ইমাম ও মুয়াজ্জিনরা সাধারণত মসজিদের মিম্বারে, ওয়াজ মাহফিলে, দ্বীনি পরিবেশে ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানদের স্বতন্ত্রভাবে ইবাদতের প্রতি উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। এক্ষেত্রে উদ্বুদ্ধকারী ইমাম-মুয়াজ্জিন নিজেরা যে ইবাদত ও আমলগুলো করেন, স্বাভাবিকভাবেই মুসল্লি ও ধর্মপ্রাণ মুসলমানেরা ওইসব আমল ও ইবাদতের প্রতি বেশি উদ্বুদ্ধ হন। সেই সঙ্গে তা পরিপালনে তাদের আগ্রহও তুলনামূলক বেশি অনুভূত হয়। প্রশ্ন হচ্ছে–নামাজ-রোজা, জিকির-আজকার ইত্যাদি আমলগুলো ইমাম-মুয়াজ্জিনদের আদায় করা দেখে সাধারণ মুসল্লিরা যেভাবে উদ্বুদ্ধ হওয়ার ও অনুপ্রেরণা লাভের সুযোগ পান, ঠিক সেভাবে আর্থিক ইবাদতও তাদের (ইমাম-মুয়াজ্জিনদের) দেখে দেখে পরিপালন তারা করতে পারেন কিনা? দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির সময়ে ইমাম-মুয়াজ্জিনরা যে নির্দিষ্ট পরিমাণ বেতন পান, তা দিয়ে সংসার চালানোর পাশাপাশি তারা কি জাকাত আদায়, কোরবানি ইত্যাদির মতো আমলগুলো করতে পারছেন, যা দেখে দেখে সাধারণ মুসলমানেরাও কোরবানিতে উদ্বুদ্ধ হবেন?
বিষয়টি জানতে শহর ও গ্রামের কয়েকজন ইমাম-মুয়াজ্জিনের সঙ্গে কথা হয়। তাদের বক্তব্যে প্রায় সবারই অভিন্ন আর্থিক পরিস্থিতির বিষয়টি উঠে আসে। অর্থাৎ শুধুমাত্র ইমামতি কিংবা আজান দিয়ে তারা যে সম্মানি পান, তা দিয়ে কোরবানি-জাকাত তো দূরের কথা, স্ত্রী-সন্তান ও মা-বাবাকে নিয়ে সংসার চালানোই অসম্ভব হয়ে ওঠে।
মুফতি মোহাম্মদ ইখলাসুদ্দীন। বাড়ি ময়মনসিংহের গৌরিপুর উপজেলার বেগারকান্দা গ্রামে। তিনি রাজধানীর লালমাটিয়ায় ‘মসজিদে বাইতুল হারাম’র ইমাম। স্ত্রী-সন্তান নিয়ে ঢাকায় থাকলেও গ্রামে থাকা মা-বাবা ও ছোট ভাইবোনের দেখাশোনার দায়িত্ব তার। মোহাম্মদ ইখলাসুদ্দীন জানান, পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়িয়ে যে সম্মানি তিনি পান, তা দিয়ে পুরো পরিবারের খরচ চালানো সম্ভব হয়ে ওঠে না।
তিনি জানান, ইমামতির পাশাপাশি মসজিদের পাশেই জামিয়া ইসলামিয়া লালমাটিয়া মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করেন তিনি। পরিবারের ব্যয় চালাতে শিক্ষকতার সঙ্গে টুকটাক আরও কিছু কাজও করতে হয় তাকে।
এ পরিস্থিতির মধ্যেও এ বছর কোরবানি করবেন কিনা, জানতে চাইলে মুফতি মোহাম্মদ ইখলাসুদ্দীন বলেন, ‘হ্যাঁ, কোরবানি দিচ্ছি। তবে এটি ইমামতি থেকে পাওয়া সম্মানির টাকায় নয়, বরং পারিবারিক ক্ষেত-খামারসহ আমার অন্যান্য আরও যে উপার্জন, তা থেকে কোরবানির টাকা জোগাড় করছি।’
আরেকজন ইমাম হাফেজ মাওলানা মোহাম্মদ তফিজুর রহমান। বাড়ি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার দাদপুর গ্রামে। তিনি রাজবাড়ী জেলা সদরের বড় ভবানীপুর দেওয়ানপাড়া নতুন জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব। তিন বছর ধরে এখানে খেদমত করছেন তিনি। প্রতি মাসে সম্মানি পান ৯ হাজার টাকা।
মাওলানা মোহাম্মদ তফিজুর রহমান জানান, এখানে তিনি যে সম্মানি পান, তা দিয়ে পরিবারের জন্য কোনোভাবে ডাল-ভাতের ব্যবস্থা করাও মুশকিল হয়ে পড়েছে। ভালো মাছ তো দূরের কথা, পুকুরের মাছ কেনাও দুরূহ ব্যাপার। পাশাপাশি অসুস্থতায় চিকিৎসা ও আনুষঙ্গিক খরচ মেটাতে হিমশিম খেতে হয়।
তিনি বলেন, ‘গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি মসজিদ ও ইমামের আর্থিক অবস্থা প্রায় কাছাকাছি। তাদের জীবনযাপন খুবিই কষ্টকর। সামনে কোরবানি। ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আর্থিক সংকটের কারণে কোরবানি করতে পারছি না।’ তার ভাষ্য— একজন ইমামকে অন্তত ২০ হাজার টাকা সম্মানি দিলে, তিনি মোটামুটিভাবে পরিবার নিয়ে চলতে পারবেন, এর কমে যদিও চলে, কিন্তু ওটাকে চলা বলে না।
একই ধরনের কথা বললেন মুফতি আসআদ আফিফি। তিনি গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলার বেড়াদিয়ারচালা গ্রামের ফুলজান বিবি জামে মসজিদের ইমাম ও খতিব। মসজিদ থেকে তাকে ৮ হাজার টাকা সম্মানি দেওয়া হয়। তার মতে, এই বেতনে একজন মানুষ কোনোভাবেই সংসার চালাতে পারেন না।
বাড়তি অর্থের প্রয়োজনে পাশের একটি মাদ্রাসায় পড়ান বলেও জানান মাওলানা আসআদ আফিফি। এ বছর কোরবানি দেবেন কিনা প্রশ্নে তরুণ এ আলেম বলেন, ‘সম্ভব না।’ তবে কোরবানি দেওয়ার প্রবল ইচ্ছা তার মনে। তিনি মনে করেন– যদি তাকে পরিশ্রম অনুযায়ী মূল্যায়ন করা হতো এবং সম্মানী ধার্য করা হতো, তাহলে হয়তো আর্থিক দিকটা আরেকটু স্বচ্ছল হতে পারতো এবং কোরবানিও দিতে পারতেন।
গাজীপুর জেলার টঙ্গীতে অবস্থিত তুরাগের তাল্লুকপাড়া বাইতুল আমান জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন হাফেজ ইমদাদুল্লাহ। ২০১৫ সাল থেকে তিনি এখানে খেদমত করছেন। তার মাসিক সম্মানী ১০ হাজার টাকা। বাবার ইন্তেকালের পর তিনিই সংসারের হাল ধরেছেন।
হাফেজ ইমদাদুল্লাহ জানান, সংসারের খরচ চালাতে মসজিদ থেকে পাওয়া সম্মানী দিয়ে তেমন কিছুই হয় না তার। টিউশনি ইত্যাদি করে তার বাকি অর্থের চাহিদা পূরণ করতে হয়। তবে এ বছর তিনি কোরবানি দেবেন বলে মনস্থির করেছেন। কোরবানির অর্থ জোগাড় করছেন কীভাবে এবং তার ওপর কোরবানি ওয়াজিব কিনা– জানতে চাইলে হাফেজ ইমদাদুল্লাহ বলেন, ‘হ্যাঁ, আমার ওপর কোরবানি ওয়াজিব এবং কোরবানি ওয়াজিব হয়েছে অন্য আয়ের সঞ্চয়ের ওপর ভিত্তি করে। কোরবানির টাকার জোগাড়ও সেখান থেকেই, মসজিদ থেকে প্রাপ্ত সম্মানী থেকে নয়।’
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী, শিক্ষক, মারকাযুদ দিরাসাহ আল ইসলামিয়্যাহ, ঢাকা