X
সোমবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৪
১৫ বৈশাখ ১৪৩১

খালিদের হিমালয় সমান কী এমন দুঃখ ছিল?

আহসান কবির
২২ মার্চ ২০২৪, ২০:০২আপডেট : ২২ মার্চ ২০২৪, ২০:০২

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সার্জেন্ট জহুরুল হক হলের ৩০৩ নম্বর রুমে গিয়েছি, সালটা হবে ১৯৮৫। সেখানে থাকতেন হাসিব নওয়াজ খান, যিনি এখন আর পৃথিবীতে নেই। হাসিব ভাই রুমে ছিলেন না। পাশের ৩০২ নম্বর রুম থেকে বাঁশির সুর ভেসে আসছিল। আমি রুমের সামনে গিয়ে দাঁড়ালে যিনি বাঁশি বাজাচ্ছিলেন তিনি সহসা থামলেন না। বাঁশি বাজানো শেষ করে এবার তিনি শিস বাজানো শুরু করলেন– এই রাত তোমার আমার/ শুধু দুজনের…

ইচ্ছেমতো শিস বাজানো শেষ করে জানতে চাইলেন– ‘রিফিউজি’?

আমি থমকে গেলাম। আমি যে সত্যি ‘রিফিউজি’ সেটা ‘শিসমানব’ জানলো কীভাবে? বাসা থেকে আগেই বেরিয়ে এসেছি। থাকার কোনও ঠিক নেই। দুদিন পর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষা। স্কুলজীবনের বড় ভাই হাসিব নওয়াজ খানই ছিলেন ভরসা, তাই তার কাছেই আসা। আমি উত্তর দিলাম–

-জি, আমি রিফিউজি। পরীক্ষা দেবো। হাসিব ভাইয়ের কাছে এসেছিলাম। তবে আমার মনে হচ্ছে আপনি সেই জন যিনি একটা সুন্দর বাইসাইকেলে চড়ে মিলু ভাইদের প্র্যাকটিস দেখতে যেতেন!

শিসমানবের মন নরম হলো। তিনি রুমে এসে বসতে বললেন। রুমের ভেতর সুন্দর সোফা। দেয়ালে ছবি। মেঝেতে কার্পেট। বিশ্ববিদ্যালয়ের হল এত সুন্দর আর পরিপাটি হয়? শিসমানব বলা শুরু করলেন-

- হুম। আমি গোপালগঞ্জ থেকে সাইকেল চালিয়ে খুলনাতে গায়ক খালিদ হাসান মিলু ভাইদের প্র্যাকটিস দেখতে যেতাম। অবলীলায় তুমি করে বললেন–

- তোমার বাড়ি হয়তো খুলনা, তাই আমাকে সেখানে দেখেছো। তবে রুম দেখে মুগ্ধ হবার কিছু নেই। এটা মাস্তানি।

- বলেন কী? যারা গান গায়, বাঁশি বাজায় তারা মাস্তানি করতে পারে?

তখন সারা দেশে মাস্তান তথা ‘অমুক ভাই তমুক ভাইদের’ জয়জয়কার। শিসমানব বললেন-

- তিনটা কাজ করি এখন। গানটা করতেই চাই। ঢাকায় থাকতে হবে বলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি। আর খানিকটা মাস্তানি না থাকলে মানুষ দুর্বল ভাবে। জগৎজুড়ে মার খায় দুর্বলরাই। এই যে সোফা, ওটা হলের গেস্টরুমের। প্রয়োজন, তাই নিয়ে এসেছি। দেয়ালের ছবিটা ভালো লেগেছে বলে এক্সিবিশন থেকে নিয়ে এসেছি। নিজেরটা নিজের বুঝে নেওয়া ভালো। কী বলো?

নিজের ভালো কতটা বুঝতেন তিনি? এই শিসমানবের নাম খালিদ। পুরো নাম খালিদ আনোয়ার সাইফুল্লাহ। পড়তেন দর্শন বিভাগে। ভর্তি পরীক্ষা দেওয়ার পর হাসিব ভাইয়ের রুমেই থেকে গেলাম। ততদিনে আফজালুর রহমান খান সুদিন নামের একজনও জুটেছে। তার একটা ‘ডেইলিম’ মোটরসাইকেল আছে। আমরা সারা দিন ঢাকা শহরে ‘টো টো’ করি। জহুরুল হক হলের মাঠে খেলছি একদিন। হাসিব ভাই দৌড়ে এলেন। খালিদ ভাই অভিমান করে ঘুমের ওষুধ খেয়েছেন। তাকে মেডিক্যালে নিতে হবে। সুদিন আর আমি মাঝখানে খালিদ ভাইকে বসিয়ে নিয়ে গেলাম ঢাকা মেডিক্যালে। খালিদ ভাই সুস্থ হয়ে ফিরলেন। যার জন্য চিরঘুমে যেতে চেয়েছিলেন তাকে একদিন দেখলাম হলে। খালিদ ভাইকে নাকি বলে যেতে এসেছিলেন আর কখনও দেখা হবে না! জানি না এ কারণেই খালিদ ভাই এই গানটা এত দরদ দিয়ে গেয়েছিলেন কিনা- ‘বোঝাতে কী পেরেছি তোমাকে যে তা/ বিরহে নিহিত সেই সুখ বারতা/ যখন আমি থাকবো না তোমারই কাছে/ আমায় পাবে গীতি কবিতা মাঝে/ যাবার বেলায় শুধু সান্ত্বনা নয় কান্নায়!/ আবার দেখা হবে এখনই শেষ দেখা নয়!

এরপর আমার সঙ্গেও বহু দিন আর খালিদ ভাইয়ের দেখা হয়নি। খালিদ ভাই এর মাঝে ক্রমশ জনপ্রিয় হয়েছেন, তার গানের অ্যালবাম বেরিয়েছে।

‘কীর্তনখোলা নদীরে আমার’, ‘তুমি আর আমি আজ হারিয়ে যাবো’, ‘এক ঘরেতে বসত কইরা পাইলাম না তোমায়’সহ গানগুলো মানুষের প্রিয় হয়ে উঠেছে। ‘ও আমার হাঁসের ছাওরে’ কিংবা ‘নাতি খাতি বেলা গেলো শুতি পারলাম না’ গান দুটো ম্যাসিভ হিট হয়ে গেলে খালিদ ভাইকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। আশি ও নব্বই দশকের ব্যান্ড সংগীতের জোয়ারে খালিদ ভাইয়ের আসন হয়ে গেলো পাকাপোক্ত।

কিন্তু ব্যক্তিজীবনে পাকাপোক্ত ভাবটা ফেরেনি কখনও। শুরু থেকেই যেন রাজনৈতিক আর অর্থনৈতিক অস্থিরতা ভর করেছিল ব্যান্ড সংগীতের অনেক নায়কের ওপর। এদের জীবনযাপন আর সংগীত তাই সমান্তরাল পথে হাঁটেনি। খালিদ ভাইও এর বাইরে যেতে পারেননি। তার ‘চাইম’ ব্যান্ড দলের মতো জীবনও যেন ভেঙেছে বারবার। অনেকটা নচিকেতার গানের কাছাকাছি- ‘তখন উদাস মন/ ভুলে মনোরঞ্জন/ দাম দিয়ে যন্ত্রণা কিনতে চায়’। অস্থিরতা আর যন্ত্রণা বয়ে বেড়িয়েছেন কেন সেটা খালিদ ভাই ভালো জানেন।

১৯৯০ সাল। বুয়েটে চাইম ব্যান্ডের শো হচ্ছে। উপচে পড়া মানুষের ভিড়। রাতের অন্ধকারে খালিদ ভাই শিস বাজানো শুরু করলেন– ‘এই রাত তোমার আমার’... গান শেষে দেখা হলো। পরদিন আসার কথা বললেন। রাত তিনটায় এক মোটরসাইকেলে তিন জন এসে বুয়েটের সোহরাওয়ার্দী হলের ১০৮ নম্বর রুমের সামনে হইচই ফেলে দিলেন। জোছনা রাত। তাই ছাদের ওপর গিয়ে গান গাইবেন। রাতে ছাদের দরোজা খুলতে হলো। আমার বিরক্তিভাব দেখে খালিদ ভাই আর গান গাইলেন না। পরের সময়টার কথা আর না বলি! যাবার আগে বললেন- আর যদি দেখা না হয়?

তীব্র অভিমান নিয়ে খালিদ ভাই সেই যে গেলেন আর কখনও আগের মতো ফেরেননি। নিরাময়ের জন্য বারবার হাসপাতালে যেতে হয়েছে তাকে। গান গাওয়া এবং স্টেজ শোতে ছেদ পড়তো তারই কারণে। বন্ধুর বোনকে বিয়ে করা এবং ছেলের মুখ দেখার পর জীবনে থিতু হওয়ার কথা ছিল। সেটাও হয়নি। গান আর অস্থিরতার জগৎ থেকে দূরে রাখার জন্য পরিবারের পক্ষ থেকে প্রথমে পাঠানো হয়েছিল মধ্যপ্রাচ্যের এক দেশে। সেখানেও থিতু হতে পারেননি খালিদ ভাই। পরে আরেকবার তাকে পাঠানো হয়েছিল আমেরিকায়। তার স্ত্রী এবং ছেলে সেখানেই থিতু হয়েছেন। করোনাকালে খালিদ ভাইয়ের স্ত্রী করোনায় আক্রান্ত হন। ছেলেকে নিয়ে দীর্ঘ সংগ্রাম তারও। কিন্তু খালিদ ভাই সেখানেও থাকতে পারেননি বেশি দিন। দেশে ফিরে আসেন একা, আড্ডাই ছিল তার সময় কাটানোর উপায়, আবার এই আড্ডাই ছিল সর্বনাশ!

গান গাইতে চেয়েছিলেন, তার জন্যই গানের জীবনে ছেদ পড়তো কিন্তু প্রায় একটা মানুষের কারণে বারবার ফিরে আসতেন গানে। এই মানুষটার নাম গীতিকার ও সুরকার প্রিন্স মাহমুদ। ‘আবার দেখা হবে’ গানটা প্রিন্স মাহমুদ খালিদ ভাইকে দিয়ে গাইয়েছিলেন ১৯৯৪ সালে। মানুষের হৃদয়ে দোলা দিয়ে যায় এই গান, যা আজও শুনতে ভালো লাগে। পরের বছর অর্থাৎ ৯৭ সালে ‘নীরা ক্ষমা করো আমাকে’ গানটাও ঝড় তোলে। ৯৮ সালে প্রিন্সের করা ‘আকাশলীনা তুমি বলো কীভাবে’ গানটাও আলোচিত হয়। যতবার তার গানের জীবনে ছেদ পড়েছে ততবার নতুন কোনও গান নিয়ে তিনি ফিরে এসেছেন। ১৯৯৯ সালে প্রিন্স মাহমুদের সুরে ‘এখনও দুচোখে বন্যা’ অ্যালবামে খালিদের গাওয়া-‘ কোনও কারণেই ফেরানো গেলো না তাকে/ ফেরানো গেলো না কিছুতেই’ ম্যাসিভ হিট হয়ে যায়, যা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে! এ বছরের শেষে প্রিন্সের আরেক অ্যালবামের গান ‘হয়নি যাবার বেলা’ও হৃদয়ে দাগ কেটে যায়।

সাত বছর পরে আবারও গানে ফেরেন খালিদ। ২০০৬ সালে প্রিন্সের ‘দেবী’ অ্যালবামের গান ‘যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে’ দারুণ জনপ্রিয় হয়, যা আজও মানুষের মুখে মুখে ফেরে। জনপ্রিয়তার তালিকায় তার সর্বশেষ গান ‘ঘুমাও তুমি ঘুমাও গো জান’ কিংবা ‘আমায় যদি পড়ে মনে’। এরপর নতুন গানের চেয়ে স্টেজ বা টেলিভিশন শোতেই খালিদ ভাইকে বেশি দেখা গেছে। চাইম ব্যান্ডের বাইরে খালিদ ভাইয়ের প্রথম একক অ্যালবাম ‘এক টুকরো চাঁদ’। পরে প্রিন্স মাহমুদের সুরে তার আরেকটি অ্যালবাম রেরিয়েছিল যার শিরোনাম ‘ঘুমাও’(২০০৮)

খালিদ ভাই, আপনার জনপ্রিয় গান ‘এ হৃদয় ভেঙে গেলে জানো কী তা/লাগে না লাগে না জোড়া’- বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরুতে জোড়া ভাঙার কারণেই কি তখন ঘুমুতে চেয়েছিলেন? ‘এক মহাকাল ব্যথা তখনই পেয়েছিলেন কিনা জানি না। আবার আপনার গানেই আছে- যদি হিমালয় হয়ে দুঃখ আসে এ হৃদয়ে/ সে কিছু নয়/ শত আঘাতে নিঃস্ব যে আজ/তার আবার হারানোর ভয়…।

হারানোর ভয় না থাকলে জীবন থেকে পালাতেন কেন? প্রকাশ্য জীবনের আড়ালে যে আরেক জীবন সে জীবনে কী গান বাঁচে? গান থাকে? খালিদ ভাই আপনি কি জানতেন কয়েক প্রজন্ম আপনার গানেই সুখ-দুঃখ অভিমান খুঁজতো? ব্যান্ড ধারার গানে আপনি ছিলেন অভিমানী এক গানের পাখি, যে কিনা এক অজানা কারণে নিজেই নিঃস্ব হতে চেয়েছিল! এক হিমালয় সমান কী এমন দুঃখ ছিল আপনার?

বিশেষ দ্রষ্টব্য: ২০০৪/২০০৫ সালের কথা। লেখক, সুরকার ও গায়ক তানভীর তারেক ‘দ্বিধা’ শিরোনামের এক অ্যালবাম বের করবে। সেখানে আমার লেখা গান ছিল। ‘হায় এত দ্বিধা বুকেরই ভেতর তবে ভালোবাসো কেন’ গানটাতে খালিদ ভাই কণ্ঠ দেওয়ার পর আমি হাজির স্টুডিওতে। ১৯৯০ সালের পর সেই প্রথম দেখা। অভিমান রেখেই বললেন- ‘তুমি লিখেছো জানলে গাইতাম না। ভালোবাসা আর প্রেমে, শিল্প কিংবা গানে তোমাদের মতো রেজিমেন্টেশান আমি মানতে পারি না’!

তানভীর তারেক কোনও কথা বলতে মানা করছিল। সে দেখায়ও কোনও কথা বলিনি। এই অভিমান ভাঙাতে সাহায্য করেছিল তানভীর নিজেই। সেটাও তার আরেক গানে। গানের কথা ছিল এমন- ‘স্বপ্ন দেখি না/স্বপ্ন বেচি না/স্বপ্ন আমাকে দেখে/স্বপ্ন এখন কালো অক্ষরে আমার নিয়তি লেখে!/স্বপ্নচূড়ায় ফানুস উড়ায়ে মনে জাগে তবু ভয়/বন্ধু তোমাকে কেন যে আমার আজ বন্দুক মনে হয়!

ব্রিজলাইনটা গাইতে গিয়ে বেঁকে বসলেন খালিদ ভাই। আমাকে দেখিয়ে বললেন- ‘ও লেফট রাইট করা’ লোক। ওর কাছে বন্দুক স্বাভাবিক। আমার কাছে না’। এরপর ব্রিজ বা শুরুর লাইনটা গাইলেন এভাবে- ‘বন্ধু তোমাকে কেন যে আমার আজ দুঃস্বপ্ন মনে হয়!'

আসাম থেকে ফিরে ত্রিপুরার আগরতলায় ‘ত্রিপুরা দর্পণ’ পত্রিকায় বসে জানলাম আপনি আর পৃথিবীতে নেই। খালিদ ভাই, আপনার চলে যাওয়াটা আমার কাছে দুঃস্বপ্ন হয়েই থাকলো…

লেখক: রম্যলেখক

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
বন ও বনভূমি রক্ষায় কর্মকর্তাদের নিষ্ঠার সঙ্গে কাজ করতে হবে: পরিবেশমন্ত্রী
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
মোনাকোর হারে লিগ ওয়ান চ্যাম্পিয়ন পিএসজি
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
বাজারে এলো বাংলা ভাষার স্মার্টওয়াচ ‘এক্সপার্ট’
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
চার বছরে আট ফ্লপ, আসছে আরও এক হালি!
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ