X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৬ বৈশাখ ১৪৩১

রাজনৈতিক কর্মসূচিতে পুলিশের অনুমতি এবং প্রতিবাদের ভাষা

আমীন আল রশীদ
০৯ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:৪৯আপডেট : ০৯ অক্টোবর ২০২৩, ১৫:৪৯

‘রাষ্ট্র’ মূলত কতিপয় ক্ষমতার ভারসাম্য। যেমন, বাংলাদেশের সংসদীয় গণতন্ত্রে সার্বভৌম ক্ষমতা হচ্ছে জনগণের। কিন্তু সেই জনগণ চাইলেই যা খুশি করতে পারে না। সে কী করতে পারবে এবং পারবে না এমনকি তার প্রতিবাদের ভাষা ও ধরন কী হবে—সেটিও সংবিধান বলে দিয়েছে।

সংবিধানের ৩৭ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, ‘জনশৃঙ্খলা বা জনস্বাস্থ্যের স্বার্থে আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় সমবেত হইবার এবং জনসভা ও শোভাযাত্রায় যোগদান করিবার অধিকার প্রত্যেক নাগরিকের থাকিবে।’ তার মানে একজন নাগরিক কিংবা নাগরিকদের কোনও একটি গোষ্ঠী যদি কোনও অন্যায়ের বিরুদ্ধে অথবা কোনও কিছুর দাবি জানাতে রাস্তায় নেমে প্রতিবাদ করতে চায়, সেখানে তাকে জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্য বিবেচনায় রাখতে হবে এবং ‘আইনের দ্বারা আরোপিত যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ-সাপেক্ষে’ শান্তিপূর্ণভাবে ও নিরস্ত্র অবস্থায় জনসভা ও শোভাযাত্রা করতে পারবে।

এখানে কয়েকটি শর্ত স্পষ্ট। তবে যে ‘যুক্তিসঙ্গত বাধানিষেধ’-এর কথা বলা হয়েছে, সেই যুক্তিটা কে ঠিক করবে; সেই যুক্তির মানদণ্ড কী হবে—সেটি একটি পুরনো তর্ক। কেননা, ক্ষমতায় থাকা দলের কাছে যেটি যৌক্তিক, একই দল বিরোধী দলে থাকলে তাদের কাছে সেটিই অযৌক্তিক। তার মানে যুক্তিটা নির্ভর করে স্থান-কাল-পাত্র ও সময়ের ওপর।

রাষ্ট্র যেমন কতিপয় ক্ষমতার ভারসাম্য—তেমনি সেই ভারসাম্য বজায় না থাকলেও জনগণের কোনও একটি অংশ রাস্তায় নেমে ওই ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার দাবিতে মিছিল করতে পারে, স্লোগান দিতে পারে। জনগণের কোনও একটি ক্ষুদ্র বা বিরাট অংশ যদি মনে করে যে, রাষ্ট্রে সংবিধান, আইন ও নীতি-নৈতিকতার ব্যত্যয় ঘটছে, তাহলে তারা এর প্রতিবাদ জানাতে পারে। প্রতিবাদকারীরা যদি নিরস্ত্র হয় এবং তাদের প্রতিবাদের কারণে যদি জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্য বিঘ্নিত না হয়, তাহলে সেই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে রাষ্ট্র বাধা দিতে পারে না।

কিন্তু বহুদিন ধরেই যে তর্কটি রাজনৈতিক পরিসরে বেশ জোরালোভাবেই আলোচিত হচ্ছে, তা হলো জনস্বার্থে কোনও কর্মসূচি, সেটি যদি রাজনৈতিক দলের কর্মসূচিও হয়, তাহলে সেই কর্মসূচি পালনে কেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অনুমতি লাগবে? যদি কেউ মিছিল মিটিং বা সমাবেশের নামে জনশৃঙ্খলা ও জনস্বাস্থ্যের বিঘ্ন ঘটায়, সেটি প্রতিহত করার আইনি ক্ষমতা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর রয়েছে। কিন্তু যেকোনও কর্মসূচি পালনে তাদের কাছ থেকে অনুমতি নিতে হবে কেন—এই প্রশ্নটি রাজনৈতিক মহলে আছে। বিশেষ করে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে, তারা এই প্রশ্নটি সামনে আনে। আবার তারাই যখন ক্ষমতায় যায়, তখন বিরোধী দলে থাকা অবস্থায় কী বলেছিল, সেটি ভুলে যায়।

সম্প্রতি এই তর্কটি আবারও সামনে এসেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নবনিযুক্ত কমিশনার হাবিবুর রহমানের দুটি বক্তব্যের কারণে। বিএনপিকে উদ্দেশ করে ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘মিটিং করতে হলে সরকারের অনুমতি নিতে হবে। না নিলে খবর আছে। অনুমতি না নিলে পালাবার পথ পাবেন না।’ (দেশ রূপান্তর, ০১ অক্টোবর ২০২৩)।

এর পরদিনই একই কথা বলে সংবাদ শিরোনাম হন ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) নবনিযুক্ত কমিশনার হাবিবুর রহমান। তিনি বলেন, অনুমতি ছাড়া রাজধানীতে কোনও সংগঠন কোনও কর্মসূচি পালনের চেষ্টা করলে তাদের বিরুদ্ধে নির্ভয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। (প্রথম আলো, ০২ অক্টোবর ২০২৩)।

তার কথায় এটি স্পষ্ট যে, রাজধানীতে যেকোনও সংগঠনের যেকোনও কর্মসূচির জন্য তাদের অনুমতি নিতে হবে এবং কেউ অনুমতি না নিয়ে কর্মসূচি পালন করলে, অর্থাৎ রাস্তায় নামলে তাদের বিরুদ্ধে ‘নির্ভয়ে কঠোর ব্যবস্থা’ নেওয়া হবে। এখানে তিনি শুধু ‘ব্যবস্থা’ নেওয়ার কথা বলছেন না। বলছেন ‘কঠোর ব্যবস্থা’ এবং সেটি তারা নেবেন ‘নির্ভয়ে’। প্রশ্ন হলো, কঠোর ব্যবস্থা মানে কী এবং তিনি এই ‘নির্ভয়ে’ শব্দটি কেন ব্যবহার করলেন? পুলিশ কি কাউকে ভয় পায়?

নাগরিকদের কোনও একটি অংশ যদি কোনও কারণে ক্ষুব্ধ হয় এবং তারা রাস্তায় নেমে আসে, সেখানে কি সব সময় পুলিশের অনুমতি গ্রহণের অবকাশ থাকে? ধরা যাক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীরই কোনও একটি অন্যায়ের প্রতিবাদে নাগরিকদের কোনও একটি অংশ মিছিল করতে চায় বা সমাবেশ করতে চায়; ধরা যাক সম্প্রতি পুলিশের হেফাজতে থাকা অবস্থায় সৈয়দ মোহাম্মদ শহীদুল্লাহ  নামে দুদকের যে সাবেক কর্মকর্তার মৃত্যু হলো, এই ঘটনার প্রতিবাদ জানাতে তথা হেফাজতে নির্যাতন ও মৃত্যু ঠেকানোর দাবিতে কোনও রাজনৈতিক দল, কোনও সামাজিক সংগঠন কিংবা নাগরিকদের কোনও একটি অংশ সংগঠিত হয়ে যদি জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে এমনকি পুলিশ সদর দপ্তরের সামনে মানববন্ধন বা সমাবেশ করতে চায়, পুলিশ কি ওই কর্মসূচির অনুমতি দেবে? যদি না দেয় তাহলে প্রতিবাদকারীরা কি বসে থাকবে? পৃথিবীর কোনও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সকল কর্মসূচি কি পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছ থেকে অনুমতি নিয়ে করতে হয়? এটি কি বাস্তবসম্মত?

ডিএমপি কমিশনার যেদিন হুঁশিয়ারি দিয়ে বললেন যে বিনা অনুমতিতে কর্মসূচি করলে নির্ভয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে, তার পরদিনই গণমাধ্যমের সংবাদ শিরোনাম: পুলিশের অনুমতি মেলেনি, তবু কাজীর দেউড়িতে সমাবেশ করতে চায় বিএনপি। খবরে বলা হয়, চট্টগ্রাম নগরের কাজীর দেউড়িতে রোডমার্চ-পরবর্তী সমাবেশের অনুমতি পায়নি বিএনপি। দলের নেতা-কর্মীরা মঙ্গলবার রাত পর্যন্ত এ বিষয়ে পুলিশের অনুমতি পাননি বলে জানান। তবে বিএনপির নেতারা বলছেন, যেকোনও মূল্যেই তারা সেখানে সমাবেশ করবেন।

একই কথা বলেছিলেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী। ওবায়দুল কাদেরের বক্তব্যের দুদিন আগেই তিনি ঢাকায় এক কর্মসূচিতে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে বলেন, আগামীতে যে কর্মসূচি আসবে, কারও অনুমতি নেওয়ার প্রয়োজন নেই। রাজপথ দখল করে সংগ্রাম করতে হবে। (ডেইলি স্টার অনলাইন, ২৮ সেপ্টেম্বর ২০২৩)।

তার মানে এটা এখন স্পষ্ট যে, সরকার পতনে বিএনপি যে লাগাতার কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে, তার সব কর্মসূচিতে সরকার তথা পুলিশের অনুমতি পাবে না। আর অনুমতি না পেলেও তারা সমাবেশ বা মিছিল করার চেষ্টা করবে। তাতে পরিস্থিতি সংঘাতপূর্ণ হয়ে উঠবে। দেশের আগামীর রাজনীতি বোধ হয় সেদিকেই যাচ্ছে।

২.

খ্যাতিমান ইতিহাসবিদ ও তাত্ত্বিক রনজিৎ গুহ (১৯২৩-২০২৩) লিখেছেন,‘প্রতিবাদ মনুষ্যত্বের ধর্ম। এদিক থেকেই জীবজগতে মানুষের অনন্যতা, সে কেঁচো নয়, মেরুদণ্ড সোজা করে সে প্রতিবাদ করতে জানে। সেজন্যে যে ভাষা ও বিবেচনা দরকার, তা শুধু মানুষেরই আছে, অন্য কোনও প্রাণীর নেই। তাই ঘোর স্বৈরাচারী সমাজেও প্রতিবাদ নীরব হয়ে থাকে না। কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীতদাসদের নাম ও আত্মকথা এখন আমেরিকার প্রতিবাদী সংগীত ও সাহিত্যের ঐতিহ্যভুক্ত। যেমন, আমাদের পল্লিগাথা, পল্লিগীতি ও মঙ্গলকাব্যে পুরুষশাসিত সমাজের বিরুদ্ধে নারী কণ্ঠের প্রতিবাদ বাঙালির সাহিত্য ও সংস্কৃতির বহুমূল্য সম্পদ বলে গণ্য হয়।’(রনজিৎ গুহ রচনাসংগ্রহ, প্রথম খণ্ড, আনন্দ পাবলিশার্স/২০১৯, পৃষ্ঠা ১৪১)।

এখন কথা হচ্ছে, প্রতিবাদটা কে করছে এবং কেন করছে? যে দাবিতে এখন বিরোধী দল আন্দোলন করছে, তারা যখন ক্ষমতায় ছিল তাদের কাছে সেই দাবিটি (তত্ত্বাবধায়ক সরকার) ছিল অযৌক্তিক। একইভাবে এখন যারা ক্ষমতায়, তাদেরও কাছেও একসময় এই দাবিটি যৌক্তিক ছিল। কেননা তখন তারা বিরোধী দলে। তার মানে একই দাবি একই ব্যক্তি ও দলের কাছে দুইরকমের হয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র ক্ষমতার পালাবদলের কারণে। ফলে যে প্রশ্নটি সঙ্গত সেটি হলো, রাজনৈতিক দলের ক্ষমতায় যাওয়ার লড়াই এবং ক্ষমতায় থাকার জন্য সেই আন্দোলন প্রতিহত করার এই প্রক্রিয়ার মধ্যে জনগণের স্বার্থ কতটুকু রক্ষিত হচ্ছে? ক্ষমতায় থাকতে যারা বলে যে জনগণ তাদের সঙ্গে আছে এবং সেই জনগণকে সঙ্গে নিয়েই সকল ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করা হবে; তারাই আবার বিরোধী দলে থাকতে বলে যে জনগণকে সম্পৃক্ত করেই দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলে সরকারের পতন ঘটানো হবে।   

রনজিৎ গুহ বলছেন, ‘প্রতিবাদী ভূমিকাতেই মানুষ যুগে যুগে ইতিহাসের নায়ক হয়ে ওঠে, বিশেষ করে যখন একই যুগের এক পর্ব থেকে পর্বান্তরে পালাবদল হয়।’ প্রশ্ন হলো, এখন কি বাংলাদেশে কোনও একটি পর্ব থেকে পর্বান্তর হচ্ছে? এখন যাদেরকে প্রতিবাদী ভূমিকায় দেখা যাচ্ছে, তাদের লক্ষ্য উদ্দেশ্যটা কী? নিছকই একটি দলকে ক্ষমতা থেকে নামানো? একটি দল ক্ষমতা নেমে নেমে গিয়ে আরেকটি দল যদি ক্ষমতায় আরোহণ করে, তাহলেই রাষ্ট্রের সকল সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?  

৩.

গণতন্ত্র ও স্বৈরতন্ত্রের মূল পার্থক্য হলো, স্বৈরতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্র পরিচালনা তথা জনগণকে শাসন করা সহজ। কেননা, স্বৈরতন্ত্রের ভিত্তি হচ্ছে পেশীশক্তি। জনগণ তথা শাসিতের সম্মতি ছাড়াই সেখানে শাসন চালানো যায়। কিন্তু গণতন্ত্রে শাসন প্রক্রিয়ায় শাসিতের সম্মতি প্রয়োজন। গণতন্ত্র মানেই হলো শাসন প্রক্রিয়ায় জনগণের অংশগ্রহণ। ফলে সেখানে সংসদীয় নির্বাচন, ভোটাভুটি, দলাদলি, জনমত, সভাসমিতি, ব্যক্তিস্বাধীনতা, নাগরিক অধিকার ইত্যাদি মুখ্য হয়ে ওঠে। সুতরাং সেখানে প্রতিবাদের ভাষাও হতে হয় গণতান্ত্রিক।

অতএব প্রতিবাদের গুরুত্ব ও যৌক্তিকতা মেনে নিয়েও এই প্রশ্ন তোলা সঙ্গত যে, প্রতিবাদটা ঠিক কার বিরুদ্ধে? সরকারের বিরুদ্ধে নাকি সরকার যে সিস্টেমে রাষ্ট্র পরিচালনা করছে সেই সিস্টেমের বিরুদ্ধে?

এসব বিবেচনায় রনজিৎ গুহ মনে করেন, ‘প্রতিবাদের ভিত্তি প্রতিবাদীর আত্মশক্তিতে। প্রতিবাদ যদি ন্যায়সঙ্গত হয়, যেকোনও হিসেবেই তা জমা পড়বে লাভের খাতায়।’ তার মানে ক্ষমতায় কে থাকলো কিংবা কে ক্ষমতাচ্যুত হয়ে কে বসলো, তার খতিয়ানই প্রতিবাদের মূল্য সম্পর্কে শেষ কথা নয়।

বিএনপি যে লাগাতার কর্মসূচির ঘোষণা দিয়েছে, প্রথমত এবং প্রধানত তার লক্ষ্য হচ্ছে সরকারের পতন ঘটানো। এখানে তাদের আত্মশক্তি কতটুকু আছে, তাদের প্রতিবাদটি কতটা ন্যায়সঙ্গত—সেই বিচারের ভার জনগণের, ইতিহাসের।

লেখক: কারেন্ট অ্যাফেয়ার্স এডিটর, নেক্সাস টেলিভিশন।

 

/এসএএস/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
আবাহনীর ১০ ক্রিকেটার চট্টগ্রামে, একাদশ গঠন নিয়ে বিপাকে সুজন
আবাহনীর ১০ ক্রিকেটার চট্টগ্রামে, একাদশ গঠন নিয়ে বিপাকে সুজন
আওয়ামী লীগ নেতাকে হারিয়ে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা রউফ জয়ী
আওয়ামী লীগ নেতাকে হারিয়ে বিএনপির বহিষ্কৃত নেতা রউফ জয়ী
বাংলাদেশের আম নিতে চায় চীন
বাংলাদেশের আম নিতে চায় চীন
গাজীপুর-নীলফামারীর দুই হাসপাতালে দুদকের অভিযান
গাজীপুর-নীলফামারীর দুই হাসপাতালে দুদকের অভিযান
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ