X
শুক্রবার, ০৯ মে ২০২৫
২৬ বৈশাখ ১৪৩২
ফ্যাক্ট চেকিং দিবস

দেখামাত্রই ক্লিক নয়, যাচাই ছাড়া শেয়ার নয়

জুবায়ের আহমেদ
০২ এপ্রিল ২০২৩, ২০:০০আপডেট : ০২ এপ্রিল ২০২৩, ২০:৩৩

দেশের একটি পরিচিত রেস্টুরেন্টের খাবারের মান নিয়ে সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে একটি পোস্ট ছড়িয়ে পড়ে। সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারী অনেকে তা বিশ্বাস করেন এবং বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন হন। ফলে সুনাম ক্ষুণ্ন হওয়ার পাশাপাশি আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয় প্রতিষ্ঠানটি। পরবর্তী সময়ে নানা যুক্তি এবং জবাবদিহির মধ্য দিয়ে রেস্টুরেন্টটিকে তাদের খাবারের মান প্রমাণ করতে হয়েছে।

বর্তমানে ডিজিটাল যুগে এরকম বিভিন্ন তথ্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দ্রুত এবং সহজে ছড়িয়ে পড়ে। তবে এর মাঝে সব তথ্য সঠিক বা বিশ্বাসযোগ্য নয়। অনেক ক্ষেত্রেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যবহারকারীরা এসব তথ্যকে সঠিক মনে করে গুজবের শিকার হন। কেননা, তথ্যের নির্ভুলতা যাচাই করার সক্ষমতা বা সময় অনেক সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর থাকে না। এক্ষেত্রে সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা পরামর্শ দেন, অনলাইনে কোনও তথ্য দেখামাত্রই ক্লিক নয়, যাচাই ছাড়া শেয়ার নয়।

সম্প্রতি, এমন অসংখ্য ঘটনা ঘটেছে, যেখানে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম, নিউজ আউটলেট এবং অন্যান্য উৎসের মাধ্যমে ভুল তথ্য বা সরাসরি মিথ্যা প্রচার করা হয়েছে। কিছু ক্ষেত্রে এই ভুল তথ্যটি সাম্প্রদায়িক সংঘাত, রাজনৈতিক অস্থিরতা সৃষ্টি করে। আবার এসব তথ্য নিয়ে সামাজিক মাধ্যম ব্যবহারকারীদের মাঝে নানা বিষয়ে বিভ্রান্তি, মতবিরোধ, বাদানুবাদ দেখা দেয়। সেক্ষেত্রে ভুল তথ্য এবং বিভ্রান্তি মোকাবিলায় ফ্যাক্ট চেকিং (তথ্য-পরীক্ষা) একটি ক্রমবর্ধমান গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার হয়ে উঠেছে।

ফ্যাক্ট চেকিং কী?

ফ্যাক্ট চেকিং হলো সংবাদমাধ্যম বা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া কোনও বিভ্রান্তিকর তথ্যের যথার্থতা যাচাই করার প্রক্রিয়া। এই প্রক্রিয়ায় চিহ্নিত তথ্যটি পুঙ্খানুপুঙ্খ বিশ্লেষণ করা হয়, তথ্যের উৎস পরীক্ষাসহ সংশ্লিষ্ট বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রকৃত তথ্য প্রকাশের মাধ্যমে ঘটনাটি পরিষ্কার করা হয়।

ফ্যাক্ট চেকিং কেন গুরুত্বপূর্ণ?

মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে মারাত্মক পরিণতি হতে পারে। যেমন আতঙ্ক ছড়ানো, জনমতকে প্রভাবিত করা এবং এমনকি জীবন বিপন্ন করা। উদাহরণস্বরূপ, কোভিড মহামারি চলাকালে ভাইরাস এবং এর চিকিৎসা সম্পর্কে ভুল তথ্য দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে, যা জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থায় বিভ্রান্তি এবং অবিশ্বাস ছড়ায়। তাই দ্রুত সময়ের মধ্যে ফ্যাক্ট চেকিংয়ের মাধ্যমে সত্যটা প্রকাশ করলে সমাজে অনেক অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা থেকে রক্ষা পাওয়া সম্ভব।

কীভাবে ফ্যাক্ট চেক করবেন

একজন সাধারণ ইন্টারনেট ব্যবহারকারী চাইলে নিজ থেকেই ফ্যাক্ট চেক করতে পারেন। এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞরা বলেন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ভেসে আসা সব তথ্যকেই তাৎক্ষণিক বিশ্বাস না করে সচেতনতা অবলম্বন করলে অনেকাংশে গুজব বা ভুল তথ্য থেকে দূরে থাকা যায়।

বর্তমানে ফ্যাক্ট চেক করার জন্য নানা ওয়েবসাইট রয়েছে। তবে নিজের থেকে তথ্য যাচাই করতে কয়েকটি বিষয় খেয়াল করার পরামর্শ দেন বিশেষজ্ঞরা। এই ক্ষেত্রে কোনও তথ্য সন্দেহজনক মনে হলে ওই তথ্য যে উৎস থেকে এসেছে, সেই উৎসের বিশ্বস্ততা যাচাই করতে হবে। একাধিক উৎসের সঙ্গে তথ্য ক্রসচেক করতে হবে। এটি যাচাইয়ে অনলাইনে একাধিক টুল রয়েছে। এছাড়া উক্ত ক্ষেত্রের বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে পরামর্শ করা যায়।

ফ্যাক্ট চেকিং টুলস

অনলাইনে তথ্য যাচাইয়ের নানা পদ্ধতি ও ওয়েবসাইট রয়েছে। তার মধ্যে জনপ্রিয় কয়েকটি টুল হলো -

TinEye: এই টুলটি অনলাইনে ছড়িয়ে পড়া ছবি যাচাই করার একটি দ্রুত উপায়। টুলটি মূলত একটি স্বতন্ত্র রিভার্স ইমেজ সার্চ ইঞ্জিন যা একাধিক সূত্র প্রকাশের মাধ্যমে কোনও ছবির আসল উৎস খুঁজে বের করে। ফলে সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারকারীরা সহজে সন্দেহমূলক কোনও ছবির সত্য উদঘাটন করতে পারে।

InVID: অনলাইনে লিখিত তথ্যের পাশাপাশি ছবি ও ভিডিও আকারেও মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পড়ে। এক্ষেত্রে InVID ব্যবহারের মাধ্যমে ভুয়া ভিডিওটির আসল উৎস এবং কোথায় কোথায় এই ভিডিও ব্যবহার হয়েছে তার একটি তথ্য পাওয়া যায়৷ InVID হলো একটি Chrome প্লাগইন টুল। এটাকে গুগল ব্রাউজারের সঙ্গে সংযুক্ত করে ব্যবহার করতে হয়।

twXplorer: এই টুলটি মূলত টুইটারের বিভিন্ন তথ্য যাচাই-বাছাইয়ে ব্যবহৃত হয়। টুইটারে লিখত তথ্য, বিভিন্ন সংবাদ লিংকসহ নানা বিষয়ে এর মূল সূত্র ও অন্যান্য বিস্তারিত twXplorer ব্যবহারের মাধ্যমে সহজে যাচাই করা যায়।

Rumor Scanner: এটি বাংলাদেশি সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারকারীদের জন্য সঠিক তথ্য যাচাইয়ে একটি বড় সহায়ক। বাংলাদেশের অনলাইনে ছড়ি পড়া নানা আলোচিত সংবাদ, ছবি বা ভিডিও যাচাই করে সত্য প্রকাশ করাই হলো Rumor Scanner-এর কাজ। এই ওয়েবসাইটটি ইন্টারন্যাশনাল ফ্যাক্ট চেকিং নেটওয়ার্ক (IFCN) অনুমোদিত একটি ফ্যাক্ট চেকিং সংস্থা।

এসব ছাড়াও আরও অনেক উপায় রয়েছে ফ্যাক্ট চেকিংয়ের। যার বিষয়ে অনলাইনে বিস্তারিত তথ্য উল্লেখ করা আছে। তবে সঠিক টুল ব্যবহারেও ব্যবহারকারীদের সচেতন হতে হবে।

অনলাইনে তথ্য শেয়ারে সতর্কতা

অনলাইন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কোনও তথ্য প্রচার করার আগে সেই তথ্যের যথার্থতা যাচাই করার পরামর্শ দিয়েছেন সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞরা। তারা বলেন, জনপ্রিয় ও অধিক প্রচারিত সূত্র বা সংস্থা থেকে তথ্য প্রকাশের ক্ষেত্রে অনেক ধরনের সত্যতা যাচাইসহ সতর্কতা অবলম্বন করে। কেননা, তাদের জবাবদিহি রয়েছে। অন্যদিকে বিভিন্ন ব্যক্তি বা কম পরিচিত সূত্র থেকে প্রকাশিত তথ্যে অসত্য বিষয় থাকার সম্ভাবনা অধিক থাকে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এসব অজনপ্রিয় সূত্র বা ব্যক্তি/গোষ্ঠী বিশেষ উদ্দেশ্য হাসিলের স্বার্থে নানা ধরনের মিথ্যা ও মানুষের আবেগকে আকৃষ্ট করে এমন ধরনের তথ্য প্রকাশ করে। তাদের বিশেষ উদ্দেশ্যের মাঝে থাকে নিজের সামাজিকমাধ্যম পেইজের ফলোয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি বা দেশে রাজনৈতিক ও সামাজিক অস্তিত্বশীলতা তৈরি করা।

এ বিষয়ে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন সভাপতি ও সাইবার নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ কাজী মুস্তাফিজ বলেন, আমরা যখন ইন্টারনেটে বিভিন্ন তথ্য শেয়ার করছি সে জায়গায় অনেক বেশি দায়িত্বশীল হওয়া প্রয়োজন। দেখা যায়, অনেকে সামাজিকমাধ্যম ব্যবহারকারী তার পরিচিতজনের কোনও পোস্ট সত্য ও সমাজের জন্য উপকারী মনে করে অনলাইনে শেয়ার করেছেন। এখন দেখা যায়, যে পোস্টটি শেয়ার করা হয়েছে তা সমাজের জন্য ভয়ংকর একটা পরিস্থিতি তৈরি করেছে, সেটি যেকোনও বিষয়ে হতে পারে, সেটি কোনও ব্যক্তিকেন্দ্রিক, কোনও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক বা রাজনৈতিক ও রাষ্ট্রকেন্দ্রিকও হতে পারে। তাই আমরা বলি, দেখামাত্রই ক্লিক নয়, যাচাই ছাড়া শেয়ার নয়। এক্ষেত্রে কোনও পোস্ট শেয়ার করার আগে পোস্ট করা ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করা যে তিনি যা পোস্ট করেছেন তার সত্যতার বিষয়ে তিনি নিজে নিশ্চিত কিনা। এছাড়া অনলাইনে অন্যান্য মাধ্যমে আসা তথ্য যাচাই করার ক্ষেত্রে ফ্যাক্ট চেকিং টুলস ব্যবহার করা, যদি তিনি এই বিষয়ে দক্ষ হন। আর সাধারণ ব্যবহারকারীর মাঝে বিভ্রান্তিকর তথ্য যেন শেয়ার না করা হয়, এই বিষয়ে সচেতনতা বাড়াতে হবে।

অনলাইনে মিথ্যা তথ্য প্রচারে রয়েছে ঝুঁকি

সাইবার বিশেষজ্ঞ কাজী মুস্তাফিজ বলেন, অনলাইনে বুঝে কিংবা না বুঝে মিথ্যা তথ্য প্রচারের মাধ্যমে সমাজে বা রাষ্ট্রে কোনও ধরনের বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করলে দেশে বিদ্যমান ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মাধ্যমে তাকে শাস্তির আওতায় আনা হয়। কেননা, মিথ্যা তথ্য প্রচারের মাধ্যমে দেশে সাম্প্রদায়িক সংঘাত, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতা সৃষ্টিসহ ব্যক্তিগত শত্রুতা তৈরি হয়। তাই যেকোনও সন্দেহমূলক, সাম্প্রদায়িক তথ্য শেয়ার করার আগে ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের মাধ্যমে তা যাচাই করে নেওয়া উচিত।

এখনকার তথ্য যুগে নির্ভুলতা এবং জবাবদিহির জন্য ফ্যাক্ট চেকিং একটি অপরিহার্য হাতিয়ার। ভুল তথ্যের বিস্তার একটি চ্যালেঞ্জ হিসেবে অব্যাহত থাকায় ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের গুরুত্ব কেবল বাড়তেই থাকবে। তার ওপর ফ্যাক্ট-চেকিং কেবল রাজনৈতিক সংবাদ বা বর্তমান ঘটনার মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি অন্যান্য ক্ষেত্রেও গুরুত্বপূর্ণ, যেমন- বিজ্ঞান, স্বাস্থ্য এবং ভোক্তা পণ্য ইত্যাদি বিষয়েও সঠিক তথ্যটি ফ্যাক্ট-চেকিংয়ের মাধ্যমে উঠে আসে।

/এফএস/এমওএফ/
সম্পর্কিত
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ফেসবুক পেজ হ্যাকড
বদলির পর ফেসবুকে ওসি লিখলেন,‌ ‘বুজলে বুজ, না বুজলে খেয়ে নে তরমুজ’
হেলিকপ্টারে মাগুরা যাওয়ার সমালোচনায় ‘ঘরে বসে অ‍্যানালাইসিস কপচানো’ নিয়ে পাল্টা সমালোচনা সারজিসের
সর্বশেষ খবর
সরকার আ.লীগ নিষিদ্ধ করার দাবি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে: প্রেস উইং
সরকার আ.লীগ নিষিদ্ধ করার দাবি গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে: প্রেস উইং
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সমাবেশ শুরু
আওয়ামী লীগ নিষিদ্ধের দাবিতে সমাবেশ শুরু
আগুনে পুড়ে গেছে রাজবাড়ীর এক ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টার
আগুনে পুড়ে গেছে রাজবাড়ীর এক ইউনিয়ন পরিষদের ডিজিটাল সেন্টার
বায়তুল মোকাররম থেকে যমুনার পথে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা
বায়তুল মোকাররম থেকে যমুনার পথে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীরা
সর্বাধিক পঠিত
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
জার্সি পরেই যমুনার সামনে দায়িত্বে রমনার ডিসি মাসুদ আলম
‘সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগে জড়িতদের শাস্তি দিতে না পারলে আমি চলে যাবো’
‘সাবেক রাষ্ট্রপতির দেশত্যাগে জড়িতদের শাস্তি দিতে না পারলে আমি চলে যাবো’
নৌ পুলিশের অভিযানে ২৭৬ জন গ্রেফতার, ১০ মরদেহ উদ্ধার
নৌ পুলিশের অভিযানে ২৭৬ জন গ্রেফতার, ১০ মরদেহ উদ্ধার
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন স্নিগ্ধ
জুলাই শহীদ স্মৃতি ফাউন্ডেশন থেকে পদত্যাগ করলেন স্নিগ্ধ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে ৫৬ জনের পদত্যাগ, তুলেছেন দুর্নীতির অভিযোগ
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন থেকে ৫৬ জনের পদত্যাগ, তুলেছেন দুর্নীতির অভিযোগ