X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

ইসরায়েলের যুদ্ধাপরাধ ও আমাদের করণীয়

খায়ের মাহমুদ
২২ অক্টোবর ২০২৩, ১৮:২৮আপডেট : ২২ অক্টোবর ২০২৩, ১৮:২৮

ইসরায়েলের গত ৭ অক্টোবর থেকে চলা হামলায় গাজা এখন এক ধ্বংসের নগরী। চলমান বিমান হামলার তীব্রতার মধ্যে, রক্তাক্ত বিধ্বস্ত গাজায় স্থল হামলার জন্যে অপেক্ষা করছে শত শত ট্যাংক এবং লাখ সেনা। সমুদ্র পথে হামলার জন্যে নেওয়া হয়েছে চূড়ান্ত প্রস্তুতি, গাজার আকাশে উড়ছে স্পাই ড্রোন, এ যেন গাজাকে পৃথিবীর মানচিত্র থেকে মুছে ফেলার চূড়ান্ত প্রস্তুতি।

৭ অক্টোবর থেকে শুরু হওয়া এই হামলায় ইসরায়েল পাশে পাচ্ছে তার পশ্চিমা মিত্রদের, অন্যদিকে ফিলিস্তিন বরাবরের মতো দিকভ্রান্ত অসহায় এক অবস্থায় সময় পার করছে। ফিলিস্তিন ইস্যুতে আরব দেশগুলো এখনও তাদের অবস্থান পরিষ্কার করেনি, একইসঙ্গে দুঃখের বিষয় হলো গাজা সীমান্তে মিসর দেয়াল তুলছে। সুতরাং সাধারণ ফিলিস্তিনিদের বেঁচে থাকার জন্যে যাওয়ার বাস্তবিকভাবেই কোনও জায়গা নেই। অন্যদিকে আমেরিকার দ্বিতীয় রণতরী ভূমধ্যসাগরে নোঙর করে আছে। যেহেতু হামলা ফিলিস্তিনি স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস শুরু করেছে, তাই ইসরায়েল ও তার পশ্চিমা মিত্ররা কঠোর থেকে কঠোরতর হামলার সুযোগ লুফে নিয়ে ইতিহাসের নির্মম হামলা শুরু করেছে।

মানবাধিকার ও মত প্রকাশের ব্র্যান্ডিং করা পশ্চিমা দেশগুলো ফিলিস্তিন ইস্যুতে মানুষকে রাস্তায় দাঁড়াতে দিচ্ছে না। ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষের মৌলিক চাহিদা এবং মানবাধিকারে জন্যে ফ্রান্সের রাস্তায় নামা মানুষদের বেপরোয়া গ্রেফতার করছে ফ্রান্স সরকার। হুমকি দিয়েছে কোনও বিদেশি এই ইস্যুতে রাস্তায় নামলে তাকে তার দেশে ফেরত পাঠানো হবে। ইসরায়েলের নির্বিচার বিমান হামলায় শিশু, নারী সাধারণ মানুষ, এমনকি দায়িত্বরত সাংবাদিকরাও মারা যাচ্ছে। এভাবে চলতে থাকলে এই যুদ্ধের সঠিক হতাহতের খবর পাওয়া দুষ্কর হয়ে যাবে।

অনেকেই বিচ্ছিন্নভাবে হামাসকে দুষছেন, কেন তারা আগ বাড়িয়ে এই হামলা শুরু করলো। যারা ফিলিস্তিন-ইসরায়েল সংঘাতের খবর রাখেন তারা নিশ্চয় জানেন এই সমস্যা হঠাৎ ২০২৩-এ শুরু হয়নি। নিজ ভূমিতে পরবাসী ফিলিস্তিনিরা ৭৫ বছর ধরে নানান অত্যাচার নির্যাতন এবং সিস্টেমেটিক ভায়োলেন্সের শিকার। ফিলিস্তিন অধ্যুষিত অঞ্চলে ক্রমাগত পরিকল্পিত বসতি স্থাপন এবং গাজা উপত্যকাকে সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন ও ইসরায়েল নির্ভর করা এর অন্যতম কারণ।

মূলত তিনটি কারণে হামাস এইবারের হামলা শুরু করতে বাধ্য হয়েছে। প্রথমত, অধিকৃত পশ্চিম তীর ও জেরুজালেমে ইসরায়েলের ক্রমাগত এবং আগ্রাসী বসতি স্থাপন ও সৈন্য মোতায়েন। যার জন্যে হামাসের একটা সামরিক প্রতিক্রিয়া দেখানো ছাড়া কোনও পথ খোলা ছিল না।

দ্বিতীয়ত, আরব-ইসরায়েল সম্পর্কের উন্নয়ন। গত বেশ কিছু বছর ধরেই ইসরায়েল আমেরিকার সহায়তায় আরব দেশগুলোর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নের মিশনে নেমেছে। মিসর এবং জর্ডানের সঙ্গে তাদের পূর্ণ কূটনৈতিক সম্পর্ক রয়েছে, এছাড়া আরব লিগভুক্ত আরব আমিরাত, বাহরাইন, সুদান ও মরোক্কোর সঙ্গে ২০২০  সালে ইসরায়েলের কূটনৈতিক সম্পর্ক স্থাপনের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। এর বাইরে ইসরায়েল সৌদি আরবের সঙ্গেও সম্পর্ক উন্নয়নের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং ফিলিস্তিনিদের সমস্যা আরবদের কাছে গুরুত্বহীন হয়ে পড়ার শঙ্কা জেঁকে বসেছিল। হামাসের হামলা আরবদের সেই পুরোনো সমস্যা মনে করিয়ে দেওয়ারই প্রয়াস।

তৃতীয়ত, হামাস লেবাননের হিজবুল্লাহর সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে সফল হয়েছে। হিজবুল্লাহর সেক্রেটারি জেনারেল হাসান নাসরুল্লা সরাসরি বলেছেন, তিনি নিজে হামাসের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়নে কাজ করছেন। সুতরাং এই কোয়ালিশন হামাসকে আগের চেয়ে আত্মবিশ্বাসী করেছে। তবে হামাসের ৭ অক্টোবর হামলা ইসরায়েলকে কোনোভাবেই নির্বিচারে বিমান হামলা করে শিশু, নারী এবং সাধারণ মানুষকে হত্যার লাইসেন্স দেয় না। মূলত সাত দশক ধরে দখলদার ইসরায়েল কোনও আন্তর্জাতিক আইন ও রীতিনীতির ভ্রুক্ষেপ না করে ফিলিস্তিনি জনগণের ওপর গণহত্যা, মানবতাবিরোধী অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধ চালিয়ে এসেছে। আর এ কাজে পাশ্চাত্য দেশগুলো তেল আবিবকে বাধা দেওয়ার পরিবর্তে সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতা করেছে। এই হামলা তারই প্রতিক্রিয়া।

ইসরায়েল গত সাত দশক ধরে জাতিগত বিদ্বেষকে পুঁজি করে এক ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধ করেই যাচ্ছিল। যার ফলাফল ক্রমাগত কমতে থাকা ফিলিস্তিন ভূখণ্ডের সাধারণ মানুষ ভোগ করছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালত সংঘবিধি বা যেটাকে আমরা রোম সংঘবিধি বলি, এর অনুচ্ছেদ ৭-এ মানবতাবিরোধী অপরাধকে বর্ণনা করা হয়েছে। মানবতাবিরোধী অপরাধ বলতে মূলত কোনও সাধারণ জনসাধারণের ওপর নির্বিচারে এবং পরিকল্পিতভাবে চালানো অপরাধকে বোঝানো হয়। অনুচ্ছেদ ৭-এর ব্যাপ্তিটা আসলে অনেক বড়, এখানে হত্যা, নির্যাতন, সাধারণ মানুষকে জোরপূর্বক স্থানান্তরিত করা, ধর্ষণ বা সন্তান জন্মদানে অক্ষম করে দেওয়া, গুম এবং জাতিগত বিদ্বেষ ছড়ানো উল্লেখযোগ্য অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করার পাশাপাশি একটা অসাধারণ ক্লজ যুক্ত করা হয়েছে, সেটা হচ্ছে যেকোনও অমানবিক কাজ- নির্যাতন  যা মানুষের শারীরিক মানসিক ক্ষতির কারণ হতে পারে, সেটাই মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে গণ্য করা যায়।

ইসরায়েল আত্মরক্ষার নামে ফিলিস্তিনি সাধারণ মানুষের ওপর যে নির্বিচারে বিমান হামলা চালাচ্ছে তা নিঃসন্দেহে মানবতাবিরোধী অপরাধ। তবে অত্যন্ত দুঃখের বিষয়, ইসরায়েল এবং তার মিত্র আমেরিকা আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের সংঘবিধি স্বাক্ষর করেনি। তারা পৃথিবীব্যাপী যুদ্ধ করে বেড়াবে কিন্তু তাদের যুদ্ধাপরাধের বিচার আন্তর্জাতিক আদালত করতে পারবে না। আন্তর্জাতিক আইন ও আইনের শাসনের সঙ্গে কী নির্মম তামাশা! রোম সংঘবিধি বাদ দিলাম, ইসরায়েল ৭ অক্টোবরের হামলার পর ফিলিস্তিনের প্রতি সর্বাত্মক যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যুদ্ধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইনও কি তারা মানে? যুদ্ধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন নিয়ে ১৯৪৯ সালের  ৪টি জেনেভা কনভেনশন রয়েছে। তার মধ্যে চতুর্থটির ১৫৯টি অনুচ্ছেদে শুধু সাধারণ মানুষ নারী ও শিশুদের সুরক্ষার কথা বলা হয়েছে, যার প্রায় প্রতিটি ইসরায়েল প্রতিনিয়ত ভঙ্গ করে চলেছে, যা যুদ্ধাপরাধ।

যুদ্ধাপরাধের সবচেয়ে জ্বলন্ত উদাহরণ হচ্ছে গাজার হাসপাতালে বিমান হামলা। প্রায় ৫০০ জন ফিলিস্তিনি মারা যাওয়া ওই হামলা ইতিহাসের নিকৃষ্টতম যুদ্ধাপরাধের একটি হবে। বিষয়টি আন্তর্জাতিক আইনের ভবিষ্যৎ ও আইনের শাসনের প্রতি চরম অবজ্ঞা। যুদ্ধ সংক্রান্ত আন্তর্জাতিক আইন জেনেভা কনভেনশনের কাস্টোমারি রুলস ২৮ এবং ৩৫ পরিষ্কারভাবে বলে দিয়েছে, হাসপাতাল, সেফটিজোন এবং নিরপেক্ষ স্থান কোনও সময়ই কোনও আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হতে পারে না। এ ধরনের হামলা পরিষ্কার যুদ্ধাপরাধ।

তবে ইসরায়েল এবং তার পশ্চিমা মিত্ররাই শেষ কথা নয়। যুগে যুগে মানুষ মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছে। নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের পাশে দাঁড়ানো, বিশেষ করে ফিলিস্তিনের মুক্তিকামী জনগণের পাশে দাঁড়ানো আমাদের নৈতিক এবং আইনগত দায়িত্ব। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, ১৯৭৩-এর চতুর্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধও শুরু হয় অক্টোবর মাসে। অক্টোবরের ৬ তারিখ শুরু হওয়া ওই যুদ্ধ ২০ দিন স্থায়ী হয়েছিল। স্বাধীন দেশ হিসেবে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে বাংলাদেশের তখন কোনও অবস্থান নেই, সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ তখন অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। এরমধ্যে এই যুদ্ধের খবর যখন বঙ্গবন্ধুর কানে পৌঁছালো, তিনি একমুহূর্ত দেরি করেনি ফিলিস্তিনসহ ওই যুদ্ধে পক্ষভুক্ত সব আরব দেশের পাশে দাঁড়াতে। বঙ্গবন্ধুকে যখন বলা হয়েছিল আরব দেশগুলো তখনও বাংলাদেশকে সমর্থন করেনি বা স্বীকৃতি দেয়নি এবং সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশ এত বড় ঝুঁকি নিবে কিনা? বঙ্গবন্ধু তার দৃঢ়চেতা মনোভাব থেকে একবিন্দুও নড়েনি, তিনি মুসলিম ভ্রাতৃত্ববোধকে প্রাধান্য দিয়ে সেদিনই যুদ্ধে আহত অসুস্থ আরব সৈনিকদের জন্যে বাংলাদেশ আর্মির মেডিক্যাল টিম এবং কিছু অন্যান্য সহায়তা পাঠানোর আদেশ দিয়েছিলেন।

বাংলাদেশই সর্বপ্রথম চতুর্থ আরব-ইসরায়েল যুদ্ধে সামরিক সহায়তা প্রদানকারী দেশ। বঙ্গবন্ধুর ওই  সিদ্ধান্ত কৃতজ্ঞতাসহ পরের দিনই সব আরব দেশের রেডিওতে প্রচার করা হয়েছিল। বাংলাদেশের সামরিক বাহিনীর মেডিক্যাল টিমের সদস্যরা সামরিক পোশাকেই সেদিন সেখানে গিয়েছিল, অন্যদিকে তার কিছু দিন পর পাকিস্তানও মেডিক্যাল টিম পাঠায়, কিন্তু তাদের সামরিক বাহিনীর সদস্যরা সামরিক পোশাক পরার সাহস করেনি, তারা সিভিল পোশাকে সহায়তায় কাজে অংশগ্রহণ করেছিল। বঙ্গবন্ধুর সেদিনের সেই সাহসী এবং সরাসরি সহায়তার সিদ্ধান্ত আরব বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি সম্পূর্ণ পরিবর্তন এবং স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের স্বীকৃতি লাভে সহায়তা করেছিল, যার ফল হিসেবে দ্রুত বাংলাদেশ অর্জন করেছিল ওআইসির সদস্য পদ।

পরের বছর ১৯৭৪ সালে ইয়াসির আরাফাত বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কৃতজ্ঞতা জানাতে দেখা করেন এবং ঢাকায় প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশন (পিএলও)-এর অফিস খোলেন। সুতরাং ঐতিহাসিকভাবেই বাংলাদেশ তার সৃষ্টির সময় থেকেই ফিলিস্তিনের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষের পাশে আছে এবং তাদের সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে। ইসরায়েলের চলমান নৃশংস মানবতাবিরোধী এই হামলায় শিশু, নারী ও সাধারণ ফিলিস্তিনিরা মারা যাচ্ছে, বাংলাদেশ সরকার ইতোমধ্যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে। তবে যুদ্ধ দীর্ঘায়িত হলে ফিলিস্তিনিদের জান-মাল রক্ষায় বাংলাদেশকে আরও সক্রিয় হতে হবে এবং ইসরায়েলের আগ্রাসী মনোভাব বন্ধে আন্তর্জাতিক চাপ সৃষ্টিতে সচেষ্ট হতে হবে।

বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সবসময় সত্য, ন্যায় ও নিপীড়িত মানুষের পক্ষে, সুতরাং আমরা আশা করতেই পারি তিনি ইসরায়েলের এই মানবতাবিরোধী অপরাধের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত গঠনে বাংলাদেশকে নেতৃত্বের জায়গায় নিয়ে যাবেন।  

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, আইন বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ