X
শুক্রবার, ০৩ মে ২০২৪
১৯ বৈশাখ ১৪৩১

‘স্মার্ট সিটি’ কি ভয়াবহ দুর্ঘটনা সামাল দিতে প্রস্তুত?

ড. রাশেদা রওনক খান
০৬ এপ্রিল ২০২৩, ২০:০৪আপডেট : ০৬ এপ্রিল ২০২৩, ২০:০৪

ওয়াশিংটন ডিসির একটি মায়াবী নদীর নাম হচ্ছে ‘অ্যানাকস্টিয়া’। সেই নদী কী যে অসাধারণ সুন্দর! আমেরিকায় পিএইচডি ক্লাস চলাকালে ভিজ্যুয়াল এনথ্রোপোলজি কোর্সে আমাদের তিন শিক্ষার্থীবিশিষ্ট দলের দায়িত্ব পড়লো ডিসির ‘অ্যানাকোস্টা নদী’র দূষণ নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি বানানোর।

কোর্স শিক্ষক অধ্যাপক নিনা স্যাপিরো-পার্লসহ দলের সদস্যরা যখন আলাপ-আলোচনা করছিলাম– কীভাবে আমরা প্রজেক্টটি করবো, তখন মনে মনে ভাবছিলাম, যাক, আমার শহরের বুড়িগঙ্গার মতো তাদের নদীতেও নিশ্চয়ই অনেক ময়লা আছে। আর আমেরিকার নদী যদি অপরিষ্কার থাকে, তাহলে আমাদের থাকাটা তো অস্বাভাবিক না।

যাহোক, আমরা বেশ কিছু দিন ধরে বিভিন্ন সেকেন্ডারি তথ্য গবেষণা করে ‘অ্যানাকোস্টা নদী’ রক্ষা কমিটির সন্ধান পেলাম। বিশেষত ময়লাবিহীন পরিষ্কার নদীর জন্য যে আন্দোলন কর্মসূচি চলে, তাও আমরা জানতে পারলাম।

সেসব আন্দোলনের অ্যাক্টিভিস্টদের তালিকা তৈরি করি। তাদের নদীর পাড়ে সাক্ষাৎকার নেবো। এমন নানান পরিকল্পনা করা হলো। আর এসব পরিকল্পনার ফাঁকে কেবল অপেক্ষা করছিলাম, নদী পাড়ে গিয়ে কখন শুটিং শুরু করবো। তো, প্রথম যেদিন শুটিং শুরু করলাম, আমি তো নদী দেখে অবাক।

সারা দিন ধরে আমরা তিন জন খুঁজে খুঁজে বেড়াই কোথায় একটু ময়লা আছে, কোথায় একটা পানির বোতল পড়ে আছে, তা শুট করার জন্য। পর পর তিনদিন নদীর বিভিন্ন দিক ঘুরে-ফিরে ময়লার সন্ধান করলাম, ঠিক কোন দিকে গেলে আমরা কিছু ময়লা দেখতে পারবো। আমাদের জন্য ময়লা খুঁজে পাওয়াই কঠিন হয়ে পড়লো। আমার দলের দুই আমেরিকান বন্ধু অনেক সিরিয়াসলি ময়লা খুঁজে বেড়াচ্ছিল। তারা একটা পলিথিন বা বোতল বা ক্যান কিছু দেখলেই ময়লা বলে খুব আতঙ্কিত হয়ে শুট করার প্রস্তুতি নিতে থাকে। আর অন্যদিকে নদীর এই পরিচ্ছন্নতা দেখে আমি এতটাই বোকা হয়ে গিয়েছিলাম যে ময়লা খোঁজ করার চেয়ে নদীর সৌন্দর্য অবলোকন করতেই বেশি ভালো লাগছিল। কোথায় কীসের একটা বোতল বা পলিথিন খুঁজে পেলে সেটার ভিজুয়ালাইজেশন করতে তারা দুজন ব্যস্ত হয়ে উঠলেও সেদিকে আমার আগ্রহ প্রায় শূন্যের কোঠায় নেমে এলো। সেদিন খুব লক্ষ করেছিলাম– প্রকৃতি, নদী, দেশ ও শহরের প্রতি তাদের মমতা ও দায়িত্ববোধ প্রচণ্ড রকমের, যা খুব শিক্ষণীয় পর্যায়ের বলা যায়।

এই গল্পটি বলার কারণ, আমরা যে স্মার্ট সিটির স্বপ্ন দেখছি, সেখানে এই ধরনের জলাশয়, নদী, খাল, পুকুর, ঝিল এসবের স্থান কোথায়?

সেদিন বঙ্গবাজারে আগুন নির্বাপণ করতে গিয়ে দেখলাম আমাদের শহরজুড়ে পানির সংকট। এটি আমাদের জন্য একটি অশনি সংকেত। কেন যেন মনে হচ্ছিলো, পানিবিহীন চাকচিক্যময় এই শহর জ্বলে ওঠে আগুনের লেলিহান শিখায়, আর আমরা অসহায় হয়ে শহরকে পুড়ে যেতে দেখি। ভাবছিলাম, আমাদের শহর জলাশয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ থাকলে কি আরও দ্রুত সেদিন আগুন নিভানো যেত না? আচ্ছা, ঢাকা শহরের জলাশয়গুলো কোথায় গেলো? কীভাবে অধিকাংশ জলাশয় অদৃশ্য হয়ে গেলো ধীরে ধীরে? প্রকৃতিকে ধ্বংস করে পৃথিবীজুড়ে শহর গড়ে ওঠে, কিন্তু এতটা নগ্নভাবে ধ্বংস করে আমরা কি বিপদ নিজেরাই ডেকে আনছি না?

আমাদের ভূমিদস্যুরা যেভাবে জমি দখল করে শহরজুড়ে সুউচ্চ পর্বতসম করপোরেট বিল্ডিং আর গ্লাস হাউজ গড়ে ‘স্মার্ট সিটি’ বানাচ্ছেন, সেই শহরকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যাবে তো?

ঢাকা শহরের ইতিহাস যদি দেখি, ১৯২৪ সালের দিকে ব্রিটিশ মানচিত্রে ১২০টির মতো পুকুরের উপস্থিতি দেখা যায় (বর্তমান পুরান ঢাকা)। ১৯২৪ সাল থেকে আজকে ২০২৩ প্রায় ৯৯ বছরে প্রায় ১০০টির মতো পুকুর কোথায় হারিয়ে গেলো, কীভাবে হারিয়ে গেলো, সেসব নিয়ে আমরা কি ভাবছি? আর যে কয়টা পুকুর বা খাল আছে এখনও, তাদেরও শরীর যেন ক্রমশ ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর হয়ে যাচ্ছে।

যেমন, স্বাধীনতার পূর্বে ঢাকায় ৪৭টি খাল ছিল, যার বেশিরভাগের প্রস্থ ছিল ১৫০ ফুটেরও বেশি। এগুলো দিয়ে একসময় শহরের পানি নিষ্কাশন হতো অথচ এখন অল্প বৃষ্টিতেই থমকে যায় পুরো শহর। হবেই না কেন? খাল সংখ্যা কমতে কমতে এখন ২২টির মতো টিকে আছে, তাও খুব সংকুচিত আকারে।

দৈনিক বাংলায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ড্যাপের ভৌত জরিপের প্রতিবেদন অনুযায়ী রাজধানীতে ৭৯টি লেক (১০৮০ একর) এবং ১ হাজার ৫১৬টি পুকুর আছে। এছাড়াও ঢাকায় রয়েছে ২ হাজার ৮৬৯টি ডোবা (১৪৯৩ একর), ৮৮৫টি জলাভূমি (৮২৪৭ একর)।

ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকায় ২০০৯ সাল পর্যন্ত ২৯ বর্গকিলোমিটার এলাকা বা ৭ হাজার ১৬৬ দশমিক একর জলাধার থাকলেও ২০২২ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১০ দশমিক ২৮ বর্গকিলোমিটার বা ২ হাজার ৫৪০ দশমিক একরে।

পৃথিবীর অনেক শহরে দেখেছি সুউচ্চ ভবন আর জলাশয়ের অনুপাত ঠিক রাখতে সঠিক পরিকল্পনায় কাজ হয়। আর আমাদের? নানা ধরনের অবকাঠামোগত উন্নয়ন করতে গিয়ে শহরকে পুরোপুরি শুষ্ক এলাকায় রূপান্তর করে ফেলেছি।

একটি শহরে যদি জলাভূমি না থাকে, বন্যাসহ নানা ধরনের প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা থেকে নগরবাসী কীভাবে রক্ষা পাবে? শহরের পানি সংকট নিরসন ও জলাবদ্ধতা রোধে জলাশয়, খাল-বিল, নদী-নালার গুরুত্ব অপরিসীম।

সেখানে পরিকল্পনায় যদি জলাভূমি থাকার প্রয়োজনটা উহ্য হয়ে পড়ে তাহলে তো ঢাকার পরিবেশ বিপন্ন হয়ে পড়বে, এটাই স্বাভাবিক। আমরা সময়ে সময়ে দেখলাম, বিভিন্ন ভুলনীতি অবলম্বন করে শহরের জলাভূমি, পুকুর, খাল- বিল-ঝিলের জমির দাম হুট করেই বাড়তে শুরু করে। ঢাকা শহরের উপচে পড়া মধ্য ও নিম্ন আয়ের মানুষজন তখন তাদের বসতি খুঁজতে বেছে নেয় মালিক শ্রেণির তৈরি করা বিল্ডিংগুলোকে ভাড়া থাকার নিমিত্তে। আর উচ্চবিত্তরা একের পর এক জমি কিনে তৈরি করছে সুউচ্চ ভবন, যেখান থেকে আয় করছে বিশাল অঙ্কের টাকা। এই চক্রজালে আটকে পড়েছে শহরের মানুষজন, চলছে জমি কেনার হিড়িক। এই বাস্তবতায় দেদার খাল দখল হতে থাকে, ঝিল ভরাট হতে থাকে, আর নব্য শহর ফুলে ফেঁপে বড় হতে থাকে, নগরের চাকচিক্য দেখে আমরা ভাবছি, এই বুঝি আমরা অনেক উন্নত শহরে পরিণত হচ্ছি। তর্কের খাতিরে কিংবা বিশ্বায়নের যুগে আমরা না হয় চাইলাম, শহরের চাকচিক্য বাড়ুক, বাড়ুক সুউচ্চ ভবনের উপস্থিতি, পরিচিত হোক গ্লোবাল সিটি কিংবা স্মার্ট সিটি হিসেবে, কিন্তু তাই বলে জলাভূমিগুলো দখল করে?

এসব জলাভূমি দখল করে ধনী হতে থাকলো একটি নব্য শ্রেণির দল, আর আমরা তাদের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ক্ষমতার কাছে যেন হার মানছি প্রতিনিয়ত। সেসব দখলকৃত জমিতে সরকারি ও বেসরকারি আবাসন প্রকল্পও গড়ে উঠেছে বছরের পর বছর ধরে, ফলে আমাদের শহর হারাচ্ছে তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, হয়ে উঠছে বসবাসের অযোগ্য।

মনে প্রশ্ন জাগে, শহরের জলাশয় রক্ষার দায়িত্বে থাকা কোনও সরকারি সংস্থা কি কখনও কোনও জোরালো ভূমিকা রেখেছিল? ভূমিকা রাখলো না কেন বা রাখতে পারলো না কেন, ভেবেছি কি কখনও? শহরের পুকুর রক্ষার দায়িত্বে থাকা ওয়াসা, রাজউক, কিংবা ঢাকা জেলা প্রশাসন কেউই জোরালো কোনও ভূমিকা রাখতে পারেনি। কিন্তু কেন? পুরান ঢাকাসহ নতুন ঢাকার উত্তরা, বনশ্রী, শেখেরটেক, মোহাম্মদপুরসহ বিভিন্ন অঞ্চলে সরকারি আবাসিক এলাকা গড়ে তোলার জন্য যে জোনিং শুরু হয়েছিল, সেখানে এসব জলাশয়ের উপস্থিতির কথা কি ভাবা হয়েছিল? ধানমন্ডি লেকের কতটুকু এখন আর অবশিষ্ট আছে? এই মুহূর্তে শহরে যত আবাসন প্রকল্প আছে এর প্রায় সবগুলোর ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যাবে, এগুলো জলাভূমি ও খাল ভরাট করে গড়ে উঠেছে। কেবল ভূমি দোসররা নয়, এমনকি সরকারি আবাসন প্রকল্পগুলো তৈরি করতেও ভরাট করা হয়েছে খাল বা ঝিল। এই যে আমাদের শহরের বিভিন্ন এলাকায় ঝিলপাড়া বলে নাম আছে, সেখানে ঝিলগুলো কোথায়? যেমন, আমরা যদি উত্তরার কথা বলি, উত্তরার সব খাল কোথায় হারিয়ে গেলো, কেনই বা হারিয়ে গেলো? বনশ্রী তো পুরোটাই যেন বিল ভরাট করে তৈরি। বনশ্রীর পাশেই আফতাবনগরে এখনও চলে খাল ভরাট কার্যক্রম। সঙ্গে সঙ্গে ছোট ছোট পুকুর, ঝিল এসব ভরাটের কথা তো আর নতুন কিছু নয়, কিংবা অস্বাভাবিক কার্যক্রম বলেও বিবেচিত হয় না। এক্ষেত্রে দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি সংস্থাগুলো যেন নীরব দর্শক।

কিছু পুকুর এখনও জীর্ণশীর্ণ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার মূল কারণ আমাদের শহরের প্রতি, জলাশয়ের প্রতি মায়া কিংবা দায়িত্বশীলতা থেকে, তা কিন্তু নয়। বরং যেসব পুকুর দখল ও ভরাটের কবল থেকে বেঁচে আছে, তার বেশিরভাগই লক্ষ করলে দেখতে পাবো, সেসব পুকুরের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণে, মানে সেগুলো ধর্মীয় উপাসনালয়ের সঙ্গে সম্পর্কিত। ফলে সেসব জলাশয় দখল করতে যাওয়ার আগে  দখলদারদের ওপর ধর্মীয় ও সামাজিক একটা চাপ তৈরি হয়, যা অনেক ক্ষেত্রেই তারা এড়িয়ে যেতে পারেনি এখনও। হয়তো ভবিষ্যতে সেটাও পেরে ফেলবে। তখন যে আমাদের শহরটির কী বেহাল দশা হবে, কে জানে।

যে গল্পটা দিয়ে শুরু করেছিলাম, সেটার শেষ টানি। আমাদের তিন বন্ধুর বানানো ওই ডকুমেন্টারিটি সেই বছর ক্যাপিট্যাল হিলসহ অনেক ফিল্ম ফ্যাস্টিভালে অংশগ্রহণের আমন্ত্রণ পেয়েছিল এবং প্রতিটিতেই আমার অংশগ্রহণের সুযোগ হয়েছিল। সেই সঙ্গে সুযোগ হয়েছিল আমেরিকান চলচ্চিত্রবোদ্ধা, পরিবেশবাদী, সিভিল সমাজ, সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও দর্শকদের মনে ‘অ্যানাকস্টিয়া’ নদীটিকে ঘিরে কি ধরনের ভালোবাসা, উদ্বেগ ও প্রেম, তা দেখার। চাতক পাখির মতো বসে আছি এই আশা নিয়ে, প্রকৃতি, নদী আর শহরের প্রতি আমাদেরও এমন ভালোবাসা জাগ্রত হবে একদিন।  

লেখক: শিক্ষক, নৃবিজ্ঞান বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
মামুনুল হকের জন্য কাশিমপুর কারাগারের সামনে ভক্তদের ভিড়
লন্ড‌নের মেয়র প‌দে হ্যাটট্রিক জ‌য়ের প‌থে সা‌দিক খান
লন্ড‌নের মেয়র প‌দে হ্যাটট্রিক জ‌য়ের প‌থে সা‌দিক খান
থ্রিলার বনাম হরর: প্রেক্ষাগৃহে নতুন দুই সিনেমা
এ সপ্তাহের ছবিথ্রিলার বনাম হরর: প্রেক্ষাগৃহে নতুন দুই সিনেমা
অপতথ্য ও অর্ধসত্যের মাঝে মুক্ত গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ
অপতথ্য ও অর্ধসত্যের মাঝে মুক্ত গণমাধ্যমের চ্যালেঞ্জ
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ