ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের (ডিএনসিসি) চারটি ওয়ার্ডে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব মোকাবিলায় পূর্বপ্রস্তুতিমূলক প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। বেসরকারিভাবে উদ্যোগটি নিয়েছে সোশ্যাল এন্ড ইকোনোমিক ইনহ্যান্সমেন্ট প্রোগ্রাম-সিপ। ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও স্থানীয়দের সম্পৃক্ত করে প্রতিটি পাড়া-মহল্লায় সমন্বিতভাবে কাজ চলছে। ফলে ওইসব এলাকায় মশার প্রকোপ তেমন নেই বলে দাবি স্থানীয় বাসিন্দাদের।
সরেজমিন দেখা গেছে, সিপ-এর কর্মীরা স্বেচ্ছাসেবকদের নিয়ে ডিএনসিসির ২, ৩, ৫ ও ৬ নম্বর ওয়ার্ডের বিভিন্ন এলাকায় লার্ভিসাইডিং ছিটাচ্ছেন যাতে মশার লার্ভা জন্ম না নেয়। পাশাপাশি মাইকিং ও লিফলেট বিতরণের মাধ্যমে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করছেন তারা। এজন্য এলাকাভিত্তিক দল গঠন করা হয়েছে।
এদিকে পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে রাজধানীর কিংস্টন হাসপাতালের একটি ওয়ার্ডকে ডেঙ্গু রোগীদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে। করোনা মহামারির মধ্যে কেউ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হলে যাতে সঠিক চিকিৎসা সেবা পান সেজন্য উদ্যোগটি নিয়েছে সিপ। এছাড়া ডেঙ্গু পরীক্ষা যেন বিনামূল্যে করা যায়, সেজন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে।
প্রকল্পটির বিভিন্ন লক্ষ্যের মধ্যে রয়েছে–ডেঙ্গুর বিস্তার রোধে পরীক্ষামূলক নজরদারি পদ্ধতি গড়ে তোলা, ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের সঙ্গে সমন্বয় করা; স্থানীয় সরকার, জনপ্রতিনিধি ও সিটি করপোরেশনের সঙ্গে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়া, প্রকল্পভুক্ত ওয়ার্ডগুলোতে মশা নিধন ও ব্যবস্থাপনায় সহায়তা দেওয়া, সংকট মোকাবিলায় প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি করা, ডেঙ্গু থেকে সৃষ্ট স্বাস্থ্যগত ও আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি কমিয়ে আনা।
সিপ-এর উপ-নির্বাহী পরিচালক তাহমিনা জেসমিন মিতা বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, পরীক্ষামূলক নজরদারি পদ্ধতি গড়ে তুলতে শুরুতে ডিএনসিসি’র চারটি ওয়ার্ডকে বেছে নেওয়া হয়েছে। তার দাবি, ‘কোথাও কোনও ডেঙ্গু রোগী পাওয়া গেলেই প্রকল্পের পক্ষ থেকে সেখানকার আশেপাশে ৪০০ বর্গমিটার পর্যন্ত মশার ওষুধ ছিটানো হয়। জনসচেতনতা ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতা বৃদ্ধি, নীতিনির্ধারকদের সক্রিয় ও গণমাধ্যমকে সম্পৃক্ত করার মাধ্যমে জনস্বাস্থ্যের ওপর হুমকি নিয়ন্ত্রণেই আমাদের এই উদ্যোগ। আমাদের দুটি হটলাইন রয়েছে, এসব নম্বরে ফোন করে ডেঙ্গু সম্পর্কে পরামর্শ ও এই রোগ প্রতিরোধে সহযোগিতা নেওয়া যাবে।’
গত বছর ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাবে শতাধিক মানুষের মৃত্যু হয়। এছাড়া আক্রান্ত হয়েছিল লক্ষাধিক মানুষ। এ তথ্য উল্লেখ করে সিপ-এর উপ-নির্বাহী পরিচালক বলেন, ‘এ বছরও ডেঙ্গু রোগ মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে। গত বছরের পুনরাবৃত্তি যেন না হয় সেজন্যই পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে আমরা প্রকল্পটি গ্রহণ করেছি। এতে অর্থায়ন করছে স্টার্ট ফান্ড বাংলাদেশ ও ইউকেএইড। ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব হয়ে যাওয়ার পর তো কাজ করে লাভ নেই। তার আগেই প্রস্তুত থাকা চাই। সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালগুলোতে ডেঙ্গু ও কোভিড রোগীদের জন্য আলাদা ব্যবস্থা দরকার। জনগণ যেন আতঙ্কিত না হয়ে প্রয়োজনীয় সেবা নিতে পারেন সেজন্য আমরা ঢাকার কয়েকটি হাসপাতালের সঙ্গে কাজ করছি। এসব প্রতিষ্ঠানে আলাদাভাবে ডেঙ্গু পরীক্ষার জন্য বিনামূল্যে কিট দেওয়া হয়েছে। এছাড়া গণমাধ্যম ও মিডিয়া ব্যক্তিত্বদের সঙ্গে নিয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে কাজ করছি।’
ডিএনসিসির ২ নং ওয়ার্ডে অবস্থিত কিংস্টন হাসপাতালের নির্বাহী পরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) মো. শওকত আলী বাংলা ট্রিবিউনকে জানান, সিপ-এর সহযোগিতায় তারা একটি বিশেষায়িত ডেঙ্গু ওয়ার্ড রেখেছেন। এখানে শুধু ডেঙ্গুতে আক্রান্ত রোগীদের ভর্তি করা হবে। ডেঙ্গু রোগীর চিকিৎসায় পারদর্শী চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদেরই শুধু ওয়ার্ডটির দায়িত্বে নিয়োজিত রাখবে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ।
২০০১ ও ২০০২ সালে ডেঙ্গুর প্রকোপের কথা মনে করিয়ে দিয়েছেন অবিভক্ত ঢাকা সিটি করপোরেশনের এই সাবেক প্রধান স্বাস্থ্য কর্মকর্তা। তার মন্তব্য, ‘আমাদের চিকিৎসক ও নার্সরা প্রশিক্ষিত হওয়ায় তখন ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ করা গেছে। গতবছর এক লাখের মতো রোগী হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল। এর মধ্যে ৫০ শতাংশের বেশি ছিল ঢাকায়। আমরা যদি পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে পদক্ষেপ না নিই তাহলে ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়লে পরিস্থিতি সামাল দেওয়া কঠিন হয়ে পড়বে। এজন্য প্রতিটি হাসপাতালেই এমন বিশেষায়িত ওয়ার্ড রাখা দরকার।’
যদিও কিংস্টন হাসপাতালে এখন কোনও ডেঙ্গু রোগী নেই। এর কারণ কী? মো. শওকত আলীর উত্তর, ‘আমাদের হাসপাতালের আশেপাশের ওয়ার্ডগুলোতে ডেঙ্গু প্রতিরোধে কাজ করার সুফল এটি। অন্য কারণও থাকতে পারে। মানুষ হয়তো করোনার কারণে ভয়ে হাসপাতালমুখী হচ্ছে না। তাছাড়া সব রোগীর হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না।’
গণস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গু রোগ মূলত দুটি মাধ্যমে ছড়ায়। প্রথমত এডিস মশা, দ্বিতীয়ত ডেঙ্গুতে আক্রান্ত ব্যক্তির মাধ্যমে। তাই সচেতনতা বৃদ্ধির পাশাপাশি পূর্বপ্রস্তুতি থাকলে ডেঙ্গু মুক্ত থাকা যাবে বলে আশাবাদী ডিএনসিসি মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। তার ভাষ্য, ‘আমাদের পূর্বপ্রস্তুতি রয়েছে। গত বছরের অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগিয়ে আমরা কাজ করছি। পাশাপাশি সরকারি বা বেসরকারিভাবে যদি কোনও প্রতিষ্ঠান এগিয়ে আসে তাদের স্বাগত জানাবো। আমরা সবাইকে নিয়ে কাজ করে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাখতে চাই।’