X
রবিবার, ১৯ মে ২০২৪
৫ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা

আহতদের বিভীষিকাময় বর্ণনা, যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন এখনও

মাহফুজ সাদি
২১ আগস্ট ২০২৩, ১২:০০আপডেট : ২১ আগস্ট ২০২৩, ১২:৪৫

বিএনপি-জামায়াতের শাসনামলে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের শান্তি সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ঘটনা ঘটে। এতে প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী, আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ মোট ২৪ জন নেতাকর্মী প্রাণ হারান। আক্রান্ত হন তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও। ওই হামলায় আহত দুই জনের সঙ্গে কথা বলেছে বাংলা ট্রিবিউন। তাদের বর্ণনায় হামলার পরের বিভীষিকাময় সময়ের চিত্র উঠে এসেছে, এখনও যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছেন তারা।

অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের বন ও পরিবেশ সম্পাদক মো. নাজিম উদ্দিন ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলায় আহত হয়েছিলেন। বর্তমানে তিনি ঢাকা মহানগর উত্তর আওয়ামী লীগের সহসভাপতি পদে রয়েছেন। তার কাছে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার সময় কেমন অবস্থা ছিল বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে? জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমরা অবিভক্ত ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা ২১ আগস্টের শান্তি সমাবেশে যোগ দেই। বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে, পা ফেলার ঠাঁই নেই। কয়েকজন নেতা বক্তৃতা দেওয়ার পর নেত্রী (শেখ হাসিনা) আসলে, ট্রাকের ওপর তৈরি মঞ্চে উঠলেন। মঞ্চে চাপাচাপি করে নেতারা দাঁড়ালেন। সবশেষ নেত্রী বক্তব্য দিলেন। আমি তখন বাটার শোরুমটার সামনে রাস্তায় দাঁড়িয়ে বক্তব্য শুনছিলাম।’

তৎকালীন বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার বক্তব্যের শেষে হঠাৎই একটা বিস্ফোরণ ঘটে। সেই সময়ে বর্ণনা দিয়ে আওয়ামী লীগের এই নেতা বলেন, ‘প্রথম বিস্ফোরণের পর আরেকটা ফুটলো, আরেকটা ফুটলো— এভাবে পরপর বেশ কয়েকটি বোমার বিস্ফোরণ হয়। তাৎক্ষণিকভাবে আমার কাছে মনে হলো— এটা বড় ধরনের একটা আক্রমণ। তখন ১৫ আগস্টের কথা মনে পড়ে গেলো। সেদিন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছিল। আজ তার কন্যা শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা এখানে উপস্থিত, এখানে বড় ধরনের একটা হত্যাকাণ্ড ঘটে যেতে পারে।’

তিনি বলেন, ‘পরপর বিস্ফোরণের বিটক শব্দ হওয়ায় আমরা মাটিতে শুয়ে পড়লাম। তারপরও একটার পর একটা বোমার বিস্ফোরণ হতে থাকলো। অনেকে ছুটাছুটি করতে থাকলো। ফলে নিচে যে পড়লাম আর উঠতে পারছিলাম না। মনে হচ্ছিল, আমার জানটা বোধহয় মানুষের পায়ের চাপাতেই চলে যাবে। একটা পর্যায়ে আক্রমণ বন্ধ হলে ওঠার চেষ্টা করলাম। দেখলাম যে এখন আর উঠতে পারছি না। পায়ে স্যান্ডেলসহ অন্যান্য জিনিসপত্র নাই। সেখানে থাকা লোকজনকে বলতেছিলাম, আমাকে একটু ওঠান, হেল্প করেন প্লিজ। পরে কয়েকজন এসে আমাকে উদ্ধার করে আওয়ামী লীগের অফিসের নিচে যুবলীগের অফিসে নিয়ে যায়। সেখানেই আমি জ্ঞান হারালাম। পরিচিতরা ধরে মাইক্রোতে ওঠানোর চেষ্টা করছিলেন। তখন হুশ ফেরায় মাইক্রোতে করে কারা কোথায় নিয়ে যাবে, সে জন্য আর উঠলাম না। পরে কয়েকজনে মিলে ভ্যানগাড়িতে করে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যায়। সেখানে চিকিৎসা না হওয়ায় পিজি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানেও না হওয়ায় বারডেম হাসপাতালে নেওয়া হলো, প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে উত্তরার একটি হাসপাতালে নিয়ে চিকিৎসা দেওয়া হয়।’

গ্রেনেড হামলার পর সেখানকার পরিস্থিতি কেমন ছিল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘মাহিলা আওয়ামী লীগের নেত্রী-কর্মীরা বাটার দোকানের সামনে অবস্থান করছিলেন। হামলা হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সবাই ছিন্নভিন্ন হয়ে গেলো। যে যার মতো করে বাঁচার জন্য ছোটেন, কে কোথায় গেছেন বলা মুশকিল।’

চিকিৎসার বিষয়ে জানতে চাইলে নাজিম উদ্দিন বলেন, ‘কোমর থেকে নিচের অংশে পায়ের পাতা পর্যন্ত বেশি ইফেক্টেড হয়েছে। মনে হয় দক্ষিণ দিক থেকে হামলাটা করা হয়, ট্রাকের কারণে মাথাটা রক্ষা পেয়েছে। বুকের ডান পাশে ছোট একটা গ্রেনেড স্প্রিন্টার ঢুকেছিল, সেটি পরে বের হয়েছে। এ ছাড়া শতাধিক গ্রেনেড স্প্রিন্টার পরে শরীর থেকে বের করা হয়। ভারত ও ব্যাংককে চিকিৎসা নিলাম, কিছু স্প্রিন্টার বের করা হলো। উপরের দিকের স্প্রিন্টারগুলো অপারেশন করে বের করা হয়েছে। ভেতরেরগুলো রয়ে গেছে। সেনসিটিভ হওয়ায় বের করা হয়নি, সেগুলো সেভাবেই আছে শরীরে। সেগুলো নিয়েই চলছে জীবন, যন্ত্রণা বয়ে বেড়াচ্ছি। শরীরে স্প্রিন্টার রয়েছে, তা যথেষ্ট অনুভব করি। যেকোনও সময় এই স্প্রিন্টারগুলো কখন কী করে বসে!’

এদিকে একুশে আগস্টের হামলার সময় আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের ঢাকা বারের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন অ্যাডভোকেট কাজী শাহানারা ইয়াসমিন। বর্তমানে তিনি স্বোচ্ছাসেবক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সহসভাপতি ও সুপ্রিম কোর্টের ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল। তাকে ওই হামলার সময়ের পরিস্থিতি জানতে চাইলে একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলেন, ‘সেই বিভীষিকাময় পরিস্থিতি বলে বোঝানো যাবে না। বিভীষিকার কোনও বর্ণনা আছে? শুধু কষ্টেরই একটা অধ্যায়। ওই দিন সাহারা খাতুনের (সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী) নেতৃত্বে ঢাকা জজ কোর্ট থেকে পায়ে হেঁটে বঙ্গবন্ধু এভিনেউয়ের শান্তি মিছিলে এসেছিলাম আমরা। প্রচণ্ড রোদের মধ্যে আমরা দাঁড়িয়ে ছিলাম। তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে সমাবেশ হলে স্বেচ্ছাসেবক লীগের ছেলেপেলেরা ছাদের ওপরে থাকে। কিন্তু ওই দিন একটা কাকপক্ষীও ছিল না, এমনকি পুলিশও ছিল না। কেন ছিল না- এটা একটা প্রশ্ন। সবার শেষে আপা (শেখ হাসিনা) বক্তব্য দেন। বক্তব্য শেষে গোর্কি নামে একজন সাংবাদিক এসে বলেন, আপা আমি ছবি নিতে পারিনি। আপা একটু মুচকি হেসে আবার দাঁড়ালেন। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে অনেকগুলো ক্যামেরা ঝলসে উঠলো। ঠিক ওই সময়টায় হামলা হলো, বিস্ফোরণের আওয়াজ।’

ঘটনার সময়ের বিবরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘আমার এবং আইভি আপার (আইভি রহমান) মাঝখানে চার-পাঁচটা মেয়ে ছিল। আপা বসে পড়লেন আর মেয়েগুলো লুটিয়ে পড়লো। আপার পায়ের কাছ থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলি উপরের দিকে উঠছিল। কেউ কাটা জায়গায় স্যাভলন দিলে যেমন জ্বলে ওঠে, আমার ডান পায়ে তেমন জ্বলে উঠলো। চেষ্টা করলাম দৌড় দিতে কিন্তু পারলাম না। তখন চারদিকে আর্ত চিৎকার, কেউ বলছে বাবা গো, মাগো, মরে গেলাম, হাত ধরো… কেউ ছটফট করছে, কারও রক্ত বের হচ্ছে, কারও রক্ত অন্যের রক্তের সঙ্গে মিশে যাচ্ছে। সেই দৃশ্য কীভাবে বোঝাবো, জানি না। মরনের যন্ত্রণা, মরে যাচ্ছি, সেই সেন্সটা যখন মানুষের মধ্যে কাজ করে, তখন হিতাহিত জ্ঞান কতটা থাকে!’

একটানা বর্ণনা দিতে দিতেই থেমে গেলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল কাজী শাহানারা ইয়াসমিন। ভয়াবহ সেই স্মৃতিতে মগ্ন রইলেন কিছুক্ষণ। শুরু করলেন আবার, বললেন, ‘যেটুকু স্মরণে আছে, তাতে মনে পড়ে কেউ একজন আমাকে টানছে, আরও কয়েকজন মিলে আমাকে হাসপাতালে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তখন রক্ত বের হচ্ছে দেখে আমি আবার সেন্সলেস হয়ে যাই। তারা আমাকে ধরে বসানোর চেষ্টা করছিলেন। আমি স্থির থাকতে পারছিলাম না। কয়েকজনে ধরে চ্যাংদোলা করে আমাকে রাস্তায় নিয়ে গেলে আবার অজ্ঞান হয়ে যাই। তারপর একটা গাড়িতে করে ঢাকা মেডিক্যালে নিয়ে যাওয়া হয়। তখনও রক্ত ঝরছিল। সেখানে রক্ত ও সেলাইন লাগানো হয়। সেখান থেকে বের করে দিলে সিকদার মেডিক্যালে আনা হয়। তিনটা অপারেশ করে আমার। কয়েকদিন পরে অবস্থার অবনতি হলে সাহারা আপা আমাকে পাসপোর্ট নিয়ে আসতে বলেন। পাসপোর্ট রিনিউ করে আমাকে ভারতে পাঠিয়ে দেওয়া হয় টিকিৎসার জন্য। একটু সুস্থ হয়ে আবার ঢাকায় চলে আসি।’

সবশেষ অবস্থা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘শরীরে কতগুলো স্প্রিন্টার ঢুকেছে তা তো বলা যাবে না। সব প্রিন্টার বের করা সম্ভব হয়নি, এখনও রয়ে গেছে। কয়েক মাস আগে নতুন করে একটা জায়গায় এক্স-রে করালে ১৬টা প্রিন্টার আবিস্কার হয়েছে। পায়ের গোড়ালিতে হাড়ের সঙ্গে মিশে গেছে দুটি স্প্রিন্টার। হাঁটতে পারলেও কিছুক্ষণ পর পর মনে হয়, পড়ে যাচ্ছি। ফলে থেমে থেমে চলতে হয়। জীবন আর আগের মতো নেই, স্বাভাবিক জীবন ব্যাহত হচ্ছে।’

/ইউএস/
সম্পর্কিত
আল্লাহ রহমতের চাদর দিয়ে নেত্রীকে রক্ষা করেছেন: মতিয়া চৌধুরী
আইভি রহমানের প্রতি শ্রদ্ধাবিএনপির আন্দোলনে নেতাকর্মী আছে, জনগণ নেই: ওবায়দুল কাদের
২১ আগস্ট হত্যাকাণ্ড: তারেকের পৃষ্ঠপোষকতা মনে করিয়ে দিলেন জয়
সর্বশেষ খবর
এআইইউবিতে এনভায়রনমেন্টাল পিউরিফিকেশন সিস্টেম সেমিনার
এআইইউবিতে এনভায়রনমেন্টাল পিউরিফিকেশন সিস্টেম সেমিনার
অটোরিকশাচালকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ ১
অটোরিকশাচালকদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ ১
দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে সৌদি যুবরাজের সঙ্গে সুলিভানের বৈঠক
দ্বিপক্ষীয় নিরাপত্তা চুক্তি নিয়ে সৌদি যুবরাজের সঙ্গে সুলিভানের বৈঠক
স্পিকারদের আন্তর্জাতিক সভা শেষে দেশে ফিরলেন শিরীন শারমিন চৌধুরী
স্পিকারদের আন্তর্জাতিক সভা শেষে দেশে ফিরলেন শিরীন শারমিন চৌধুরী
সর্বাধিক পঠিত
মামুনুল হক ডিবিতে
মামুনুল হক ডিবিতে
‘নীরব’ থাকবেন মামুনুল, শাপলা চত্বরের ঘটনা বিশ্লেষণের সিদ্ধান্ত
‘নীরব’ থাকবেন মামুনুল, শাপলা চত্বরের ঘটনা বিশ্লেষণের সিদ্ধান্ত
ভারতীয় পেঁয়াজে রফতানি মূল্য নির্ধারণ, বিপাকে আমদানিকারকরা
ভারতীয় পেঁয়াজে রফতানি মূল্য নির্ধারণ, বিপাকে আমদানিকারকরা
হিমায়িত মাংস আমদানিতে নীতিমালা হচ্ছে
হিমায়িত মাংস আমদানিতে নীতিমালা হচ্ছে
মোবাইল আনতে ডিবি কার্যালয়ে মামুনুল হক
মোবাইল আনতে ডিবি কার্যালয়ে মামুনুল হক