X
বৃহস্পতিবার, ০৯ মে ২০২৪
২৬ বৈশাখ ১৪৩১

উচ্চশিক্ষার সাম্প্রতিক প্রবণতা

মো. সামসুল ইসলাম
২৭ এপ্রিল ২০২৪, ১৫:৩৯আপডেট : ২৭ এপ্রিল ২০২৪, ২০:৩৩

করোনা-পরবর্তী বিশ্বে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে ব্যাপক পরিবর্তন দেখা যাচ্ছে। কারণ করোনাকালীন বিশ্ব সবাইকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে যে উচ্চশিক্ষাকে হতে হবে বাস্তবমুখী, প্রায়োগিক এবং সেইসঙ্গে মানবিক। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের বা বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাম্প্রতিক বিভিন্ন সিদ্ধান্ত পর্যালোচনা করলে আমরা এর সত্যতা দেখতে পাই।

উচ্চশিক্ষা যদি মানুষের কল্যাণে ব্যবহৃত না হয় তাহলে উচ্চশিক্ষার প্রয়োজনীয়তা কী হতে পারে? করোনাকালীন সময়ে মৃত্যু, অসুস্থতা, ব্যবসা বাণিজ্যে অপূরণীয় ক্ষতি, চাকরির বাজারে অস্থিরতা ইত্যাদির কারণে পরবর্তী সময় উচ্চশিক্ষার ব্যাপক সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কীভাবে আরও জনমুখি হতে পারে, সংকটকালীন সময়ে কীভাবে কাজ করতে পারে এসব নিয়ে দেশে বিদেশে উচ্চশিক্ষার নীতিনির্ধারকের মধ্যে ব্যাপক আলোচনা চলছে। অনেক যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে।

যেমন ইন্ডাস্ট্রি-একাডেমিয়া সম্পর্কের ক্ষেত্রে কিছু সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে, যা বৈপ্লবিক। ভারতে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বা (ইউজিসি) গতানুগতিক পদ্ধতির বাইরে ইন্ডাস্ট্রি থেকে সরাসরি শিক্ষক নিয়োগের (lateral entry) পদ্ধতি চালু করেছে। ইন্ডাস্ট্রিতে দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞ, সম্মানিত, দক্ষ ব্যক্তিদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো সরাসরি নিয়োগ দিতে পারবে। তার শিক্ষক হওয়ার তথাকথিত যোগ্যতা যেমন ভালো রেজাল্ট, পাবলিকেশন, পিএইচডি থাকার দরকার নেই। এব্যাপারে ভারতীয় শিক্ষা প্রতিমন্ত্রী ডা. সুভাষ সরকার গতবছরের আগস্ট মাসে ভারতের রাজ্যসভায় ভারতীয় সরকারের পক্ষে একটি বিবৃতি দিয়েছেন। সেখানে তিনি বিশদভাবে এ ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করেন। ব্যবসা বাণিজ্য, আইনপেশা, সিভিল সার্ভিস ইত্যাদি ক্ষেত্রে যাদের পনেরো বছরেরও বেশি বিশেষ দক্ষতা রয়েছে তাদেরকে উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো প্রফেসর অব প্র্যাকটিস পদে নিয়োগ দিতে পারবে। সেক্ষেত্রে শিক্ষক হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের অন্যান্য যোগ্যতা শিথিল করা যাবে।  

এটি নিঃসন্দেহে একটি অভাবনীয় উদ্যোগ। আমাদের দেশে উদ্যোক্তা বা শিল্পপতিরা প্রায়ই বলেন তারা দক্ষ জনশক্তি পান না। সব বিষয়ের ক্ষেত্রে না হলেও অনেক বিষয়ের ক্ষেত্রে তত্ত্বীয় জ্ঞানের ওপর অতিরিক্ত জোর দেওয়ার ফলে প্রায়োগিক দিকগুলো শিক্ষার্থীদের কাছে অজানা থেকে যায়। ভারত এই ক্ষেত্রে যে পদক্ষেপ নিয়েছে তা তৃতীয় বিশ্বের অন্য দেশগুলোর জন্য অনুকরণীয় হয়ে থাকবে।

করোনাকালে বিশ্বব্যাপী অনলাইনে শিক্ষাদানের যে সাময়িক কার্যক্রম শুরু হয়েছিল তা এখন ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়েছে। অনলাইন, হাইব্রিড বা ব্লেন্ডেড লার্নিং উচ্চশিক্ষাকে সময়, স্থান বা বয়সের উর্ধ্বে নিয়ে গিয়ে উচ্চশিক্ষাকে সহজলভ্য ও সার্বজনীন করে তুলেছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অনলাইন বা হাইব্রিড শিক্ষার পদ্ধতিতে বিভিন্ন ডিগ্রি প্রোগ্রাম শুরু করেছে।  

ভারতীয় বিখ্যাত ইঞ্জিনিয়ারিং প্রতিষ্ঠান আইআইটি কানপুর অনলাইনে বিভিন্ন প্রোগ্রামে মাস্টার্স ডিগ্রি দিচ্ছে। দুঃখের বিষয় আমাদের দেশে এখনও অনলাইন ডিগ্রি বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) কর্তৃক স্বীকৃত নয়। এমনকি কেউ যুক্তরাষ্ট্রের আইভি লীগের কোনও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনলাইনে ডিগ্রি অর্জন করলেও তা বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন থেকে স্বীকৃতি পাবে না। আশা করি ইউজিসি খুব শিগগিরই এব্যাপারে একটি বাস্তবমুখী সিদ্ধান্ত নেবে।

অন্যদিকে জেনারেটিভ আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) টুল চ্যাটজিপিটি আসার পর শিক্ষাক্ষেত্রে ব্যাপক আলোড়নের সৃষ্টি হয়েছে। শুধু শিক্ষার্থী বা গবেষকদের চৌর্যবৃত্তি ঠেকানো এক্ষেত্রে একমাত্র ইস্যু নয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা উচ্চশিক্ষার কোর্স কারিকুলামে পরিবর্তন আনতে বাধ্য করছে। এআই, মেশিন লার্নিং, ক্লাউড-বেজড লার্নিং  সহ বিভিন্ন প্রাযুক্তিক উন্নয়ন উচ্চশিক্ষার নতুন নতুন দুয়ার খুলে দিয়েছে। আমাদের দেশেও এর ঢেউ এসে পড়েছে।

তবে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে বিশ্ববিদ্যালয়ের র‍্যাংকিং নিয়েই বোধ হয় আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি আলোচনা হয়। র‍্যাংকিংয়ে আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন ভালো করতে পারছে না এটা নিয়ে আমাদের মধ্যে ক্ষোভ, আলোচনা, হতাশা প্রভৃতি আছে। আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবশ্যই র‍্যাংকিংয়ে ভালো করা উচিত। তবে খোদ র‍্যাংকিং নিয়েও বাড়ছে বিতর্ক, সমালোচনা।

সম্প্রতি সুইজারল্যান্ডের বিখ্যাত জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয় টাইমস হায়ার এডুকেশনের র‍্যাংকিং থেকে নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তারা আর কোনও র‍্যাংকিংয়ে অংশগ্রহণ করবে না বলেও জানিয়েছে। পাবলিকেশনের সংখ্যাসহ যে সব সূচকের সাহায্যে র‍্যাংকিং নির্ধারিত হয় তাতে বিশ্ববিদ্যালয়ের সামগ্রিক শিক্ষাদান বা গবেষণার মান বা ব্যাপ্তি বোঝা সম্ভব নয় বলে তারা মনে করে এবং এজন্যই তারা র‍্যাংকিংয়ে আর আগ্রহী নয়। কিছুদিন আগে একই কারণে নেদারল্যান্ডের বিখ্যাত ইউট্রেক্ট বিশ্ববিদ্যালয় র‌্যাংকিং থেকে তাদের নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছে।

যুক্তরাষ্ট্রের বিখ্যাত ইউএস নিউজ অ্যান্ড ওয়ার্ল্ড রিপোর্ট সে দেশের বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের যে পদ্ধতিতে র‍্যাংকিং করে তা নিয়ে সে দেশে ব্যাপক বিতর্ক হয়েছে। গত বছরের সেই র‍্যাংকিংয়ে দেখা গিয়েছে সে দেশের পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর র‍্যাংকিংয়ে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে আর প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবনতি হয়েছে। বিষয়টি সে দেশের শিক্ষাবিদরা মানতে পারছেন না। মিডিয়ায় এটি নিয়ে ব্যাপক লেখালেখি হয়েছে।

র‍্যাংকিং নিয়ে বিতর্ক দিনে দিনে বাড়বে। এর অর্থ এই নয় যে আমি আমাদের দেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর ক্ষেত্রে র‍্যাংকিংয়ে অংশগ্রহণের বিরোধিতা করছি। তবে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে তাদের অগ্রাধিকার নির্ধারণ করতে হবে। র‍্যাংকিংয়ের পলিটিক্যাল ইকোনমি বা রাজনৈতিক অর্থনীতি নিয়ে সমসাময়িক আলাপচারিতা আমাদের জানতে হবে। এ বিষয়ে পরবর্তীতে বিস্তারিত লেখার ইচ্ছে আছে।  

বিশ্ববিদ্যালয়গুলো শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্যের এবং সুস্থতার ওপর বেশ জোর দিচ্ছে। বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে জ্ঞান উৎপাদনের জন্য যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা প্রয়োজন তা দিনে দিনে অনুভূত হচ্ছে। ২০২৩ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ১১৩টি ক্যাম্পাসের ৯০ হাজার শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক জরিপে দেখা যায় ৪৪ শতাংশ শিক্ষার্থীর মধ্যে  ডিপ্রেশনের লক্ষণ আছে, ৩৭ শতাংশ মানসিক দুশ্চিন্তায় ভুগছে, ১৫ ভাগ আত্মহত্যার কথা চিন্তাভাবনা করছে। যা এককথায় ভয়াবহ। আমাদের দেশে করোনা পরবর্তী সময়ে বেশ কিছু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার ঘটনা ঘটেছে। নারী শিক্ষার্থীরা হচ্ছেন যৌন নির্যাতনের শিকার। শিক্ষার্থীদের শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা রক্ষা এখন উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমি যখন এ লেখা লিখছি তখন গাজায় ইসরায়েলের আক্রমণকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্যাম্পাসে পুলিশের সাথে শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়েছে। বেশ কয়েকদিন আগে আমি ফেসবুকে তরুণদের প্রসঙ্গে লিখেছিলাম যে এ যুগের বয়স্করা এখনকার তরুণদের- যাদের Generation Z বা Zoomers বলা হয়,  অগ্রাধিকার বুঝতে পারছেন না - মূল্যবোধের পার্থক্যের যে জেনারেশনাল শিফট হয়েছে তা বুঝতে তারা অক্ষম। তরুণদের নিয়ে যে ধরনের বিশ্লেষণ তারা দেন সেটা বর্তমান জেনারেশনকে না বুঝতে পারার ফল বলা যায়। আরও বলেছিলাম সোশ্যাল মিডিয়ার কারণে তারা কিন্তু একধরনের  global perspective এ বিশ্বাসী। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে মানবাধিকার তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ।

যুক্তরাষ্ট্রের তরুণরা কিন্তু এ বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করছেন। মানবাধিকারের পক্ষে তার সরকার বা রাজনৈতিক অবস্থানের ঊর্ধ্বে এক শক্ত অবস্থান নিয়েছেন। বিশ্বব্যাপী উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে এ বাস্তবতা মেনে নিতে হবে – তরুণদের স্বার্থেই মানবাধিকারের সপক্ষে তাদের অবস্থান নিতে হবে।

লেখক: বিভাগীয় প্রধান, সাংবাদিকতা বিভাগ, স্টেট ইউনিভার্সিটি অব বাংলাদেশ

[email protected]

 

/এসএএস/এমওএফ/

*** প্রকাশিত মতামত লেখকের একান্তই নিজস্ব।

বাংলা ট্রিবিউনের সর্বশেষ
শুল্ক জটিলতায় আটকে আছে ২০ অ্যাম্বুলেন্স, আমদানিকারকদের ক্ষোভ
শুল্ক জটিলতায় আটকে আছে ২০ অ্যাম্বুলেন্স, আমদানিকারকদের ক্ষোভ
সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার তালিকায় ফের শীর্ষে বাংলাদেশ
সাগরপথে ইউরোপে যাওয়ার তালিকায় ফের শীর্ষে বাংলাদেশ
প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিলেন বাইডেন
প্রকাশ্যে ইসরায়েলকে অস্ত্র সরবরাহ বন্ধের হুমকি দিলেন বাইডেন
অবন্তিকার আত্মহত্যা: জবি সাবেক সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম জামিনে মুক্ত
অবন্তিকার আত্মহত্যা: জবি সাবেক সহকারী প্রক্টর দ্বীন ইসলাম জামিনে মুক্ত
সর্বশেষসর্বাধিক

লাইভ