দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতাল, ক্লিনিক, ডায়াগনস্টিক সেন্টারে কোভিড এবং নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার নির্দেশ দেওয়া হলেও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সব হাসপাতালে কোভিড এবং নন-কোভিড রোগীদের চিকিৎসা দেওয়ার প্রধানতম শর্ত হচ্ছে হাসপাতালে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা। অন্যদিকে, এখন পর্যন্ত চিকিৎসকসহ অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মীর আক্রান্তের হার আশঙ্কাজনক হওয়ার প্রধান কারণ হাসপাতাল ব্যবস্থাপনা ‘ফেইল’ করা এবং দেশের নন-কোভিড হাসপাতালগুলোতে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা না থাকা। তবে দেরিতে হলেও রাজধানীর প্রধান হাসপাতালগুলোতে ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা নিশ্চিত করা হচ্ছে বলে দাবি করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে ঢাকার অন্যান্য হাসপাতাল এবং বাইরের হাসপাতালগুলোতেও এই ব্যবস্থাপনা চালুর জন্য নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। হাসপাতালগুলো এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে তৎপর রয়েছে।
কোভিড-১৯ প্রাদুর্ভাবের পর থেকে বিশ্বের বেশিরভাগ হাসপাতালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত ট্রায়াজ (কোভিড সন্দেহভাজন রোগী বাছাই প্রক্রিয়া) ব্যবস্থাপনা মেনে সন্দেহভাজন রোগীদের ভর্তি করা হচ্ছে। এই ব্যবস্থাপনা যেসব হাসপাতালে সুচারুভাবে মেনে চলা হচ্ছে সেগুলোতে রোগী থেকে রোগীতে এবং রোগী থেকে চিকিৎসক ও চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট কর্মীদের মধ্যে করোনা ছড়ানোর হার একেবারেই কম। বিশ্বের সব উন্নত দেশ এমনকি পাশের দেশ ভারতেও এই প্রক্রিয়ায় রোগী বাছাই হচ্ছে। ভারতের কেরালা ও কর্নাটকে এই ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা থাকায় সেখানে কোভিড রোগীদের শনাক্ত ও চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে সুফল পাওয়া গেছে।
ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনা হচ্ছে কোভিড-১৯ চিকিৎসার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা নির্দেশিত একটি বিশ্বজনীন রীতি (ইউনিভার্সেল প্রটোকল)। ট্রায়াজ শব্দের অর্থ আলাদা করা বা বিভিন্ন ভাগে ভাগ করা। করোনার ক্ষেত্রে কোনও রোগীকে লক্ষণ অনুযায়ী ভাগ করে চিকিৎসা দেওয়া হলে তাদের থেকে সংক্রমণের সংখ্যা অনেকাংশেই কমে যায়। জ্বর, সর্দি, কাশি, শ্বাসকষ্ট এসব উপসর্গ নিয়ে কেউ এলে তাদের কোথায় যেতে হবে সে সম্পর্কে নির্দেশনা দেওয়া থাকে এতে। এমনকি এ ধরনের রোগীর টিকিট কাউন্টারেও যেতে মানা। সোজা কথায়, অন্য সব রোগীর সংস্পর্শে যাতে কোভিড আক্রান্ত রোগীকে যেতে না হয় তার সব ব্যবস্থাই থাকে ট্রায়াজে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, এখন পর্যন্ত নয় জন চিকিৎসক মারা গেছেন করোনা আক্রান্ত হয়ে, চার জন মারা গেছেন করোনার লক্ষণ-উপসর্গ নিয়ে আর করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ৮শ’র বেশি চিকিৎসক।
চিকিৎসকদের সংগঠন ফাউন্ডেশন ফর ডক্টরস সেফটি রাইটস অ্যান্ড রেসপনসিবিলিটিস (এফডিএসআর)-এর যুগ্ম সম্পাদক ডা. রাহাত আনোয়ার চৌধুরী জানান, এখন পর্যন্ত ৯৭১ জন চিকিৎসক করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন, মারা গেছেন ১২ জন আর করোনার উপসর্গ নিয়ে মারা গেছেন চার জন। নার্স এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যকর্মী আক্রান্ত হয়েছেন এক হাজার ৩৩০ জন।
তবে শুরু থেকেই ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনার কারণে দেশের কোভিড ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসক ও নার্সদের সংক্রমিত হওয়ার সংখ্যা কম। কুয়েত-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল, কুর্মিটোলা হাসপাতাল, মুগদা জেনারেল হাসপাতালের মতো ডেডিকেটেড হাসপাতালগুলোতে ট্রায়াজ ব্যবস্থা মেনে চলা হচ্ছে শুরু থেকে। এসব হাসপাতালে এখনও চিকিৎসক বা চিকিৎসা সংশ্লিষ্ট অন্য কর্মীদের আক্রান্ত হওয়ার সংখ্যা প্রায় নেই বললেই চলে। কিন্তু, যেসব হাসপাতালে ডেডিকেটেড বলার পরেও সব নিয়ম মানা সম্ভব হয়নি, আক্রান্তের ঘটনা আছে সেখানে।
ট্রায়াজ ব্যবস্থাপনার সুবিধা সম্পর্কে জানাতে গিয়ে চিকিৎসকরা বলছেন, এতে শুরুতেই জ্বর, সর্দি, কাশি ও শ্বাসকষ্টের রোগীদের অন্যদের থেকে পৃথক করে ফেলা যায়, তাতে করে অন্য রোগীদের সঙ্গে তাদের মিক্সিং হয় না। একইসঙ্গে সব চিকিৎসকও এক্সপোজড হন না এবং খুব সহজেই তাদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়। ট্রায়াজেই চিকিৎসকরা সিদ্ধান্ত নেন কোনও রোগীকে তারা আইসোলেশনে রাখবেন, হাসপাতালে ভর্তি করাবেন নাকি বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হবে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে এতদিন কোভিড রোগীদের জন্য না হলেও দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে কোভিড ও নন-কোভিড রোগীদের ভিন্ন ভিন্ন অংশে চিকিৎসা দিতে সরকারি নির্দেশের পর সেখানে ১৫০ শয্যার করোনা ইউনিট চালু করা হচ্ছে বলে বাংলা ট্রিবিউনকে জানান হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. উত্তম কুমার বড়ুয়া।
এই হাসপাতালে ১০ থেকে ১২ দিন আগে ট্রায়াজ করা হয়েছে জানিয়ে উত্তম কুমার বড়ুয়া বলেন, কোভিড রোগীদের ভর্তি করার জন্য সরকারের নির্দেশনার আগেই এখানে ট্রায়াজ করা হয়েছে। কারণ, হাসপাতালে অনেক চিকিৎসকসহ অন্যরা আক্রান্ত হচ্ছিল।
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল একেএম নাসির উদ্দিন বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এ হাসপাতালে অনেক আগে থেকেই ট্রায়াজ সিস্টেম মেইনটেইন করা হচ্ছে।
স্যার সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল রাশিদুন নবী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ট্রায়াজ করেছি, রোগী রাখছি, চিকিৎসা দিচ্ছি। যদি দরকার হয় কিছু রোগীকে অন্য হাসপাতালে পাঠাচ্ছি।
হাসপাতালে ট্রায়াজ করা হয়েছে জানিয়ে জাতীয় চক্ষু বিজ্ঞান ইনস্টিটিউট ও হাসপাতালের পরিচালক অধ্যাপক ডা. গোলাম মোস্তফা বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, নয়তো আমাদের চিকিৎসকরাই আক্রান্ত হবেন, তখন তো হাসপাতালেরই সমস্যা হবে।
বাংলাদেশ মেডিক্যাল অ্যাসোসিয়েশন (বিএমএ) মহাসচিব ডা. ইহতেশামুল হক চৌধুরী বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ঢাকার ভেতরে হাসপাতালগুলোতে ভিশন এবং ম্যানপাওয়ার দুটোই রয়েছে। সমস্যা হচ্ছে ঢাকার বাইরে। হাসপাতালগুলোতে ট্রায়াজ করতে হবে, রোগী ফেরত যাবে না এ বিষয়গুলো এখন মাথায় ঢুকে গেছে, আমরা একটা পর্যায়ে পৌঁছে গেছি। সার্ভিসেও আগের চেয়ে অনেক উন্নতি হয়েছে।