X
সোমবার, ১৩ মে ২০২৪
৩০ বৈশাখ ১৪৩১

কঠিন সংগ্রাম পেরিয়ে ক্রিকেটের উষ্ণতায় মুশফিক

রবিউল ইসলাম
০২ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:১৫আপডেট : ০২ জানুয়ারি ২০২২, ১৭:১৫

বাবা-মা দুজনেই জীবিত, তারপরও মুশফিক হাসানের বড় হওয়া নানীর কাছে। অভাব-অনটনের সঙ্গে যুদ্ধে টিকে থাকার আশায় মুশফিকের বাবা হেলাল খান ও মা মোর্শেদা খাতুনকে আসতে হয় ঢাকায়। দুজনই ঢাকায় এক গার্মেন্টসে চাকরি করতেন। তাই তো মাত্র চতুর্থ শ্রেণিতে পড়তে বাবা-মায়ের আদর বঞ্চিত মুশফিকের সবকিছু জুড়েই তার নানী। এমন একটি সংসারে মুশফিকের ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখাটা রীতিমতো বাড়াবাড়িই। কিন্তু স্বপ্নটা মুশফিক দেখতে পেরেছিলেন নানীর কারণেই। কাতারে থাকা মামাও পাশে ছিলেন। নানী-মামার সহযোগিতায় শেষ পর্যন্ত আলো খুঁজে পান মুশফিক। এই পেসারের প্রতিভার ঝলক দারিদ্র্যে ঘেরা অন্ধকারে জ্বালিয়েছে আশার আলো।

ক্রিকেটে ভালো কিছু করতে পারবেন সেই আত্মবিশ্বাস মুশফিকের ছোট্টবেলা থেকেই ছিল। দারিদ্র্যতায় ক্রিকেট নিয়ে স্বপ্ন দেখতে ভয় পেতেন। মুশফিক তবু স্বপ্ন দেখার সাহস পেয়ে যান একদিন। এলাকার রাশেদ নামের এক বড় ভাই লালমনিরহাটে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটে খেলতে নিয়ে যান। ২০১৮ সালে প্রথমবার ক্রিকেট বলে খেলতে নেমেই বাজিমাত করেন মুশফিক। তার দুর্দান্ত বোলিং দেখে বিস্মিত বিভাগীয় কোচ বিপুল ফাতেমী নিকেল। এতই ভালো লাগে যে মুশফিকের মোবাইল নম্বরটিও তার মুঠোফোনে টুকে নেন।

কয়েক মাস পর বিভাগীয় ওই কোচের কাছ থেকে ফোন পান মুশফিক। কোচের ফোন পেয়ে রীতিমতো আত্মহারা মুশফিক! কিন্তু বাবা-মায়ের অনুমতি তো নিতে হবে। মুশফিক তার নানীকে বোঝান, তিনি ক্রিকেটার হবেন। নানী বরাবরই নাতির প্রতি আস্থাশীল ছিলেন। নানীর মাধ্যমে মুশফিক তার বাবা-মায়ের কাছ থেকে ক্রিকেটে নাম লেখানোর ‘লাইসেন্স’ পেয়ে চলে যান রংপুরে। ওখানে স্বাস্থ্য পরীক্ষার পর টিকে যান অনূর্ধ্ব-১৬ জেলা দলে। এরপর অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে হয়ে ওঠেন দায়িত্ববান একজন সন্তান। দিনবদলের খোঁজে ঢাকায় চলে যাওয়া বাবা-মাকে বাড়িতে ফিরিয়ে নিয়ে আসেন অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পাওয়ার পরপরই। স্বপ্ন দেখেন, বাংলাদেশের নাম উজ্জ্বল করার পাশাপাশি মা-বাবা-নানী-মামার নামও আলোকিত করবেন। সেই স্বপ্নের পেছনেই মুশফিকের ছুটে চলা।

আইসিসি অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে বাংলাদেশের ১৭ যোদ্ধাকে নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশিত হচ্ছে বাংলা ট্রিবিউনে। আজ (রবিবার) থাকছে পেসার মোহাম্মদ মুশফিক হাসানের একান্ত সাক্ষাৎকার-

বাংলা ট্রিবিউন: ক্রিকেটে শুরুটা কীভাবে?

মুশফিক: লালমনিহাটে (পাটগ্রাম, সাহেবডাঙা) আমি টেপ টেনিসে খুব জোরে বোলিং করতাম। ওখানে রাশেদ নামে আমার একজন বড় ভাই আছেন। তো রাশেদ ভাই, ২০১৮ সালের দিকে আমাকে লালমনিরহাটে দ্বিতীয় বিভাগ ক্রিকেটে নিয়ে গেলো। ওখানে আমি প্রথমবারের মতো ক্রিকেট বলে ম্যাচ খেলি। আমার বোলিংটাও ভালো হয়েছিল। ওখানে আমাদের রংপুর বিভাগের কোচ নিকেল স্যার (বিপুল ফাতেমী নিকেল) ছিলেন।  আমাকে দেখে বললেন, ‘তুমি অনেক ভালো বোলার হবা। দুই মাস পর বয়সভিত্তিক ক্রিকেটের মেডিক্যাল হবে, তুমি চলে এসো।’ আমার নম্বরও নিয়ে রাখলেন তিনি।

বাংলা ট্রিবিউন: রংপুর বিভাগের ওই কোচের কাছ থেকে ফোন পেয়েছিলেন?

মুশফিক: হুম, পেয়েছিলাম। একমাস পরই উনি আমাকে ফোন দিয়েছিলেন। আমি বাড়িতে ম্যানেজ করে রংপুর গেলাম। ওখানে মেডিক্যাল পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে অনূর্ধ্ব-১৬ দলে সুযোগ পেলাম। সুযোগ পাওয়ার পরও আমাকে এলাকার বড় ভাইরা বলেছিল, ‘তুই কিছু টাকা খরচ করে কোনও একাডেমিতে ভর্তি হয়ে যা।’ কিন্তু আমি কোথাও ভর্তি না হয়ে লালমনিরহাটে গিয়ে অনুশীলন শুরু করি। প্রায় একমাসের মতো পাটগ্রাম টু লালমনিরহাট ট্রেনে যাতায়াত করেছি। আসতে যেতে ছয় ঘণ্টা চলে যেত। আমার অনেক পরিশ্রম হতো। এরপর আমি ২০১৯ সালে ঢাকায় ক্রিকেট কোচিং স্কুল (সিসিএস) ভর্তি হই। ওখানে স্যাররা আমাকে পছন্দ করলেন। কিছুদিন অনুশীলন করে আমি জেলার হয়ে অনূর্ধ্ব-১৬ খেলতে চলে আসি। ওখানে ভালো খেলে আমি প্রমোশন পেয়ে যাই।

কঠিন সংগ্রাম পেরিয়ে ক্রিকেটের উষ্ণতায় মুশফিক বাংলা ট্রিবিউন: কী সেই প্রমোশন?

মুশফিক: পাবনাতে অনুষ্ঠিত ওই খেলাতে বিসিবির কোচ ছিলেন। জেলা থেকে খেলে আমি অনূর্ধ্ব-১৬ বিভাগীয় দলে সুযোগ পেয়ে যাই। প্রথমে ৪০, তারপর ২৪, তারপর আমি ১৫ জনের দলে সুযোগ পাই। শান্ত স্যার (হাসিবুল হোসেন শান্ত) আমার বোলিং খুব পছন্দ করেন। ২০১৯ সালে পাকিস্তান অনূর্ধ্ব-১৮ দল বাংলাদেশে আসবে। তাদের সঙ্গে বিকেএসপিতে খেলার প্রস্তুতি নিচ্ছিল আমাদের অনূর্ধ্ব-১৯, বর্তমান দলের আইচ মোল্লা, রবিনসহ (মাহফিজুল ইসলাম) অনেকে। শান্ত স্যার আমাকে তাদের সঙ্গে বিকেএসপিতে ক্যাম্প করতে পাঠিয়ে দিলেন। ওখানে ১০ দিনের ক্যাম্প করে আমি টিকে গেলাম। যেখানে আমার অনূর্ধ্ব-১৬ খেলার কথা ছিল, সেখানে আমি খেলে ফেললাম অনূর্ধ্ব-১৮!

পাকিস্তানের বিপক্ষে প্রথম ইনিংসে আমি ৪ উইকেট পেয়েছিলাম, দ্বিতীয় ইনিংসে পেয়েছিলাম ২ উইকেট। মাঝে অবশ্য অনূর্ধ্ব-১৭ দলের হয়ে পাকিস্তান সফরেও গিয়েছিলাম। ওখান থেকে ফিরে কক্সাবাজারে বিভাগীয় দলের হয়ে খেলে ৪ ম্যাচে (লংগার ভার্সন) পেলাম ২২ উইকেট। এরপর আমার ডাক পড়ে ওয়াইসিএলে। ওখানে  তিন ম্যাচে ১৮ উইকেট পাওয়ার পর অনূর্ধ্ব-১৯ দলের ৪০ জনের প্রাথমিক ক্যাম্পে ডাক পড়ে।

বাংলা ট্রিবিউন: শুনেছি, আপনাকে লালমনিরহাটে রেখেই আপনার বাবা-মা ঢাকায় চলে গিয়েছিলেন?

মুশফিক: আমার বাবা-মা কিছুদিন আগেও ঢাকায় ছিল। তারা গার্মেন্টসে চাকরি করতো। আমাদের আর্থিক সমস্যার কারণেই দুজন ঢাকায় এসে রোজগার করা শুরু করে। আমরা দুই ভাই-বোন আমাদের নানুর কাছেই মানুষ হয়েছি। আমি তখন ক্লাস ফোরে পড়ি। আমার বোন তো তখন আরও ছোট। আমি নানুকে ক্রিকেট নিয়ে বোঝাতাম। নানু আবার আম্মাকে বোঝাতো, মুশফিক পড়াশোনা ঠিকমতো করছে। আমার ক্রিকেটার হয়ে ওঠার পেছনে আমার নানীর অবদান অনেক। আমি যখন অনূর্ধ্ব-১৯ দলে সুযোগ পেলাম। টাকা-পয়সা কিছু রোজগার করলাম। তখন আব্বা-আম্মাকে বাসায় নিয়ে আসি।

বাংলা ট্রিবিউন: কঠিন এই সময়টাতে নিজেকে অনুপ্রাণিত করেছেন কীভাবে?

মুশফিক: আমার আত্মবিশ্বাস ছিল আমি পারবো। আমার এলাকার বড় ভাইরা আমাকে অনেক বেশি অনুপ্রেরণা দিয়েছিলেন। গ্রামের মানুষ তো, বাবা-মা ওভাবে কিছু বুঝতো না। তারা বলতো, খেলে কী হবে, পড়াশোনা করো। ক্রিকেট বড়লোকের ছেলেরা খেলে। আমাদের মতো গরিবদের ক্রিকেট খেলে কিছু হবে না। তবু আমি সাহসী ছিলাম। আসলে আমার নানীই আমার সাহস বাড়িয়ে দিয়েছিল। বাবা-মা এতকিছু বলার পরও আমি উনাদের বলতাম, ইনশাআল্লাহ আমি পারবো, আমাকে একটু সুযোগ দিও। এছাড়া আমার মামা থাকেন কাতারে। উনি আমাকে সর্বোচ্চ সাহায্য করেছেন। এখনও আমাকে আর্থিকভাবে সাপোর্ট দিয়ে যাচ্ছেন।

বাংলা ট্রিবিউন: বাবা-মা, নানী কিংবা মামার ঋণ শোধের একটা তাড়না তো আছে নিশ্চয়?

মুশফিক: আমার দ্বারা যেন আমার পরিবারকে সবাই চেনে। আমি এমন কিছু করতে চাই আমার মা-বাবার মুখ যেন উজ্জ্বল হয়। জাতীয় দলে যেন খেলতে পারি। আমার বাবা-মায়ের আর্থিক কষ্ট যেন দূর করতে পারি।

বাংলা ট্রিবিউন: আপনি তো স্কুল ক্রিকেট খেলেছেন। সেখানকার পারফরম্যান্স কী?

মুশফিক: স্কুল ক্রিকেটেও আমি ভালো করি। মূলত এই কারণেই অনূর্ধ্ব-১৬তে সুযোগ পেয়ে যাই। লালমনিরহাট গভ. হাই স্কুল থেকে ২০১৯ আমি স্কুল ক্রিকেটে অংশ নেই। আমার স্কুল বিভাগে গিয়ে সেমিফাইনালে হেরে গিয়েছিল। আমি ৩ ম্যাচে ১২ উইকেট পেয়েছিলাম।

বাংলা ট্রিবিউন: ওয়েস্ট ইন্ডিজের কঠিন কন্ডিশনে খেলতে হবে, কতটা রোমাঞ্চিত?

মুশফিক: ওখানে ঘাসের উইকেটে খেলা হবে। সাধারণত পেস বোলাররা অনেক সাহায্য পেয়ে থাকে। ঠিক জায়গায় বোলিং করতে পারলে ভালো মুভমেন্ট পাওয়া যাবে। আশা করি, আমি উইকেটের সুবিধা কাজে লাগিয়ে ভালো করতে পারবো।

বাংলা ট্রিবিউন: খুব বেশি ম্যাচ খেলার সুযোগ হয়নি আপনার। প্রস্তুতিতে কি ঘাটতি থেকে গেলো না?

মুশফিক: টিম কম্বিনেশনের কারণে আমি হয়তো খেলতে পারছি না। তবে অনুশীলনে আমি নিজের প্রস্তুতিটা ঠিক মতোই নিচ্ছি। আশা করি, কোনও সমস্যা হবে না। যখনই সুযোগ পাবো নিজের সেরাটা দেওয়ার চেষ্টা করবো।

কঠিন সংগ্রাম পেরিয়ে ক্রিকেটের উষ্ণতায় মুশফিক বাংলা ট্রিবিউন: ব্যাটিংয়েও তো বেশ আগ্রহ আছে আপনার?

মুশফিক: আমি স্লগ ওভারে ভালো ব্যাটিং করতে পারি। সেভাবেই আসলে প্রস্তুতি নিয়েছি। আমার ফিল্ডিংটাও ভালো। যেকোনও পজিশনেই আমার ফিল্ডিংটা অনেক ভালো। বিশ্বকাপে আমি ভালো ফিল্ডিং করে নজরে আসতে চাই।

প্রোফাইল

পুরো নাম: মোহাম্মদ মুশফিক হাসান

ডাক নাম: মুশফিক

জন্ম: ১৬ সেপ্টেম্বর ২০০২

জন্মস্থান: পাটগ্রাম, লালমনিরহাট

বাবা: হেলাল খান

মা: মোর্শেদা খাতুন

উচ্চতা: ৬ ফুট ১ ইঞ্চি

পড়াশোনা: এইচএসসি পরীক্ষার্থী

প্রথম ক্লাব: ক্রিকেট কোচিং স্কুল (সিসিএস) 

বর্তমান ক্লাব: অগ্রণী ব্যাংক ক্রিকেটে ক্লাব

বোলিং স্টাইল: ডানহাতি পেসার

প্রিয় ডেলিভারি: বাউন্সার ও ইয়র্কার

প্রিয় মানুষ: নানী

প্রিয় ক্রিকেটার: কাগিসো রাবাদা

ক্যারিয়ারের সেরা মুহূর্ত: স্কুল ক্রিকেটে পাওয়া ৭ উইকেট

/কেআর/
সম্পর্কিত
সর্বশেষ খবর
৫৫ কেজি স্বর্ণ চুরি: মামলার প্রতিবেদন ফের পেছালো
৫৫ কেজি স্বর্ণ চুরি: মামলার প্রতিবেদন ফের পেছালো
যেভাবে বরণ করা হবে এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিককে
যেভাবে বরণ করা হবে এমভি আবদুল্লাহর ২৩ নাবিককে
তীব্র গরমে চলছে লোকসভা নির্বাচনের চতুর্থ ধাপের ভোট
তীব্র গরমে চলছে লোকসভা নির্বাচনের চতুর্থ ধাপের ভোট
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় ভাতিজার সঙ্গে ‘সম্পর্ক ছিন্ন’ করলেন সালাম মুর্শেদী
নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ায় ভাতিজার সঙ্গে ‘সম্পর্ক ছিন্ন’ করলেন সালাম মুর্শেদী
সর্বাধিক পঠিত
পাস করা ছাত্রছাত্রীদের ডিপ্লোমায় ভর্তির আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর
পাস করা ছাত্রছাত্রীদের ডিপ্লোমায় ভর্তির আহ্বান শিক্ষামন্ত্রীর
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে সুপারিশ আর কার্যকর নেই: শিক্ষামন্ত্রী
চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা নিয়ে সুপারিশ আর কার্যকর নেই: শিক্ষামন্ত্রী
বোন রেহানাকে নিয়ে নিক্সন চৌধুরীর বাসায় শেখ হাসিনা
বোন রেহানাকে নিয়ে নিক্সন চৌধুরীর বাসায় শেখ হাসিনা
রাজধানীতে ব্যবসায়ী দম্পতির বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
রাজধানীতে ব্যবসায়ী দম্পতির বিরুদ্ধে দুদকের মামলা
ঈদের পর শনিবার স্কুল খোলা থাকছে না
ঈদের পর শনিবার স্কুল খোলা থাকছে না