X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

শান্তিতে নোবেল জয় বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ, না অভিশাপ

মো. জাকির হোসেন
০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭:৫৩আপডেট : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৪, ১৭:৫৩

স্বল্পোন্নত থেকে উন্নয়নশীল দেশে উত্তরণের সারিতে অপেক্ষমান বাংলাদেশে রাজনীতি, অর্থনীতি, দুর্নীতি, অর্থপাচার, মূল্যস্ফীতি, লাগামহীন দ্রব্যমূল্যসহ এন্তার সমস্যা। এ সময় নতুন সমস্যা আর অশান্তির বার্তা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে ‘ড. ইউনূস ইস্যু’। অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস ক্ষুদ্রঋণ প্রদানে অবদানের জন্য শান্তিতে নোবেল পুরস্কার পেয়েছেন। কোনও কোনও লেখক অধ্যাপক ইউনূসকে ক্ষুদ্রঋণ প্রবক্তা বা ইংরেজিতে ‘মাইক্রোক্রেডিট গডফাদার’ আখ্যায়িত করলেও গবেষণা বলছে অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতেই দারিদ্রবিমোচনের লক্ষ্যে জামানতবিহীন ক্ষুদ্রঋণের প্রাতিষ্ঠানিক প্রচলন ছিল।

কানাডার টরেন্টো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগ থেকে প্রকাশিত Aidan Hollis ও Arthur Sweetman এর গবেষণা প্রবন্ধে উল্লেখ করা হয়েছে, “In the mid-nineteenth century hundreds of loan fund societies were making small loans to as many as 20% of Irish households. These community-based institutions originated in the early 1700s, but mushroomed in the 1830s after Parliament took legislative action to encourage them as part of an effort to stimulate privately funded poverty relief. Many of the funds survived the Great Famine and some continued to operate into the twentieth century. This institution offers both a new perspective on capital formation in the Irish economy and a well-documented case study of the development of an institution designed to lend small sums to the poor.”

Julia Kagan লিখিত “Microfinance Definition: Benefits, History, and How It Works” শিরোনামে আরেকটি প্রবন্ধ থেকে জানা যায়, “Microfinance isn't a new concept. Small operations of this type have existed since the 18th century. The first occurrence of microlending is attributed to the Irish Loan Fund system, introduced by Jonathan Swift, which sought to improve conditions for impoverished Irish citizens. In its modern form, microfinancing became popular on a large scale in the 1970s. The first organization to receive attention was the Grameen Bank, started in 1983 by Muhammad Yunus in Bangladesh.”

Hari Srinivas তার লেখায় উল্লেখ করেছেন, “As far back as 1720, an Irish pastor and writer, Jonathan Swift, started the first Irish Loan Fund, providing loans without collateral to the poor of Dublin. The first formal Asian micro bank was the Priyayi Bank of Purwokerto in Java, Indonesia that was set up in 1895, and which is the predecessor of the current BRI.”

ক্ষুদ্রঋণ নিয়ে কাজ করে শান্তিতে নোবেল প্রাপ্তি ড. ইউনূস ও বাংলাদেশের জন্য সৌভাগ্যের ও গর্বের। ড. ইউনূসের নোবেল প্রাপ্তিতে তৎকালীন বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন না জানালেও বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে অভিনন্দন ও ফুলেল শুভেচ্ছা জানানো হয়। সাশ্রয়ী মূল্যের মোবাইল প্রযুক্তির মাধ্যমে শহর ও গ্রামীণ অঞ্চলে সেতুবন্ধন স্থাপন এবং প্রযুক্তির ব্যবহারের পার্থক্য কমানোর লক্ষ্যে ড. ইউনূসের উদ্যোগের পাশে দাঁড়ান বঙ্গবন্ধুকন্যা। ছিয়ানব্বইয়ের নির্বাচনে সরকার গঠনের পর ১৯৯৭ সনে ড. ইউনূসকে পল্লীফোন (বর্তমানে গ্রামীণ টেলিকম) চালুর অনুমতি প্রদান করেছিলেন তৎকালীন সরকার প্রধান বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।

প্রশ্ন হলো, সম্প্রতি বঙ্গবন্ধুকন্যাকে প্রতিপক্ষ বানিয়ে কখনও ৪০, কখনও নোবেলবিজয়ীসহ ১৬০ জন কিংবা ২৪২ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি, কিংবা ১২ জন মার্কিন সিনেটরকে দিয়ে বিবৃতি বা পত্র প্রেরণ করে; বিদেশি পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে বিবৃতি ছাপিয়ে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির হীন চেষ্টায় কেন অবতীর্ণ হলেন ড. ইউনূস? এর মাধ্যমে ড. ইউনূস নিজেও অসম্মানিত হচ্ছেন, রাষ্ট্রকেও বিপজ্জনক সম্মানহানির দিকে ঠেলে দিচ্ছেন।

সরকারের সাথে ড. ইউনূসের বিরোধ বিচার বিভাগকে ক্রসফায়ারে ফেলেছে। ইউনূস সমর্থক দেশি-বিদেশি একটি স্বার্থান্বেষী মহল বিচার বিভাগকে প্রশ্নবিদ্ধ করার অপচেষ্টা চালাচ্ছে। ড. ইউনূসের বিচারের জন্য বিশেষ কোনও আদালত সৃষ্টি করা হয়নি কিংবা স্বতন্ত্র বিচারকও নিয়োগ করা হয়নি। ১৭ কোটি মানুষের জন্য যে আদালত ও বিচারক ড. ইউনূসের জন্যও সেই আদালত ও বিচারকগণ।

সামরিক শাসক জিয়ার মতো গোপন ক্যাঙারু আদালতে নয়, প্রকাশ্য আদালতে বিচার হচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী পৌনঃপুনিক পত্রপ্রেরক ও বিবৃতিদাতাদের বিচারকাজ পর্যবেক্ষণের আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ড. ইউনূসকে অযথা মামলা দিয়ে হয়রানি করা হচ্ছে কিনা আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞরা তা চাইলে এসে দেখে যেতে পারেন। এরপরও বিবৃতিবাজরা ড. ইউনূসের বিচারকে প্রহসন আখ্যায়িত করে মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া বন্ধের আহ্বান জানিয়েছেন।

এটি রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব, সংবিধান ও বিচার বিভাগের ওপর নগ্ন হস্তক্ষেপ। বাংলাদেশের সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৯৪(৪) অনুযায়ী বিচারকগণ তাদের বিচারিক কাজে সম্পূর্ণভাবে স্বাধীন। সংবিধান অনুযায়ী প্রধানমন্ত্রীসহ রাষ্ট্রপরিচালনায় যুক্ত কারোরই বিচার প্রক্রিয়ায় হস্তক্ষেপ করার কোনও এখতিয়ার নেই। পত্রের বক্তব্য ও বিবৃতি বাংলাদেশের সংবিধান ও আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও) স্বীকৃত শ্রমিকদের মৌলিক অধিকারের পরিপন্থি।

এই চিঠিতে ও বিবৃতিতে ‘নিরপেক্ষ’ বিচারকের মাধ্যমে ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগ বিচারের যে আহ্বান জানানো হয়েছে, তা বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থাকে হেয় প্রতিপন্ন করার সামিল। এটি যে কোনও রাষ্ট্রের জন্য বিপজ্জনক। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ও সাম্প্রতিক জরিপের ফল অনুযায়ী আগামী নির্বাচনের সম্ভাব্য প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তার বিচারকার্যে নিয়োজিত বিচারকদের নিরপেক্ষতা ও বিচারের রায়ের ন্যায্যতা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি এই ঘটনাকে যুক্তরাষ্ট্রে আইনের শাসনের মৃত্যু বলে আখ্যায়িত করেছেন।

ট্রাম্পের বিচারের জন্য কি বিবৃতিবাজরা নিরপেক্ষ বিচারকের মাধ্যমে বিচারের আহ্বান জানাবেন? বিচার প্রক্রিয়া বন্ধ করতে বলবেন? তা করবেন না। কারণ বাংলাদেশে ড. ইউনূসের বিষয়ে বিবৃতি প্রদান ও পত্র প্রেরণের পিছনে বিশেষ স্বার্থ ও পরিকল্পিত উদ্দেশ্য রয়েছে।

ড. ইউনূসের বিচার বন্ধের বিবৃতি ও পত্র প্রেরণের সাথে যখন ‘বেমক্কা’ ও ‘বেফজুল’ভাবে বাংলাদেশের নির্বাচন ও রাজনীতি সংযুক্ত করা হয় তখন সেই ষড়যন্ত্রের গোমর ফাঁস হয়ে যায় বৈকি।

সরকারের সাথে ড. ইউনূসের দৃশ্যমান বিরোধের শুরু হয় যখন তিনি রাষ্ট্রের আইন মানতে অস্বীকৃতি জানান। পৃথিবীর সব দেশে একটি সার্বজনীন নিয়ম হলো– সরকারি-বেসরকারি পেশা থেকে সবাইকে এক সময় অবসর গ্রহণ করতে হয়। গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদ থেকে অবসরের বয়স হলো ৬০ বছর। ড. ইউনূস অবসর আইনের বিধান ১০ বছর ধরে লঙ্ঘন করে ৭০ বছর বয়সেও গ্রামীণ ব্যাংকের এমডি পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন।

ড. ইউনূস শান্তিতে নোবেল জয়ের কয়েক বছর পরের ঘটনা। নরওয়ের একজন সাংবাদিক নরওয়েজিয়ান টেলিভিশন চ্যানেলের জন্য গ্রামীণ ব্যাংক নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেন। সে প্রতিবেদনটি প্রচারিত হলে তুমুল হৈচৈ শুরু হয়। কারণ প্রতিবেদনটিতে গ্রামীণ ব্যাংকের অন্যান্য অনিয়মের পাশাপাশি গ্রামীণ ব্যাংক থেকে গ্রামীণ কল্যাণে ফান্ড ট্রান্সফারের বিষয়টি তুলে ধরা হয়েছিল। এ নিয়ে নরওয়ের দূতাবাস, এবং পরে নরওয়ের পার্লামেন্ট এবং মন্ত্রিপরিষদে আলোচিত হতে থাকে। কয়েক দফা চিঠি চালাচালিও হয়। নরওয়ের সরকারের আপত্তির মুখে একসময় গ্রামীণ কল্যাণ থেকে তহবিলটা গ্রামীণ ব্যাংকে ফেরত নেওয়া হয়।

গ্রামীণ ব্যাংকের সুদের হার ও কিছু ক্ষেত্রে এর অমানবিক আদায় পদ্ধতি সংবাদপত্রের শিরোনাম হতে থাকে। এমতাবস্থায়, অর্থ মন্ত্রণালয় গ্রামীণ ব্যাংকের বিষয়ে একটি রিভিউ কমিটি গঠন করে এবং সরকারের পক্ষ থেকে ড. ইউনূসকে তার বয়সসীমা পেরিয়ে যাওয়ার বিষয়টি জানিয়ে দেওয়া হয়। নানা অভিযোগ সত্ত্বেও ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে কোনোপ্রকার ডিসিপ্লিনারি অ্যাকশন যেমন, ডিসমিসাল, টার্মিনেশন, ফোর্সড রিটায়ারমেন্ট ইত্যাদি কোনও আইনগত ব্যবস্থাই নেওয়া হয়নি। বরং ২০১১ সালে ৭০ বছর বয়সে ড. ইউনূসকে পদত্যাগ করে ‘ইমেরিটাস উপদেষ্টা’ হিসাবে কাজ করার জন্য অনুরোধ করা হয়েছিল। কিন্তু তিনি প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন এবং সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করেন। অবশেষে সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আইনি লড়াইয়ে হেরে যান তিনি।

এটাকে কি সরকারের অন্যায় আক্রমণ বলা যাবে? ড. ইউনূস এমডি পদ ফিরে পেতে যে মামলা করেন তার আর্জিতে উল্লেখ করেন যে, তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা। এটি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং এর ৯৭ ভাগ শেয়ারহোল্ডার দরিদ্র নারী। আদালত রায়ে সুস্পষ্টভাবে জানিয়ে দেন, সুপ্রিম কোর্টের ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠার পেছনে উদ্যোক্তা ছিলেন মাত্র। তিনি এর প্রতিষ্ঠাতা নন। বাংলাদেশ রাষ্ট্রের পক্ষে বাংলাদেশ সরকারই গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছেন। কারণ গ্রামীণ ব্যাংক একটি বিধিবদ্ধ রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠান, বেসরকারি ব্যাংক নয়। তিনি গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাকালীন ব্যবস্থাপনা পরিচালক।

১৯৮৩ সালের ৪ সেপ্টেম্বর সরকার গ্রামীণ ব্যাংক অধ্যাদেশ নামে একটি অধ্যাদেশ (অধ্যাদেশ নম্বর-৪৬) জারি করে। সে সময়ে গ্রামীণ ব্যাংক শুরু হয় মাত্র তিন কোটি টাকা মূলধন দিয়ে। এর মধ্যে বেশিরভাগ টাকা অর্থাৎ ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা ছিল সরকারের এবং ১ কোটি ২০ লাখ টাকা ছিল ঋণ গ্রহীতাদের। অর্থাৎ গ্রামীণ ব্যাংকে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ব্যক্তিগত কোনও টাকা ছিল না।

দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য, আইনি লড়াইয়ে হেরে যাওয়ার পর গ্রামীণ ব্যাংকে এমডি পদ পুনরুদ্ধার করার জন্য ড. ইউনূস বিদেশি শক্তি, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্র এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সংস্থার সঙ্গে লবিং করেন। ইউরোপের বিভিন্ন দেশের আইন প্রণেতা, তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিলারি ক্লিনটন এবং তৎকালীন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের স্ত্রী চেরি ব্লেয়ারকে লবিং করে তার পক্ষে সিদ্ধান্ত পরিবর্তনের জন্য সরকারকে চাপ দেন।

ব্যক্তিগত সমস্যা সমাধানের জন্য একাধিক রাষ্ট্র ও সংস্থার শরণাপন্ন হওয়া একজন নোবেল বিজয়ীর জন্য মোটেও সমীচিন নয়।

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে নিষ্পত্তিকৃত দ্বিতীয় মামলাটিও দায়ের করেন ড. ইউনূস। ১৯৯০ সালের দানকর আইন অনুযায়ী মোট তিন করবর্ষের কর দাবি করে তাকে নোটিশ দেয় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)।

দানের বিপরীতে কর দাবি করে এনবিআরের ওই তিনটি নোটিশের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে ট্যাক্স ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন ড. ইউনূস। মামলায় ড. ইউনূসের দাবি, আইন অনুযায়ী দানের বিপরীতে এনবিআর এই কর দাবি করতে পারে না।

২০১৪ সালের ২০ নভেম্বর ড. ইউনূসের আবেদন খারিজ করেন আদালত। এরপর ২০১৫ সালে তিনি হাইকোর্টে তিনটি রিট মামলা করেন। দানকর আইনের ৪ ধারা অনুসারে ড. ইউনূসের দানকর রেয়াতের আওতাভুক্ত ছিল না বলে হাইকোর্টের কাছে প্রমাণিত হয়। হাইকোর্ট ড. ইউনূসকে ২০১১, ২০১২ ও ২০১৩ সালের দানকর বাবদ বকেয়া ১২ কোটি টাকারও বেশি এনবিআরকে পরিশোধ করার আদেশ দেন। রায়ের বিরুদ্ধে তিনি আপিল বিভাগে আইনি লড়াই করে হেরে যান এবং ১২ কোটি টাকা কর পরিশোধ করেন।

প্রশ্ন হলো, এই রায় কি বিচারের নামে প্রহসন? ১৯৯০ সালের দানকর আইনের ৩ ধারায় বলা হয়েছে কোনও ব্যক্তি কর্তৃক কোনও আর্থিক বছরে সম্পাদিত সব দানের ওপর তফসিলে বর্ণিত হারে কর পরিশোধ করবেন। অর্থাৎ কোনও আর্থিক বছরে সম্পদ দানের যে কার্যক্রম সম্পাদিত হয়, তার কর দায় তফসিল (সরকার প্রদত্ত) মোতাবেক দানকারী ব্যক্তিকে পরিশোধ করতে হবে। দানকর আইনের বিধান অনুযায়ী  প্রথম পাঁচ লাখ টাকার ওপর ৫ শতাংশ, পরবর্তী ১০ লাখ টাকার ওপর ১০ শতাংশ, পরবর্তী ২০ লাখ টাকার ওপর ১৫ শতাংশ এবং পরবর্তী অংকের ওপর ২০ শতাংশ হাতে দানকর প্রদান করতে হবে। আবার একই আইনে কাকে, কীভাবে দান করা হলে তা থেকে দানকারী ব্যক্তি কর মওকুফের আওতায় আসতে পারে, সে বিষয়টিও স্পষ্টভাবে উল্লেখ করা হয়েছে।

দানকর আইন, ১৯৯০-এর ৪ ধারা অনুসারে দানকর থেকে অব্যাহতি পাওয়ার বিষয়টি প্রযোজ্য হবে।

নিম্নোক্ত দানগুলো করমুক্ত: (ক) দানকৃত সম্পত্তি যদি বাংলাদেশের বাইরে অবস্থিত হয়; (খ) দান যদি সরকার বা কোনো স্থানীয় কর্তৃপক্ষকে করা হয়; (গ) দান যদি দাতব্য উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত নিম্নবর্ণিত কোনও তহবিল বা প্রতিষ্ঠানকে করা হয়;

যথা–

(অ) বাংলাদেশে প্রচলিত কোনও আইন দ্বারা প্রতিষ্ঠিত কোনও বিশ্ববিদ্যালয় বা শিক্ষা বোর্ডের স্বীকৃতিপ্রাপ্ত অথবা সরকার কর্তৃক স্বীকৃত বা পরিচালিত কোনও পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটসহ যে কোনও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান;

(আ) সরকার বা কোনও স্থানীয় কর্তৃপক্ষ কর্তৃক স্বীকৃত বা পরিচালিত অথবা সরকার বা কোনও স্থানীয় কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে সাহায্যপ্রাপ্ত কোনও হাসপাতাল;

(ই) সরকার কর্তৃক গঠিত বা অনুমোদিত কোনও বন্যা বা দুর্যোগ মোকাবিলা তহবিল;

(ঈ) সাধারণ জনগণের কল্যাণার্থে পরিচালিত নয় এমন কোনও ব্যক্তিগত ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান ছাড়া ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত ও সরকার কর্তৃক অনুমোদিত বা ধর্মীয় বা দাতব্য উদ্দেশ্যে প্রতিষ্ঠিত ও প্রচলিত আইনে নিবন্ধিত কোনও প্রতিষ্ঠানকে করদাতা কর্তৃক সংশ্লিষ্ট কর বছরের নিরূপিত মোট আয়ের ২০ শতাংশ বা ১ লাখ টাকা, এই দুটির মধ্যে যা কম হয়;

(ঘ) দান যদি ভরণপোষণের জন্য দাতার ওপর নির্ভরশীল কোনও আত্মীয়ের বিয়ের সময় সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকার মূল্য পর্যন্ত করা হয়;

(ঙ) দান যদি স্ত্রী ছাড়া, ভরণপোষণের জন্য দাতার ওপর নির্ভরশীল কোনও আত্মীয়কে সর্বোচ্চ ২০ হাজার টাকা মূল্য পর্যন্ত বিমা বা বার্ষিক বৃত্তির পলিসি দ্বারা করা হয়;

(চ) দান যদি উইলমূলে করা হয়;

(ছ) দান যদি মৃত্যুচিন্তায় করা হয়;

(জ) দান যদি পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী, স্ত্রী, আপন ভাই অথবা আপন বোনকে করা হয়।

উল্লিখিত অব্যাহতি ছাড়াও কোনও ব্যক্তি কর্তৃক কোনও আর্থিক বছরে দানকৃত ২০ হাজার টাকা মূল্যের দানের ওপর এই আইনের আওতায় কোনও দানকর প্রদান করতে হবে না। এ ছাড়া সরকার, সরকারি গেজেটে প্রজ্ঞাপন জারি করে যে কোনও শ্রেণির দান অথবা যে কোনও শ্রেণির ব্যক্তিকে এই আইনের অধীন প্রদেয় কর থেকে অব্যাহতি দিতে পারে। উল্লিখিত খাতগুলোর বাইরে কেউ দান করলে সেই দানের ওপর দাতাকে কর প্রদান করতে হবে।

ড. ইউনূস ২০১১-১২ অর্থ বছরে ৬১ কোটি ৫৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাস্ট, ইউনূস ফ্যামিলি ট্রাস্ট ও ইউনূস সেন্টারে দান করেন।

২০১২-১৩ অর্থ বছরে তিনি ড. মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাস্টে ৮ কোটি ১৫ লাখ টাকা দান করেন। আর ২০১৩-১৪ অর্থ বছরে প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাস্ট, ইউনূস ফ্যামিলি ট্রাস্টে দান করেন ৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা।

এভাবে ৭৭ কোটি ৩৭ লাখ ৬৯ হাজার টাকা ট্রাস্টে স্থানান্তর করে ড. ইউনূস দাবি করেন, যেহেতু তিনি মৃত্যুচিন্তা ও নিকট আত্মীয়দের কল্যাণের কথা ভেবে ওই টাকা দান করেছেন, ফলে তিনি কর অব্যাহতি পাবেন। কারণ দানকর আইন, ১৯৯০-এর ৪ ধারার (ছ) ও (জ) উপধারায় এই কর অব্যাহতির বিষয়ে উল্লেখ আছে। এনবিআর দানকর আইন, ১৯৯০-এর ৪ ধারার (ছ) ও (জ) উপধারা তুলে ধরে এনবিআর যুক্তি দেয়, দান ও আয়কর রিটার্ন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, তিনি নিজেই ট্রাস্টগুলোর প্রতিষ্ঠাতা এবং ট্রাস্টি।

আইনের উদ্দেশ্য হলো কেউ গুরুতর আহত হয়ে বা অসুখে মৃত্যুশয্যায় থাকলে তার অর্থ-সম্পদ তিনি নিকট আত্মীয়দের দান করে থাকেন। একে মৃত্যুচিন্তায় দান বলা হয়। কিন্তু ড. ইউনূস দানের সময় তেমন কোনও পরিস্থিতিতে ছিলেন না বা এখনও নেই।

ফলে ‘মৃত্যুচিন্তা থেকে তিনি দান করেছেন’–এই যুক্তি অবান্তর ও অগ্রহণযোগ্য। দানকর আইন, ১৯৯০-এর ৪ ধারার (ছ) উপধারা অনুযায়ী পরিবারের সদস্যদের দানের ক্ষেত্রে বলা হয়েছে, দান যদি পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, স্বামী, স্ত্রী, আপন ভাই অথবা আপন বোনকে করা হয় তবে করদাতা কর অব্যাহতি পাবেন। কিন্তু ড. ইউনূস দান করেছেন ট্রাস্টে। এর মধ্যে ইউনূস সেন্টারের তিনজন ট্রাস্টির মধ্যে একজন ট্রাস্টি দাতা নিজে। আরেকজন ড. ইউনূসের আপন ভাই। আবার প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনূস ট্রাস্ট ও ইউনূস ফ্যামিলি ট্রাস্টের ট্রাস্টিরা করদাতার নিকট আত্মীয় নন। ফলে এ ক্ষেত্রে তিনি কর অব্যাহতি পেতে পারেন না। দানকর আইনের ২(১)(চ) ধারায় দানের সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, ‘দান বলতে এক ব্যক্তি কর্তৃক অন্য কোনও ব্যক্তিকে স্বেচ্ছায় অর্থ বা অর্থমূল্যের প্রতিলাভ ছাড়া কোনও স্থাবর বা অস্থাবর সম্পত্তি হস্তান্তর বুঝাইবে।’

ড. ইউনূস তার দান কোনও ব্যক্তির বরাবরে হস্তান্তর করেননি। প্রকৃত অর্থে ট্রাস্ট সৃষ্টি করে নিজেই সম্পত্তি ধারণ করে রেখেছেন। আর এর সুবিধাভোগী প্রধানত তিনি ও তার স্ত্রী ও কন্যারা। কেননা ট্রাস্ট দলিলে বলা হয়েছে এই ট্রাস্ট তাদের ভরণপোষণ, স্বাস্থ্যসেবা, ভ্রমন ও অন্যান্য ব্যয় বহন করবে। ড. ইউনূসের দান করা অর্থ তাই দানকর আইনের ৪(ছ) ও (জ) ধারায় দানকরমুক্ত নয়।

ড. ইউনূসের এই উদ্ভাবনকে আইনগতভাবে গ্রহণ করা হলে সকল ধনাঢ্য ব্যক্তি নিজের ও পরিবারের সদসদ্যদের জন্য এমন ট্রাস্ট তৈরি করে হাজার হাজার কোটি টাকা কর অব্যাহতি দাবি করবে।

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে তৃতীয় মামরা দায়ের করেছে তার গ্রামীণ টেলিকমের কর্মচারীগণ। গ্রামীণ টেলিকম কর্মচারীদের জন্য সংরক্ষিত লভ্যাংশের ৫ শতাংশ পরিশোধ না করা; আইনজীবীদের ফি এবং শ্রমিকদের বেতন থেকে অন্যান্য চার্জ হিসাবে ৬ শতাংশ অবৈধভাবে কর্তন এবং কর্মচারীদের কল্যাণ তহবিল থেকে ৪৫.৫২ কোটি টাকা আত্মসাৎ এর অভিযোগে ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মালিকানাধীন গ্রামীণ টেলিকমের অবসায়ন চেয়ে মামলা করা হয়। গ্রামীণ টেলিকমের শ্রমিক কর্মচারী ইউনিয়নের পক্ষে গ্রামীণ টেলিকমের ১৭৬ জন কর্মচারী ড. মুহাম্মদ ইউনূস ও গ্রামীণ টেলিকমের বিরুদ্ধে সব মিলিয়ে ১১০টি মামলা করেছিল। এর মধ্যে শ্রম আদালতে ১০৪টি ও হাইকোর্টে ছয়টি মামলা হয়েছিল। সব মিলিয়ে ৪৩৭ কোটি টাকা দাবি করে মামলা করেছিলেন ওই শ্রমিকরা।

প্রায় পাঁচ বছর ধরে মামলা চলার পর ২০২২ সালের মে মাসে আদালতের বাইরে ড. ইউনূস ও শ্রমিকদের মধ্যে সমঝোতা চুক্তির মাধ্যমে ১১০টি মামলার সবক’টি প্রত্যাহার করা হয়। 

গ্রামীণ টেলিকমের ১৭৬ জন শ্রমিককে পাওনা বাবদ ড. ইউনূস ৪০০ কোটি টাকা দিয়েছেন বলে বিচারপতি মুহাম্মদ খুরশীদ আলম সরকারের একক কোম্পানি বেঞ্চে এ তথ্য জানান শ্রমিকদের আইনজীবী অ্যাডভোকেট ইউসুফ আলী।

ড. ইউনূস শ্রমিকদের অধিকারের ব্যত্যয় করে না থাকলে কেন ৪০০ কোটি টাকা দিয়ে শ্রমিকদের সাথে আপসরফা করলেন? এই মামলায় কোথায় বিচারের নামে প্রহসন হলো?

বরং শ্রমিকদের সাথে আপস-রফার এই ঘটনাকে বিকৃত করে মামলাগুলোকে অপ্রমাণিত বলে প্রচার চালানো হয়েছে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে। এজন্য চিঠিতে মার্কিন সিনেটররা লিখেছেন, কমপক্ষে এক দশক ধরে বাংলাদেশে অন্তত ১৫০টি অপ্রমাণিত বিষয়ে মামলা করা হয়েছে ইউনূসের বিরুদ্ধে।

ড. ইউনূসের বিরুদ্ধে যেসব মামলা বিচারাধীন আছে তা নিয়ে আলোচনা, মন্তব্য আইনত নিষিদ্ধ। তাই ওইসব মামলা এই প্রবন্ধে উল্লেখ করার সুযোগ নেই। 

ড. ইউনূস পশ্চিমের রাজনৈতিক অভিজাতদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ ও নোবেল বিজয়ীদের ব্যক্তিস্বার্থে ব্যবহার করেছেন। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও বিচার বিভাগের ওপর বাইরের শক্তির অযাচিত হস্তক্ষেপের সুযোগ করে দিয়েছেন। শ্রমিক স্বার্থ উপেক্ষা করে ইউনূসের পক্ষে মার্কিন সিনেটরদের চিঠি তারই প্রমাণ। ইতিহাস সাক্ষ্য দিবে শান্তিতে নোবেল বিজয় বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ, না অভিশাপ হয়ে উঠেছিলো?

লেখক: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

ইমেইল: [email protected]

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ