ঈদ মৌসুমের পর দেশে নতুন করে অস্থিরতা সৃষ্টির আশঙ্কা করছেন বিভিন্ন দলের শীর্ষ রাজনীতিকরা। বিএনপিসহ দেশের মূল ধারার রাজনৈতিক দলগুলোর নেতারা বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে জানিয়েছেন, দেশের বর্তমান আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, সারা দেশে ঘটমান খুনোখুনি, চাঁদাবাজি, বিভিন্ন দলের গোপন চাঁদাবাজি, জমি দখলসহ সামাজিক অপরাধ বেড়ে যাওয়ায় সরকারের উচ্চ পর্যায়ে কঠোর হওয়ার বার্তা তারা পেয়েছেন। বিশেষ করে নির্বাচনকে সামনে রেখে পেশিশক্তির উত্থান ঠেকাতে সরকারের শীর্ষ পর্যায়ে অত্যন্ত কঠোর হওয়ার চিন্তা-ভাবনা সম্পর্কে তারা আঁচ করতে পারছেন বলে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন শীর্ষ পর্যায়ের নেতারা।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন সদস্য সম্প্রতি এই প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপকালে উল্লেখ করেন, গত ফেব্রুয়ারিতে অনুষ্ঠিত ডিসি সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন লাগবে না বলে জানিয়েছেন। বিষয়টি স্পর্শকাতর সিদ্ধান্ত। এক্ষেত্রে ভিন্ন কোনও কারণ থাকতে পারে।’
কোনও কোনও সূত্র জানিয়েছে, দেশের অভ্যন্তরীণ আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও গত বছরের ৫ আগস্টের পর কারাগার থেকে উগ্রবাদে যুক্ত বিভিন্ন মতাদর্শের নেতারা মুক্ত হওয়া এবং তাদের প্রকাশ্য কর্মকাণ্ড না থাকায় সন্দেহের সূত্রপাত হয়েছে। এক্ষেত্রে রাষ্ট্রীয় কোনও কোনও সংস্থার আচরণকেও ‘সন্দেহজনক’ বলে বিবেচনা করছেন একাধিক রাজনীতিক।
একাধিক রাজনীতিক উল্লেখ করেছেন, দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি বিবেচনায় সরকার কঠোর হতে পারে, এমনকি ওয়ান-ইলেভেনের মতো জরুরি অবস্থাও জারি হতে পারে—এমন সম্ভাবনা তারা উড়িয়ে দেননি।
তবে বিএনপির উচ্চ পর্যায়ের একটি সূত্র এ প্রতিবেদককে জানিয়েছেন, দেশের পরিস্থিতি খানিকটা হুসেইন মুহম্মদ এরশাদের ক্ষমতা গ্রহণের সময়ের মতোও হতে পারে। তবে এখনও তা স্পষ্ট না।
‘সব ক্ষেত্রেই বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ শীর্ষ নীতিনির্ধারকরা দলের ভারসাম্যপূর্ণ কৌশলকেই সামনে রেখে এগিয়ে যাচ্ছেন।’
স্থায়ী কমিটি ও দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বাংলা ট্রিবিউনকে জানায়, বিএনপির বর্তমান যে অবস্থান— তা সচেতনভাবে গৃহীত। কোনও দলকে কাছে টানা, কোনও দলকে পেছনে নেওয়া, সরকারের প্রতি সহযোগিতার মনোভাব ও বিভিন্ন প্রভাবশালী পক্ষের সঙ্গে সমান্তরাল সম্পর্ক স্থাপন—সব ক্ষেত্রেই পলিসিনির্ভর বিএনপি।
‘এক্ষেত্রে কোনও কোনও নেতা ব্যক্তিগতভাবে মিডিয়ামুখী বক্তব্য দিলেও আদতে দলের নীতি ও কৌশলকে প্রতিনিধিত্ব করে না’ বলে জানান বিএনপির নির্ভরযোগ্য একজন দায়িত্বশীল।
বিএনপির প্রভাবশালী এক নেতার সন্দেহ, ভারত ইস্যুতে বর্তমান দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি বেশ নেতিবাচক থাকায় আরেকটি দেশের প্রভাবশালী সংস্থার কর্মকাণ্ড উড়িয়ে দেওয়া যায় না। এক্ষেত্রে বাংলাদেশে নতুন করে ‘অস্থিরতা সৃষ্টি করার পাঁয়তারা’র দিকেও ওই সংস্থাটির মনোযোগ থাকতে পারে।
শীর্ষ পর্যায়ের এক নেতা বলেন, ‘ভারত ইস্যুতে রাজনীতিতে এত বেশি নেতিবাচক প্রচারণা তৈরি হয়েছে যে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে বললেও তা ভারতের দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে। এ বিষয়টিই সবচেয়ে বড় হুমকি।’
জানতে চাইলে বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক বলেন, ‘আমি সরকারের ইতিবাচক কিছু উদ্যোগের প্রশংসাই করবো, রোজার এই সময়কালে চালসহ কিছু নিত্যপণ্যের দাম বিগত সরকারের সময়ে নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিল—সেগুলোকে একটি সহনীয় মাত্রায় আনার জন্য। রোজার সঙ্গে জড়িত কিছু পণ্যের মূল্য কম্পারিটিভলি কম ছিল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভূমিকার জন্য আমি প্রশংসাই করবো, কিন্তু ঈদের পর এর ধারাবাহিকতা থাকবে কিনা, এই প্রশ্নটি সামনে এসেছে।’
সাইফুল হকের পর্যবেক্ষণ, সামগ্রিকভাবে দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খারাপ অবস্থায় আছে। দিন যত যাচ্ছে, ঢাকা ও ঢাকার আশপাশে প্রশাসন কার্যকর থাকলেও সারা দেশে পরিস্থিতি অনেক অকার্যকর, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতিও শিথিল। সারা দেশে চলছে নৈরাজ্যকর পরিস্থিতি।’
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম এই নেতা উল্লেখ করেন, ব্যাপকভাবে নৈরাজ্যের মধ্যেও সাধারণ মানুষ সহনশীলতার পরিচয় দিচ্ছেন। পরিস্থিতি হজম করছেন, মেনে নিচ্ছেন। কিন্তু নির্বাচন যত অনিশ্চয়তার দিকে যাচ্ছে, পরিস্থিতিও তত অবনতির দিকে যাচ্ছে। আমি পরিস্থিতির আরও অবনতির আশঙ্কা করছি।’
সাইফুল হকের ব্যাখ্যা, দেশে পরাজিত শক্তি ক্রিয়াশীল, পাশাপাশি নানান ধরনের পক্ষ বহুমাত্রিক তৎপরতায় রয়েছে বলেও সন্দেহ প্রকাশ করছি।
তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে অন্তর্বর্তী সরকারের মৌলিক প্রশ্নে দূরত্ব বাড়ছে। এ কারণে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ঝুঁকিও বাড়ছে। যে কারণে উল্লেখ করা যায়, সরকারকে কঠোর হতে হবে এসব প্রশ্নে।’
বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম মনে করেন, আপাতদৃষ্টিতে সামগ্রিক পরিস্থিতি নির্বাচনমুখী। সব কিছু নির্বাচনকেন্দ্রিক ধাবিত হোক, সকলেই তা চায়। কিছু ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীকে সরকার ও জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হচ্ছে।
১২ দলীয় জোটের এই নেতা বলছেন, কিছু কুচক্রী মহল নিজেদের উচ্চাকাঙ্ক্ষা ও ব্যক্তির উচ্চাকাঙ্ক্ষা রক্ষার জন্য পুরো বিষয়টিকে জটিল করার আশঙ্কা সৃষ্টি করছে বলে মানুষের মনে প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে।
শাহাদাত হোসেন সেলিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘দেশে নির্বাচিত সরকার, নির্বাচিত সংসদ ও জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল সরকার দরকার। বিরাজমান সব সমস্যা দূর করার জন্য নির্বাচিত সরকার জরুরি।’
তিনি বলেন, ‘কিছু কুচক্রী মহল সেনাবাহিনীকে জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করাচ্ছে। ওই মহলটির কাছে নির্বাচন দীর্ঘায়িত করলে সুবিধা। তবে আমরা জানি, অধ্যাপক ইউনূস আন্তর্জাতিক খ্যাতিমান ব্যক্তিত্ব। তিনি কোনও কূটচালে পরাভূত না হয়ে ইমানি দায়িত্ব পালন করবেন।’
তবে আমার বাংলাদেশ (এবি) পার্টির চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেন, ‘অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম দিকে যখন পুলিশের কার্যক্রম বিপর্যস্ত ছিল, তখন জরুরি অবস্থা জারি করে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক অবস্থায় আনার একটা যৌক্তিকতা ছিল। কিন্তু এখন সেটা আর নাই। পুলিশ প্রশাসন এখন আগের চেয়ে গুছিয়ে উঠেছে মনে হচ্ছে।’
এবি পার্টির শীর্ষ নেতা মনে করেন, ‘এখন যেটা শোনা যাচ্ছে সেটা পুরোটাই গুজব। আমি এর কোনও সম্ভাবনা ও প্রয়োজন দেখি না।
‘বহু মতের চর্চা করবে এনসিপি’
একাধিক রাজনীতিক বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ে গঠিত জাতীয় নাগরিক কমিটির বেকআপ-সন্ধান করছেন। সম্প্রতি বাংলা ট্রিবিউনের সঙ্গে আলাপকালে তারা উল্লেখ করেছেন, ছাত্রদের শক্তির নেপথ্যে কে বা কারা—তা স্পষ্ট হতে পারছেন না।
বিশেষ করে গত ১১ মার্চ সেনাবাহিনী প্রধান জেনারেল ওয়াকার-উজ-জামানের সঙ্গে জাতীয় নাগরিক কমিটির দুই প্রভাবশালী নেতা হাসনাত আব্দুল্লাহ ও সারজিস আলমের বৈঠকের পর হাসনাতের একটি স্ট্যাটাসে (২০ মার্চ) পুরো রাজনীতিতে তোলপাড় সৃষ্টি হয়।
ওই স্ট্যাটাসে হাসনাত উল্লেখ করেন, 'ক্যান্টনমেন্ট থেকে আওয়ামী লীগকে পুনর্বাসনের পরিকল্পনা করা হচ্ছে।’ পরে হাসনাতের স্ট্যাটাসের পর সারজিস আলমও স্ট্যাটাস দেন। ২৩ মার্চ দুপুরে ফেসবুকে দেওয়া স্ট্যাটাসে সারজিস লিখেন, ‘মানুষ হিসেবে যেকোনও ব্যক্তি বা ব্যক্তির অভিমতকে একেকজন একেকভাবে অবজার্ভ করে। হাসনাত সেদিন তার জায়গা থেকে যেভাবে সেনাপ্রধানের বক্তব্যকে অবজার্ভ ও রিসিভ করেছে এবং ফেসবুকে লিখেছে, আমার সেক্ষেত্রে কিছুটা দ্বিমত আছে।’ তিনি বিস্তারিত বর্ণনা করেন নিজের ভাষ্যে।
এরপর নিজ সংসদীয় এলাকায় সারজিস আলমের গাড়ি ব্যবহার করে প্রচারণা নিয়েও দলের ভেতরে আলোচনা সৃষ্টি হয়। কেন্দ্রীয় নেতাদের কেউ কেউ তার গাড়ি ব্যবহার নিয়ে প্রকাশ্যে প্রশ্নও তুলেন।
এ বিষয়ে জাতীয় নাগরিক কমিটি ও তরুণদের এই দলটির সঙ্গে ঘনিষ্ঠ একাধিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে বাংলা ট্রিবিউন। তাদের মধ্যে কেউ কেউ মনে করেন, পুরো বিষয়টি সামনে এসেছে পরিকল্পনার অংশ হিসেবেই।
‘বিশেষত জাতীয় নাগরিক কমিটি (এনসিপি) আলোচনায় থাকার পরিপ্রেক্ষিতে এ ধরনের বিষয় আলোচনায় এসে থাকতে পারে’, এমন ভাষ্যও দিয়েছেন কেউ কেউ।
এ প্রসঙ্গে এনসিপির শীর্ষ পর্যায়ের কয়েকজন নেতার সঙ্গে গত কয়েক দিনে বেশ কয়েকবার যোগাযোগ করা হলেও কথা বলা সম্ভব হয়নি।
পরে শুক্রবার (২৮ মার্চ) দুপুরে জাতীয় নাগরিক পার্টির যুগ্ম সদস্য সচিব আকরাম হোসাইন সিএফ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ‘আমাদের দেশে রাষ্ট্রীয় ও দলীয় পর্যায়ে বহুমত চর্চার বিষয়টি নেই। আমরা এটা সংসদেও দেখিনি, রাজনৈতিক দলগুলোয়ও দেখিনি। দলের টপ লিডারদের নিয়ে এক ধরনের মনোপলি দেখেছি আমরা। একই পার্টির মধ্যে ভিন্নমত পোষণ করার স্বাধীনতাও প্রয়োজন।’
’২৪-এর যে স্পিরিট, তা রাষ্ট্র ও দলের সঙ্গে একাত্মবোধ করে সামনে এগোনোর বিষয়। জাতীয় নাগরিক পার্টি কোনও সিঙ্গেল শক্তির দল নয়, এখানে সবার অংশগ্রহণ আছে, যেমনটা ছিল ২৪-এর অভ্যুত্থানে’, বলেন আকরাম হোসাইন।
তার ভাষ্য, ‘আমাদের দেশে টপ লিডারদের পছন্দ না—এমন আলোচনা হয় না। কিন্তু ২৪-এর স্পিরিট হচ্ছে প্রত্যেকের মতামত ব্যক্ত করার, প্রত্যেকের মত চর্চার সুযোগ সৃষ্টি করা। কেবল একজনের প্রতি শ্রদ্ধা রেখে বাকি মতামত চেপে রাখার সুযোগ নেই—এনসিপি সেই চর্চা করছে।’
আকরাম হোসাইন বলছেন, আগামী দিনে দেশের রাজনীতিতে যেসব দল বা সংগঠন আসবে, সেসব দল বা সংগঠনেও এই ভিন্নমত চর্চার প্রাধান্য থাকবে। ২৪-এর ডিমান্ড হচ্ছে এটি। গত ৫৪ বছর ধরে আমরা দেখেছি, রাজনীতি, রাষ্ট্রে, সংসদে বহুমত চর্চা গড়ে ওঠেনি।’
বিএনপির স্থায়ী কমিটির একজন প্রবীণ সদস্য বলেন, ‘এনসিপির প্রভাব ও শক্তি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে।’
যদিও হাসনাত ও সারজিসের আলোচনার পর বিএনপির পক্ষ থেকে সরাসরি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ আনা হয়। দলটির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর এর সমালোচনা করেন।