X
মঙ্গলবার, ৩০ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

আরব বিশ্বের ‘ভারত বয়কট’ আন্দোলন

আনিস আলমগীর
০৭ জুন ২০২২, ১৫:৩৭আপডেট : ০৭ জুন ২০২২, ১৬:৪৮

ভারতের ভাইস প্রেসিডেন্ট বেঙ্কাইয়া নায়ডু রাষ্ট্রীয় সফরে গিয়েছিলেন কাতার। তিনি থাকাকালেই ৫ জুন ২০২২ কাতার সরকার ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ভারতের ক্ষমতাসীন হিন্দু মৌলবাদী দল বিজেপির দু’জন নেতার ইসলামের শেষ নবী হজরত মোহাম্মদ (সা.) সম্পর্কে কটূক্তির কড়া প্রতিবাদ হাতে ধরিয়ে দেয়। ওই চিঠিতে বলা হয়, ‘ভারত সরকারের কাছ থেকে এই মন্তব্যগুলোর জন্য জনসাধারণের কাছে ক্ষমা চাওয়ার এবং অবিলম্বে নিন্দা প্রত্যাশা করছে কাতার। এই ধরনের ইসলামোফোবিক মন্তব্যকে শাস্তি ছাড়া চলতে দেওয়া, মানবাধিকার সুরক্ষার জন্য মারাত্মক বিপদ সৃষ্টি করে এবং আরও কুসংস্কার এবং কোণঠাসা করার দিকে নিয়ে যেতে পারে, যা সহিংসতা এবং ঘৃণার একটি চক্র তৈরি করবে।’

এখানেই থেমে থাকেনি কাতার। কাতারের সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী ললওয়াহ আলখাতে টুইট করে বলেছেন, ‘দীর্ঘদিন ধরে বৈচিত্র্য ও সহাবস্থানের জন্য পরিচিত একটি দেশে ইসলামোফোবিক আলোচনা বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। আনুষ্ঠানিকভাবে এবং পদ্ধতিগতভাবে মুখোমুখি না হলে, ভারতে ইসলামকে লক্ষ্য করে পদ্ধতিগত বিদ্বেষমূলক বক্তব্য ২০০ কোটি মুসলমানের বিরুদ্ধে ইচ্ছাকৃত অপমান হিসেবে বিবেচিত হবে।’

কাতারের পর কুয়েত ও ইরান ভারতীয় রাষ্ট্রদূতকে তলব করে কঠিন প্রতিবাদ জানায়। সৌদি আরব এবং ওমানও কঠোর ভাষায় নিন্দা জানায়। এই নিয়ে ক্ষোভ এত তীব্র হতে থাকে যে আরবজুড়ে শুরু হয় ভারতীয় পণ্য বয়কট আন্দোলন। #boycottindia এবং #boycottindiangoods হ্যাশট্যাগ সোশাল মিডিয়ায় আরব দেশগুলোতে শীর্ষে চলে আসে।

মহানবী (সা.) নিয়ে কটূক্তির ঘটনায় জেদ্দাভিত্তিক ইসলামি সহযোগিতা সংস্থা-ওআইসি বলেছে যে ‘এই মন্তব্য ভারতে ইসলামের প্রতি ঘৃণা ও অপব্যবহারকে তীব্রতর করার প্রেক্ষাপটে এবং মুসলমানদের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক চর্চা।’

ওমানের গ্র্যান্ড মুফতি ইসলামের প্রতি মোদির দলের ‘অশ্লীল অসভ্যতা’কে ‘যুদ্ধ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন। মিসরের আল-আজহার মসজিদ, সুন্নি বিশ্বের ধর্মীয় শিক্ষার প্রধান প্রতিষ্ঠান, এই মন্তব্যকে ‘প্রকৃত সন্ত্রাসবাদ (যা) সমগ্র বিশ্বকে মারাত্মক সংকট এবং মারাত্মক যুদ্ধে নিমজ্জিত করতে পারে’ বলে বর্ণনা করেছে।

ভারতের জন্য মুসলিম বিশ্বের এই প্রতিক্রিয়া বড় ধরনের কূটনৈতিক আঘাত। কারণ, দীর্ঘদিন ধরে ভারত মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর সঙ্গে এই সম্পর্ককে গুরুত্ব দিয়ে আসছিল। এই সম্পর্ক ভারতের জন্য কৌশলগত এবং বাণিজ্যিকভাবেও গুরুত্বপূর্ণ। বিশেষ করে সৌদি আরব, ইউএই, ইরান, কাতার সবার সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির চলতি বছরের প্রথম সফরও ছিল ইউএই এবং কুয়েত দিয়ে।

ভারতের জন্য মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, সরকারি হিসাবে ওইসব দেশে ৬৫ লক্ষ ভারতীয় কাজ করে। কাতার লিকুইফাইড ন্যাচারাল গ্যাস অথবা এলএনজি সাপ্লাই দিয়ে আসছে ভারতকে, যা তার মোট গ্যাসের ৪০ শতাংশ। ভারতের রয়েছে দেশগুলোর সঙ্গে গভীর বাণিজ্যিক সম্পর্ক। গালফ অপারেশন কাউন্সিল বা জিসিসি সদস্যদের সঙ্গে ২০২০-২০২১ বছরে ওইসব দেশের সঙ্গে ভারতের দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্য ছিল ৮৭ বিলিয়ন, যার মধ্যে ৬০ বিলিয়ন আমদানি। এর আগের বছরের তুলনায় এই বাণিজ্য ২৭ শতাংশ বেশি। এখন সংখ্যালঘু নির্যাতন প্রশ্নে ভারতকে পিছু হটতে হবে।

সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের অভিযোগ ভারতের বিরুদ্ধে ২০১৪ সাল থেকে যখন নরেন্দ্র মোদি প্রধানমন্ত্রী হন এবং বিজেপি ক্ষমতায় আসে। অভিযোগ এখন এমনই আন্তর্জাতিক ইস্যু হয়েছে যে মাত্র গত সপ্তাহে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি জে ব্লিংকেন স্বয়ং ধর্মীয় স্বাধীনতা বিষয়ক মার্কিন বার্ষিক রিপোর্ট পেশ করেন ভারতকে অভিযুক্ত করে। নিকট অতীতে কোনও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে এই ভূমিকায় দেখা যায়নি। শুধু তাই নয়, কয়েক মাস আগেও মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ভারতের বিরুদ্ধে এমন অভিযোগ আনেন ভারতীয় পররাষ্ট্রমন্ত্রী জয় শঙ্করকে পাশে দাঁড় করিয়ে। খুব ক্ষিপ্ত হয়ে ভারত অভিযোগ করে যে যুক্তরাষ্ট্র ভোটের রাজনীতি করছে।

অবশ্য ভারতের এমন সস্তা অভিযোগ কোনও গুরুত্ব পায়নি মিডিয়ায়। কারণ, এটা প্রমাণিত সত্য যে বিগত বছরগুলোতে ভারত তার সংখ্যালঘু মুসলমানদের ওপর বুলডোজার চালাচ্ছে। বছরের পর বছর ধরে, ভারতীয় মুসলমানরা প্রায়ই তাদের খাদ্য এবং পোশাক শৈলী থেকে শুরু করে আন্ত -ধর্মীয় বিবাহ পর্যন্ত সবকিছুর জন্যই লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের মতো অধিকার গোষ্ঠীগুলো সতর্ক করে দিয়েছে যে হামলা বাড়তে পারে। তারা মোদির শাসক দলকে কখনও কখনও মুসলমানদের বিরুদ্ধে বিদ্বেষমূলক বক্তৃতা দেওয়ার জন্যও অভিযুক্ত করেছে। কিন্তু মোদি সরকার তার সংখ্যালঘু ২০.৪ কোটি মুসলমানদের নিষ্পেষণে রেখেছে, যারা অন্যভাবে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় সংখ্যার মাইনরিটি এবং ভারত মুসলমান সংখ্যাগরিষ্ঠতায় পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তর দেশ।

গরু খাওয়ার জন্য হত্যা করা, নামাজ পড়তে-আজান দিতে বাধা দেওয়া, বোরকা নিষিদ্ধ করা, তালাক নিষিদ্ধ করার আইন আনা, রাম-হনুমানের নামে মিছিল করে মুসলমান সম্প্রদায়কে অশ্লীল, আক্রমণাত্মক গানের মাধ্যমে উত্ত্যক্ত করে হামলা করা, সর্বোপরি মুসলমানদের নাগরিকত্বহীন করার জন্য সংসদে আইন পাস করার ঘটনাবলি দিয়ে দেশটি অসহিষ্ণু রাষ্ট্র হিসেবে বিশ্বের মধ্যে শীর্ষ আসন নিয়েছে। এরমধ্যে কাশ্মিরের কাছ থেকে বিশেষ স্বায়ত্তশাসন মর্যাদা নয় শুধু, রাজ্যের মর্যাদাও কেড়ে নেওয়া হয়েছে। টিভি-চলচ্চিত্রে মুসলমানদের দেশদ্রোহী, সন্ত্রাসী হিসেবে চিত্রায়িত করে তাদের বিরুদ্ধে চূড়ান্তভাবে ঘৃণা ছড়ানোর কাজ চলছে।

তবে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে সাম্প্রতিক বিতর্কে ভারতের সঙ্গে আরব বিশ্বের সম্পর্ক চরম সংকটের মধ্যে পড়েছে এটাতে কোনও সন্দেহ নেই। বিজেপি নেতারা ইসলাম, নবী মুহাম্মদ (সা.) ও তাঁর স্ত্রী আয়শা সম্পর্কে কটূক্তি, অবমাননাকর রেফারেন্স দেওয়ার পর মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোর কাছ থেকে ভারত যে ক্ষোভের মুখোমুখি হচ্ছে, নয়াদিল্লিকে সেই ক্ষতি পোষানোর জন্যই এখন ব্যস্ত থাকতে হবে।

কমপক্ষে পাঁচটি আরব দেশ ভারতের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক প্রতিবাদ করেছে এবং প্রতিবেশী পাকিস্তান, আফগানিস্তান ও মালদ্বীপ তীব্র প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেছে। সোশাল মিডিয়ায় ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়েছে এবং কিছু আরব দেশে ভারতীয় পণ্য বর্জনের আহ্বানকে ভারতের খাটো করে দেখার সুযোগ নেই। এর প্রতিক্রিয়া হিসেবে মধ্যপ্রাচ্যে বসবাসরত ভারতীয় নাগরিকরাও বাঁকা দৃষ্টিতে পড়বে।

নরেন্দ্র মোদি ২০১৪ সালে প্রথম নির্বাচিত হওয়ার পর থেকে এই ধরনের হামলার বিষয়ে নিয়মিত নীরবতার দ্বারা উৎসাহিত হয়েছে হিন্দু মৌলবাদীরা। মোদির দ্বিচারিতা আরব বিশ্বের জনগণের কাছে আগেই প্রকাশিত হয়েছিল, কিন্তু মহানবী (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তিতে শাসকরাও বাধ্য হয়েছেন প্রতিবাদে শামিল হতে।

গত মাসের শেষ সপ্তাহে মহানবী (সা.)-কে নিয়ে নূপুর শর্মা এবং নবীন জিন্দাল নামে দুই বিজেপি মুখপাত্রের মন্তব্যের পর থেকে ক্ষোভ তীব্র হচ্ছে। মোদির দল তাদের তড়িঘড়ি বহিষ্কার করে। ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে বলে যে আপত্তিকর টুইট এবং মন্তব্য ‘কোনোভাবেই সরকারের মতামতকে প্রতিফলিত করে না। এগুলো হচ্ছে ক্ষুদ্র উপাদানের মতামত’। মন্ত্রণালয়ের ভাষায় এরা ‘fringe elements’। সরকারি দলের মুখপাত্র কী করে fringe elements হয় এখন এই প্রশ্ন করছে ভারতীয় মিডিয়াও। যেখানে ভারতের শাসক দলের মুসলিম বিদ্বেষ প্রকাশ্য সেখানে ভারতীয় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এই পরিস্থিতি কীভাবে মোকাবিলা করবে তা এখন দেখার বিষয়।

 

লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট। ইরাক ও আফগান যুদ্ধ-সংবাদ সংগ্রহের জন্য খ্যাত। [email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বুয়েটকে হিজবুত তাহরীর-মুক্ত করতে ৬ শিক্ষার্থীর স্মারকলিপি
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বরুণের স্পিনের পর সল্ট ঝড়ে দিল্লিকে হারালো কলকাতা
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
বেতন বৈষম্যে উচ্চশিক্ষার মান হারাচ্ছে বেসরকারি কলেজগুলো
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
খিলগাঁও তালতলা মার্কেটে ক্যাশলেস লেনদেন চালু
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ