে।
তিনি বলেন, গোসলের আগে ছেলের গা থেকে জামা খুলে নিয়েছিলাম। এ কারণেই শরীরের অনেকটা অংশ পুড়ে গেছে।
আমেনা জানান, সন্তানকে নিয়ে রামেক হাসপাতালের বার্ন ইউনিটে নিয়ে গেলে চিকিৎসকরা জানিয়েছিলেন আরিয়ানের শরীরের ২২ শতাংশ পুড়ে গেছে। পরে ওই বিভাগের প্রধান জানান পুড়ে যাওয়ার অংশ ১২ শতাংশের বেশি হবে না। তবে সেখানে শিশুদের জন্য নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের ব্যবস্থা না থাকায় এবং উন্নত চিকিৎসার জন্য ছেলেকে পরদিন অ্যাম্বুলেন্সে করে ঢাকায় নিয়ে আসেন।
আমেনা খাতুন বলেন, আরিয়ানের পাঁচদিন পর পর ড্রেসিং করতে হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলেছেন, আরিয়ানের আরও দুটি ড্রেসিং দরকার হবে, সে হিসেবে হয়তো আরও ১০ দিনের মতো থাকতে হবে।
আমেনা খাতুন বলেন, ভুলটা আমারই ছিল, আমি সচেতন ছিলাম না। আমি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক, তবু আমার মাথায় ছিল না যে হাঁড়িতে করে নয়, অন্য উপায়ে গরম পানিটা গোসলের জন্য নিয়ে যাওয়া দরকার।
কেবল আরিয়ানই নয়, ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পুরনো বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটে প্রতিদিন এমন গরম পানিতে পুড়ে যাওয়া শিশু রোগীর সংখ্যা বাড়ছে বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। তারা জানান, নভেম্বরের শুরু থেকে জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এমন পুড়ে যাওয়ার ঘটনা অনেক বেশি পাওয়া যায়।
ঢামেকের বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের পুরনো ভবনের তিনতলায় চিকিৎসা নিচ্ছে দশ বছরের কিশোর ভট্টাচার্য। নিজেই গরম পানি নিতে গিয়ে পা পিছলে যায়, আর তাতেই হাঁটু থেকে দুই পায়ের পাতা পর্যন্ত পুড়ে গেছে, চামড়া উঠে ভেতরের মাংস বের হয়ে আছে।
চিকিৎসকরা বলছেন, নতুন-পুরাতন দুই ভবন মিলিয়ে প্রতিদিন সাত থেকে আটজন শিশু গরম পানিতে পুড়ে চিকিৎসা নিতে আসছে।
ডা. সামন্ত লাল সেন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, প্রতি শীতেই গরম পানিতে শিশুদের ঝলসে যাওয়ার হার বেড়ে যায়। এ ধরনের ঘটনা কমিয়ে আনতে কয়েক বছর ধরেই আমরা বলছি, জনগণকে সচেতন করার চেষ্টা করছি। তবে শুধু আমাদের পক্ষ থেকে বললে তো হবে না, এর জন্য গণমাধ্যম, সুশীল সমাজ, বাড়ির অভিভাবক, স্কুল-কলেজের শিক্ষকসহ সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।
শীতের দিনে গরম পানি কীভাবে চুলা থেকে বাথরুমে নিতে হবে- এই বার্তাটা সবার কাছে পৌঁছাতে হবে। খুব স্বাভাবিকভাবে গরম পানিটা বালতিতে করে নিয়ে যেতে হবে। হাঁড়ি বা ডেকচিতে করে গোসলখানায় নিয়ে গেলে দুর্ঘটনার সংখ্যা কমিয়ে আনা সম্ভব।
তিনি বলেন, কেবল গরম পানিতে নয়, শীতের সময়ে গরম ডালের কারণেও অনেক শিশু পুড়ে যায়, সচেতন হলে পোড়ার এ সংখ্যা কমানো যাবে।
তিনি আরও জানান, প্রতিবছর প্রায় ছয় লাখেরও বেশি মানুষ বিভিন্নভাবে পুড়ে যান। এরমধ্যে প্রায় ৩০ শতাংশ মানুষ মারা যান।
শুধু শিশু নয়, অসাবধানতার কারণে বড়রাও পুড়ে যাচ্ছেন বলে জানান তিনি।