আওয়ামী লীগ ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার নির্বাচনি ইশতেহার দিয়েছিল নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০০৮)। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০১৪) দলটির ইশতেহার ছিল ‘শান্তি গণতন্ত্র উন্নয়ন ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’। ‘সমৃদ্ধির অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশ’ নামে আওয়ামী লীগ নির্বাচনি ইশতেহার দেয় একাদশ সাধারণ নির্বাচনে (২০১৮)। এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে (২০২৩-২৪) দলটির ইশতেহার হচ্ছে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’। আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার তৈরির সঙ্গে যুক্ত নেতারা জানিয়েছেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’কে ‘স্মার্ট বাংলাদেশে‘ রূপান্তরের রূপরেখা থাকছে এবারের ইশতেহারে।
বিভিন্ন ক্ষেত্রে শব্দ, ভাষা ও প্রেক্ষিতে পরিবর্তন আনার পাশাপাশি ‘ডিজিটাল’কে ‘স্মার্ট’ সেবায় রূপান্তরের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে। বড় ধরনের কিছু মৌলিক পরিবর্তনও আসবে এই ইশতেহারে। তবে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত জানানোর সময় এখনও আসেনি।
আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়ন উপ-কমিটির প্রথম সভা অনুষ্ঠিত হয় বৃহস্পতিবার (২৮ সেপ্টেম্বর)। দলের নেতারা জানান, সেখানে অতীতের ইশতেহারগুলো সার্বিকভাবে পর্যালোচনা করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশের’ নতুন ইশতেহারে কী কী এবং কীভাবে থাকবে সেই বিষয়ে প্রাথমিক আলোচনা হয়। সে অনুযায়ী কমিটির সদস্যরা কাজ করবেন। পরবর্তী বৈঠকগুলোতে কাজের অগ্রগতি জানানোর পাশাপাশি বিভিন্ন বিষয় খসড়া তুলে ধরা হবে। পুরো ইশতেহারের খসড়া তৈরি হলে দলীয় সভাপতি শেখ হাসিনার কাছে পাঠানো হতে, তিনি চূড়ান্ত করবেন।
কী কী থাকছে আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনি ইশতেহারে—জানতে চাইলে দলটির দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতারা জানান, ২০০৮ সালের নির্বাচনে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ইশতেহার দেওয়া হয়েছিল, যা ছিল অতীতের ইশতেহারগুলোর থেকে একেবারেই ভিন্ন। তাতে খাতভিত্তিক ডিজিটালাইজেশনের রূপরেখা ছিল। এরপর ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেওয়া ইশতেহার দুটিতে মূলত ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণে উন্নয়ন ও অগ্রগতি তুলে ধরার পাশাপাশি খাতভিত্তিক আরও কী কী করা হবে, সেসব প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী, এবার ডিজিটাল বাংলাদেশের চূড়ান্ত পর্যায় হিসেবে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করা হবে। এতে সবক্ষেত্রে ডিজিটালাইজেশনের অগ্রগতি ও সুফল তুলে ধরার সঙ্গে স্মার্ট সেবা দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়া হবে। দলের জাতীয় সম্মেলন এবং ঘোষণাপত্রে সেই ধারণা দেওয়া হয়েছে। তবে কী কী থাকবে, তা উপ কমিটির বৈঠকগুলোতে পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত হবে।
দলীয় সূত্র জানায়, ২০২২ সালের ২৪ ডিসেম্বর টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগের ২২তম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। এতে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার স্লোগানকে সামনে আনা হয়। এরপর থেকে ডিজিটাল বাংলাদেশকে সর্বক্ষেত্রে স্মার্ট বাংলাদেশে রূপান্তরের কথা বলতে থাকেন এমপি-মন্ত্রীরা। আওয়ামী লীগের নেতারা তাদের বক্তৃতায় স্মার্ট বাংলাদেশের ধারণা প্রচার করছেন। এর মাধ্যমে জনগণকে স্মার্ট বাংলাদেশের পক্ষে নিয়ে আসা এবং জনমত নিজেদের পক্ষে নেওয়ার কাজ শুরু হয়েছে। নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণার মধ্য দিয়ে এই পরিকল্পনা পূর্ণতা পাবে।
আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক এবং নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়ন উপ-কমিটির সদস্য সচিব ড. সেলিম মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের এবারের নির্বাচনি ইশতেহারে স্মার্ট বাংলাদেশ তো থাকবেই। এখানে মূল লক্ষ্য হচ্ছে— খাতভিত্তিক যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে গত ১৫ বছরে, আগামী ৫ বছরে এই ধারাবাহিকতা রক্ষা করে অর্থনৈতিক উন্নয়নটাকে টেকসই করা। এর সুফল যাতে দেশের মানুষ পায় এবং বাংলাদেশকে একটা কল্যাণমূখী রাষ্ট্রে পরিণত করতে যা যা পদক্ষেপ দরকার, খাতভিত্তিক সেই পদক্ষেপগুলোর নেওয়ার ক্ষেত্রে অঙ্গীকার। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বাঙালির মুক্তির যে লক্ষ্য ছিল, আর্থ-সামাজিক, সাংস্কৃতিকসহ সব ক্ষেত্রে সেটি ধ্রুবতারা হিসেবে, চেতনা হিসেবে আমরা নিচ্ছি।
নির্বাচনি ইশতেহারের কয়েকটি লক্ষ্য থাকছে জানিয়ে তিনি বলেন, এর মধ্যে একটা হলো— ২০৪১ সালের লক্ষ্য। আরেকটা ১০০ বছরের পরিকল্পনা। আরও আছে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার প্রস্তুতি ইত্যাদি।
চলতি বছরের ১১ জানুয়ারি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জাতীয় সংসদে এক প্রশ্নের জবাবে বলেছেন, আওয়ামী লীগের ভিশন হচ্ছে—আবার সরকার গঠন করলে আমাদের লক্ষ্য হবে ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ে তোলা। স্মার্ট বাংলাদেশ হবে স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট অর্থনীতি, স্মার্ট সরকার এবং স্মার্ট সোসাইটির ওপর ভিত্তি করে। পাশাপাশি প্রতিটি গ্রামকে একটি শহরে রূপান্তর করা।
প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের ‘নির্বাচনি ইশতেহার-২০১৮: সমৃদ্ধির পথে বাংলাদেশ’ যা একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে জাতির সামনে পেশ করা হয়েছে। তাতে ‘২০৪১ সালের মধ্যে একটি সমৃদ্ধ ও উন্নত বাংলাদেশ’ গড়ার পরিকল্পনার রূপরেখা এবং ২১০০ সালের মধ্যে একটি ‘নিরাপদ ব-দ্বীপ’ গড়ে তোলার পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। উন্নত বাংলাদেশের যাত্রার প্রথম ধাপ হিসেবে দেশ ইতোমধ্যে স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশে পরিণত হয়েছে।
অতীতের ইশতেহারগুলোর সঙ্গে এবারের ইশতেহারের পার্থক্যের বিষয়ে সেলিম মাহমুদ বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, ২০১৮ সালে করোনা মহামারি কথা কেউ ভাবেনি। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের মতো কোনও যুদ্ধ হবে, সেটিও কারও ভাবনায় ছিল না। এই করোনা মহামারি, যুদ্ধ বৈশ্বিক মন্দা, অস্থিরতা ও স্থবিরতা তৈরি করেছে। এবারের ইশতেহারে অর্থনীতির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা থাকবে, আগামী কয়েকটি প্রজন্মের জন্য।
তিনি আরও বলেন, ২০০৮, ২০১৪ ও ২০১৮ সালের ইশতেহারের সঙ্গে ২০২৩-২৪ সালের ইশতেহারে ভিন্নতা যেমন থাকবে, তেমনি ধারাবাহিকতাও থাকবে। ২০০৮ সালে বাংলাদেশে তেমন কিছুই ছিল না, একেবারেই একটা অগোছালো রাষ্ট্র ছিল। ওই রাষ্ট্রকে সঠিক পথে আনার জন্য অর্থনৈতিক উন্নয়ন, শিল্পায়ন থেকে শুরু করে সব ক্ষেত্রে উন্নয়নের পথে নিয়ে গেছে আওয়ামী লীগ সরকার। ২০১৪ সালের সরকারের মেগা প্রজেক্টগুলো, উন্নয়নকে টেকসই করা, শিল্পায়নসহ বহুমুখী কাঠামোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে এবং সেগুলো সফল হয়েছে। ২০১৮ সালের ইশতেহারে গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর ওপর বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে, তারুণ্যের ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। ১০০ বছরের পরিকল্পনা, ডেল্টা প্লানসহ ২০৪১ সালের লক্ষ্য নির্ধারণসহ বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনা নেওয়া হয়। সেই ধারাবাহিকতা এবারের ইশতেহারেও ধাকবে। তবে নতুনত্ব হচ্ছে স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার প্রতিশ্রুতি।
আওয়ামী লীগের নেতারা জানিছেন, ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার প্রতিশ্রুতি দেশবাসীকে নতুন স্বপ্ন দেখিয়ে আওয়ামী লীগের নিরঙ্কুশ বিজয় নিয়ে দিয়েছিল। এবারের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার প্রতিশ্রুতিও একইভাবে বিজয়ের তীরে নিয়ে যাবে নৌকাকে। সময়ের চাহিদা অনুযায়ী, প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় জনমত দলটির পক্ষে অতীতে ছিল এবং আগামীতেও আসবে।
তারা বলছেন, আওয়ামী লীগের এবারের নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়নের কাজ চলছে, যার সিংহভাগ এরইমধ্যে গুছিয়ে আনা হয়েছে। আগামী মাসে (অক্টোবর) ইশতেহারের কাজ শেষ করার চিন্তা-ভাবনা রয়েছে আওয়ামী লীগের। ইশতেহার প্রস্তুত হলে সুবিধাজনক সময়ে তা প্রকাশ করা হবে। এবারের নির্বাচনি ইশতেহারে বিএনপি সরকারের সময়ের সঙ্গে খাতভিত্তিক আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন ও অগ্রগতি তুলে করা হবে। বিশেষ করে এই সরকারের তিন মেয়াদে মেগা প্রকল্পগুলো আগামীর ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়তে বিস্তারিত পরিকল্পনা থাকবে।
এ বিষয়ে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, আমাদের নির্বাচনি ইশতেহার তৈরির কাজ অনেকটা এগিয়েছে। দায়িত্বপ্রাপ্তরা খসড়া তৈরি করছেন, সেগুলো বিশেষজ্ঞদের কাছে মতামতের জন্য পাঠানো হচ্ছে। এটি নিয়ে আমাদের সাব কমিটি কাজ করছে। সুবিধা মতো সময়ে এবারের ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার ইশতেহার ঘোষণা করা হবে।
তিনি বলেন, বর্তমান সরকার ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার ইশতেহার ঘোষণা করে রাষ্ট্রক্ষমতায় এসেছে। তিনটি মেয়াদে সরকারের ধারাবাহিকতা অব্যাহত থাকায় এই প্রতিশ্রুতি পূরণ করা হয়েছে। এবার স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার ইশতেহার দেওয়া হবে। এতে নাগরিক তৈরির পাশাপাশি স্মার্ট অথনীতি, স্মার্টি শিক্ষা, স্মার্ট শিল্পনীতিসহ দেশবাসীর স্মার্ট সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।
আজ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন উপলক্ষে নবগঠিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়ন উপ-কমিটির প্রথম সভা শেষে দলটির সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় এলে দেশের গণতন্ত্র ধ্বংস হয়ে যাবে। এখন জুঁই ফুলের গান গেয়ে লাভ নেই। আমাদের এখন কঠিন সময়। তাই যেমন কুকুর তেমন মুগুর—ওই রকম ইশতেহার করুন।
সভায় সভাপতিত্ব করেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও নির্বাচনি ইশতেহার প্রণয়ন উপ-কমিটির আহ্বায়ক আব্দুর রাজ্জাক। তিনি বলেন, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করাকে এবার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ইশতেহারে গুরুত্ব দেওয়া হবে। বৈশ্বিক সমস্যার কারণে কঠিন সময় পার করছি। তাই আগামীতে কৃষি, সেবা ও শিল্পখাতসহ বিভিন্ন খাতে গুরুত্ব দেওয়া হবে।